আজ থেকে অনেক বছর আগে এক বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস প্রথম প্রমাণ করেছিলেন যে গাছেরও প্রাণ আছে, তাদেরও বৃদ্ধি ঘটে, ঘটে চলনও অর্থাৎ জীবের প্রায় সমস্ত ধরনের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় গাছে। তাই বলে গাছ চিৎকার করে! একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না? না এটিও সত্য। ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে আজ থেকে বহু বছর আগে প্রমাণিত একটি সত্যের নিদর্শন আবারও চাক্ষুষ করার সুযোগ এসেছে কিছু বিজ্ঞানীর হাত ধরে। আমরা মানুষেরা ভয় পেলে বা রেগে গেলে চিৎকার করি, ঠিক একই ঘটনা ঘটে গাছেদের সঙ্গেও। তারাও খুব অসহ্য পরিবেশে বা অসুবিধায় পড়লে চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু সেই চিৎকার আমাদের কর্ণগোচর হয় না। এই চিৎকারের আভাস পান ইজরায়েলের তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিজ্ঞানী আর তাঁদের পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই আমরা এটি বলতে পারি যে, গাছেরাও (Plant) চিৎকার করে ঠিক মানুষের মতো। কিন্তু তাদের পদ্ধতি বা ভঙ্গি কিছুটা আলাদা রকমের।
গাছের অস্বস্তি ও বাঁচার কৌশল
যদিও যেকোনও প্রতিকূল পরিবেশে গাছেদের বহিঃপ্রকাশ অন্যরকম তাই তা আমাদের খুব একটা শ্রুতিগোচর বা দৃষ্টিগোচর হয় না, তা-ও আমরা যদি একটু খেয়াল করি তাহলে দেখতে পাব যে খুব অস্বস্তিজনক বা প্রতিকূল পরিবেশে বিভিন্ন গাছ বিভিন্নভাবে তাদের অভাব-অভিযোগ প্রকাশ করার বা সবার সামনে সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করে। যেমন, অস্বস্তিজনক পরিস্থিতিতে তারা তাদের রঙ পরিবর্তন করে, আবার ফলের আকার ও আকৃতির পার্থক্য ঘটে এই অস্বস্তির কারণেই। এমনকী গাছেরা যখন খুব খরা ভোগ করে বা কোনও শাকাহারী প্রাণীর শিকার হয়, তখন আবার তারা একধরনের উদ্বায়ী তরল নিঃসরণ করে যাতে আশপাশের গাছেরা সতর্ক হয়ে যায় এবং কোনওভাবে বাঁচার কোনও উপায় পায়। এ-ছাড়াও সদ্য পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গাছ এইসব পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে চিৎকার করে ওঠে, যদিও তা আমাদের শ্রুতিগোচর না হলেও কিছু নিম্নশ্রেণির প্রাণীরা তা ঠিক বুঝতে পারে। মানুষের মতোই এদের চিৎকারও কিছু সংকেত বহন করে, এমনকী সবচেয়ে শান্ত শব্দহীন স্থানেও তাদের চিৎকার ধ্বনিত হয়— এই সমস্ত তথ্য আমাদের প্রদান করেন এই গবেষণার সবচেয়ে প্রবীণতম ব্যক্তি, তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর লিলাখ হ্যাডনি।
গবেষণা ও তার থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি
তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ এবং অবশ্যই প্রফেসর হ্যাডনি গাছের শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করেন, সাধারণত তাঁরা গাছেদের আঘাত, তাদের দেহে জলের অভাবের মাত্রা পরীক্ষার পাশাপাশি এমন কিছু তথ্য পায় যা সবাইকে অবাক করে দেয়। তাঁরা সেইসব যন্ত্রে বিভিন্ন তথ্যের পাশাপাশি কিছু শব্দের উপস্থিতিও পান, যার কম্পাঙ্ক এতটাই বেশি যে তা কোনও মানুষের পক্ষে শুনতে পাওয়া সম্ভব নয়। তাঁরা শব্দের এই মাত্রার প্রাবল্য গাছেদের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মাপতে থাকেন। এখানে একটি কথা উল্লেখ করে দেওয়া ভাল যে, এই বিজ্ঞানীরা মূলত কোন গাছ বা কোন কোন গাছের ওপর এই পরীক্ষা করেন— তাঁদের পরীক্ষা মূলত টম্যাটো ও তামাক গাছের ওপর। তাঁদের মতে, এই দুটি গাছের চাষ করা খুব সহজ ও এরা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এ-ছাড়াও তাঁরা আরও বিভিন্ন উদ্ভিদ যেমন ভূট্টা, গম, আঙুর ও ক্যাকটাস ইত্যাদির ওপরও এই একই পরীক্ষা করেন।
