এই সময়ের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক দীপান্বিতা রায়। প্রবলভাবে সমাজ ও রাজনীতি সচেতন। লেখেন চারপাশের জগৎ নিয়ে। নিষ্ঠুর নিরপেক্ষতায় বিচার করেন নিজের পারিপার্শ্বিকতাকে। তবে আটকে থাকেন না সীমিত গণ্ডির মধ্যে। দৃষ্টি অতি তীক্ষ্ণ। বলেন জীবনের কথা, নানা শ্রেণির মানুষের কথা। চরিত্ররা আপাতভাবে সাধারণ। তবু বৃহত্তর জীবনবোধে উন্নীত।
তাঁর উপন্যাস ‘শেষ বাঁকে দাঁড়িয়ে’। কাহিনি একটা বিশেষ সময়ের। ধরা পড়েছে ভাল দিক, মন্দ দিক। চরিত্ররা বড় বেশি রক্ত-মাংসের। মনে হয় দেখা, চেনা, জানা। সেইসঙ্গে চেনা অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়।
আরও পড়ুন-সাত বছরের মাথায় ফের কেন নোট বাতিল
ভূমিকা লিখেছেন গৌতম ঘোষ। উপন্যাসটি পড়ে তাঁর মনে হয়েছে, ‘নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে নতুন শতকের প্রথম দশ-বারো বছর জুড়ে এই উপন্যাস বিস্তৃত। সময়ের অভিঘাত এই উপন্যাসটিকে একটা অন্য মাত্রা দিয়েছে।’
একটি খুনের ঘটনা অবলম্বনে দানা বেঁধেছে কাহিনি। হয়তো এই কাহিনি আমাদের জানা। তাই সহজেই যোগ স্থাপন করা যায়। ঝরঝরে ভাষা, শব্দের ব্যবহার এবং স্মার্ট উপস্থাপনায় লেখাটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। শুরুটা এইরকম : ‘‘বিস্তীর্ণ প্রান্তর। সবুজ ঘাসে ঢাকা তৃণভূমি। সমতল নয়। মাঝে-মধ্যে উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো। ঝোপঝাড় নেই। দূরে দেখা যাচ্ছে নীলাভ গাছের সারি। মাঠের ঠিক মাঝখানে একটি মস্ত বটবৃক্ষ। লম্বা লম্বা ঝুরি নেমেছে। তার কিছু ভূমি স্পর্শ করে, ধুলো-মাটির স্তর ভেদ করে চলে গেছে নিচে। গাছের সঙ্গে পৃথিবীর সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করাই তাদের লক্ষ্য।”
আরও পড়ুন-যুদ্ধ বন্ধ করুন, ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জি-৭ গোষ্ঠীর
সুন্দর বর্ণনা। ছোট-ছোট বাক্য। পড়তে-পড়তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে গ্রাম-বাংলার মুখ। সবুজ প্রকৃতির ছবি। ‘নীলাভ গাছের সারি’র প্রয়োগে প্রকাশ পায় বিশুদ্ধ কবিমন। গল্প হোক বা উপন্যাস, কোনও কোনও অংশ হয়ে ওঠে নির্ভেজাল কবিতা। শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, মানিক, তারাশঙ্কর থেকে ভূরি ভূরি উদাহরণ তুলে আনা যায়।
আলোচ্য লেখিকা চমৎকার গল্প বলেন। পারেন টেনে রাখতে। অসাধারণ বর্ণনার পাশপাশি সংলাপ রচনায় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। প্রীতমা এই উপন্যাসের প্রধান নারী-চরিত্র। বিবাহবার্ষিকীর দিন ছেলেকে বলে, ‘আজ আমার আর বাবার হ্যাপি বার্থডে।’ প্রয়োগটি ভাল লাগে। বিবাহবার্ষিকী তো আসলে যৌথ যাপনেরই জন্মদিন!