গবেষণার পদ্ধতি
এবার সরাসরি চলে আসা যাক মূল বিষয়ে অর্থাৎ গবেষণার পদ্ধতিতে। প্রায় সমস্ত প্রাণীই যন্ত্রণা পেলে চেঁচায় আর এই ধর্মটিকেই কাজে লাগিয়ে গবেষকগণ পরীক্ষা চালান। তাঁরা শব্দমুক্ত অ্যাকাউস্টিক একটি ঘরে কতকগুলি মাইক্রোফোন রেখে সুস্থ এবং যন্ত্রণাগ্রস্ত তামাক ও টম্যাটো গাছের পরীক্ষা করেন। এই একই পরীক্ষা তাঁরা আবার শব্দযুক্ত গ্রিনহাউসেও করেন। কোনও গাছকে যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য তাঁরা তাঁদের এই পরীক্ষায় সাধারণত দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করেন। এক, তাঁরা গাছকে জল দেওয়া বন্ধ করেন ও তারপর পরীক্ষা করেন। আর দুই, তাঁরা গাছের কোনও অংশ ইচ্ছাকৃতভাবে কেটে দেন— বিশেষত কাণ্ড বা তার কোনও অংশ এবং তারপর যন্ত্রের মাধ্যমে উক্ত গাছগুলির পরীক্ষা করেন।
গবেষণার ফলাফল
এই পরীক্ষার ফলাফল থেকে জানতে পারা যায় যে, যন্ত্রণারত অবস্থায় প্রতি ঘণ্টায় গাছেরা (Plant) প্রায় ৪০-৮০ kHz কম্পাঙ্কের শব্দ (আল্ট্রাসনিক সাউন্ড) উৎপন্ন করে প্রায় ৩০-৫০টি ক্লিকে। এখানে একটি ব্যাপার একটু স্পষ্ট করে বলে রাখা দরকার যে, আসলে গাছেরা যখন শব্দ করে তখন যন্ত্রে তা একটি ‘ক্লিক’-এর মতো বা ‘পপ’-এর মতো শোনা যায়। তাই বলা হয়, কোনও গাছ যখন খুব কষ্টে থাকে তখন তারা প্রতি ঘণ্টায় এরকম ৩০-৪০টি ক্লিক করে যার কম্পাঙ্ক হয় ৪০-৮০ kHz। কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় তারা কোনওরকম শব্দই করে না। আবার কোনও গাছ যদি জল না পায় বা জলাভাবে ভোগে তখন তারাও আবার শব্দ করতে থাকে কিন্তু তার প্রকৃতি হয় কিছু আলাদা রকম অর্থাৎ এ-অবস্থায় তাদের কম্পাঙ্কের পার্থক্য দেখা যায়। এমনকী কোনও গাছ একদিন জল না পেলে একরকমের আওয়াজ আর প্রায় পাঁচদিন জল না পেলে আরেক রকমের আওয়াজ করে বা বলা ভাল তারা তারস্বরে চেঁচাতে থাকে, অর্থাৎ শব্দের প্রাবল্য এক্ষেত্রে বৃদ্ধি পায়। খুব সরলভাবে বলতে গেলে এই শব্দ ও তার প্রাবল্যের পার্থক্য ঘটে তাদের যন্ত্রণার প্রকৃতি ও সেই যন্ত্রণার কারণের ওপর।
যদিও বিজ্ঞানীরা এই উৎপন্ন শব্দের আসল ক্রিয়াপদ্ধতির হদিশ এখনও পাননি, তা-ও যতটুকু জানা যায়, সেটা হল এই শব্দের আসল উৎস হল উদ্ভিদের (Plant) সংবহন তন্ত্র বা ভাস্কুলার সিস্টেমের মধ্যে বায়ুর বুদবুদ ফাটা আর সেটি যেকোনও অস্বস্তিজনক পরিস্থিতিতে আরও বাড়তে থাকে, যার ফলস্বরূপ ওই আওয়াজ পাওয়া যায়।
কী অদ্ভুত না! আমরা মানুষেরা এত উন্নতমানের জীব হওয়া সত্ত্বেও গাছের (Plant) এই আর্তনাদ শুনতে পাই না। তাই কারণে-অকারণে নির্দ্বিধায় আমরা যেকোনও পরিস্থিতিতে গাছ কাটতে পারি, যেকোনও প্রাণীও গাছের ওপর অত্যাচার চালাতে পারে এই চিৎকার না শুনেই। তাই বিজ্ঞানীরা আশায় বুক বাঁধেন আর ভাবেন যে এমন এক সময়, এমন এক বিবর্তন নিশ্চয় আসবে যে সমস্ত জীব গাছের এই আর্তনাদ বুঝতে পারবে, শুনতে পারবে আর সেই অনুযায়ী নিজেদের মত পরিবর্তন করে গাছকে নিজের মতো করে বাঁচার সুযোগ করে দেবে।
আরও পড়ুন: মোহনবাগান সমর্থকদের ইডেনে ঢুকতে বাধা, দায় অস্বীকার কেকেআরের