আরও পড়ুন-অভিষেককে বলেই রেশন পেলেন সমীর
নামকরণে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন লেখিকা। একটি শিশু চরিত্রের নাম রোদ। ঘটনার ঘনঘটা। রকমারি চরিত্রের সমাহার। প্রীতমার স্বামী প্রিয়াংশু। এ-ছাড়াও আছে নকুল, মালতী, সদাশিব, তুহিনা। চরিত্রগুলোর মধ্যে আছে আলো-দিক, কালো-দিক। সমাজ, সংসারের হাত ধরে এসেছে রাজনীতি। ফুটে উঠেছে তার কদর্য দিক। দল আছে। প্রবল দলাদলি আছে। সেইসঙ্গে আছে অসৎ, লোভী, স্বার্থপর, হিংস্র মানুষের ভয়ংকর উপস্থিতি। একেবারেই সহজ-সরল নয় কাহিনি। বেশ জটিল। রহস্যময়। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার অন্যায় আবদার না মেটানোর মাশুল দিতে হয় সৎ এবং সাহসী ডাক্তার প্রিয়াংশুকে। ঘটে যায় প্রাণহানি। তারপর শুরু হয় প্রীতমার একক লড়াই। প্রবল ক্ষমতাবানের বিরুদ্ধে। সবমিলিয়ে ‘শেষ বাঁকে দাঁড়িয়ে’ একটি অনবদ্য রাজনৈতিক থ্রিলার। এর বেশি কিছু বলছি না। বাকিটা তোলা থাক আগ্রহী পাঠকদের জন্য। বইটি প্রকাশিত হয়েছে মিত্র ও ঘোষ থেকে। প্রচ্ছদ শিল্পী সন্দীপ দাশ।
আরও পড়ুন-উত্তর সিকিমে ধসে আটক পর্যটকদের উদ্ধার
প্রবীণ লেখক নিমাই মাইতি। থাকেন শহর থেকে দূরে। সবুজ প্রকৃতির কোলে তাঁর যাপন। সারল্য রয়েছে চরিত্রের মধ্যে। মূলত কবি। পাশাপাশি লেখেন গদ্য। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর উপন্যাস ‘হিজল পাড়ে সন্ধ্যা’।
কাহিনি এগিয়েছে রেবতীকে ঘিরে। বলা হয়েছে এই নারীর জীবনযুদ্ধে লড়াই করে বাঁচার গল্প। কাহিনি জটিল। তবে বড় বেশি চেনা। সমাজ থেকে উঠে আসা। চরিত্রগুলোও অ-দেখা নয়। শুধু বদলে যায় নাম, বদলে যায় মুখ।
রেবতী চাকুরে মহিলা। লড়াকু। তার স্বামী অরণ্য। আশ্চর্য দাম্পত্যজীবন তাদের। অ-সুখের মধ্যেই তারা সুখ খোঁজার নিরন্তর চেষ্টা করে। পরস্পরের প্রতি আছে গভীর বিশ্বাস, শ্রদ্ধা। সংসারে রেবতীকেই একা হাতে সবদিক সামলাতে হয়। যদিও বিয়ের পর তারা একটা সময় যৌথ যাপনের সুযোগ পায়নি। মালা বদলের রাতেই বিশেষ কারণে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে যায়। দূরে চলে যায় অরণ্য। দশ বছর পর হঠাৎ একদিন ফিরে আসে। সম্পূর্ণ অচেনা হিসেবে। তখন থেকেই সে পঙ্গু। অচেনা, অসুস্থ পুরুষটিকে নিজের ঘরে আশ্রয় দেয় রেবতী। সেই সময় কথায়-কথায় জানতে পারে ভদ্রলোকটি তার স্বামী অরণ্য! যে অজান্তেই হয়েছিল রাজনীতির শিকার। রেবতী নিজের হাতে তুলে নেয় তার সেবা-শুশ্রূষার ভার। নদীর মতো এগোতে থাকে জীবন। ভালয়-মন্দে।
আরও পড়ুন-প্রস্তুতি ম্যাচে ৬ গোল কিবুর দলের
এক বৃষ্টি-রাতে ঘটে যায় একটি অবাঞ্ছিত ঘটনা। অন্ধকারের মধ্যে এক অচেনা পুরুষের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে বাধ্য হয় রেবতী। ঘৃণা জন্মায় নিজের প্রতি। প্রথম-প্রথম গুটিয়ে থাকলেও একদিন অরণ্যের কাছে উজাড় করে সবকিছু। অক্ষম অরণ্য উপলব্ধি করে পরিস্থিতি। নির্দিষ্ট সময়ে ফুটফুটে সন্তানের জন্ম দেয় রেবতী। যে-সন্তান আগামীদিনে পরিচিত হবে অরণ্যর সন্তান হিসেবে।
আরও পড়ুন-টানা ৯ঘণ্টা ৪০মিনিট জিজ্ঞাসাবাদ, বেরিয়ে এসে অভিষেকের তোপে বিধ্বস্ত বিজেপির এজেন্সি রাজনীতি
টানা লেখা উপন্যাস। কোনওরকম পর্ব ভাগ করা হয়নি। তবে লেখক সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। একদমে পড়ে ফেলা যায়। একজন কবি যখন গদ্য লেখেন তার মাধুর্য অন্যরকম হয়। এই ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। ছোট্ট একটি অংশ তুলে ধরা যাক : ‘‘বিকেল গড়িয়ে আসছে। হালকা রোদের মধ্যেও গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। যেন ইলশে গুঁড়ি। অরণ্য বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখে সারা আকাশ জুড়ে যেন রামধনু উঠেছে। কালো মেঘের অন্তর থেকে রঙের রোশনাই।” সুন্দর একটি মুহূর্তের বর্ণনা। ভাল লাগে। টান-টান সংলাপ রচনায় লেখক যথেষ্ট পারদর্শী। দুষ্ট হয়নি অতিকথনের দোষে। ‘হিজল পাড়ে সন্ধ্যা’ উপন্যাসে আছে আরও কিছু চরিত্র। অনিমেষ, নিখিলেশবাবু, নন্দবাবু, পুঁটির মা, বংশী মাহাতো। রহস্যঘেরা এই কাহিনির মধ্যে যেমন সংসার এসেছে, তেমন এসেছে রাজনীতি। তুলে ধরা হয়েছে একটি বিশেষ সময়ের কথা। উত্তাল সময়। হয়তো এক যুগ আগের। এটুকুই বললাম। বাকিটা পাঠক বুঝে নেবেন। বইটি প্রকাশিত হয়েছে কবিতিকা থেকে। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবি রাজা রবি বর্মার আঁকা।