প্রত্যেক সফল পুরুষের পিছনে রয়েছেন একজন নারী— এটাই যুগে যুগে প্রচলিত প্রবাদ কিন্তু যুগ বদলেছে সেই সঙ্গে বদলে গেছে ভাবনা এবং দৃষ্টিভঙ্গি। এখন নারী-পুরুষ দুজনেই সমানভাবে সাফল্যের কান্ডারি। একে অপরের পরিপূরক। হাতে হাত মিলিয়ে তাঁরা এগিয়ে যান। এমনই এক ব্যতিক্রমী নারী যাঁকে সমৃদ্ধ করেছেন পুরুষ, যিনি নেপথ্যে থাকেননি, নিজেকে মেলে ধরেছেন স্বমহিমায়। সমাজের প্রতিটা মানুষের পাশে থেকেছেন, আর্তের সেবা করেছেন, বিশেষ করে মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি হলেন হাওড়ার শামিমা মল্লিক।
আরও পড়ুন-পশ্চিমবঙ্গকে আক্ষরিক অর্থে ভিখারি করে ছেড়েছিল বামেরা
শামিমার স্বামী পেশায় ব্যবসায়ী আবদুল হান্নান মল্লিক এবং তাঁর বন্ধুরা চেয়েছিলেন মানুষের জন্য কিছু করতে, জাতপাত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে আর চাইতেন মুসলিম নারীদের উন্নয়ন। কারণ তাঁদের উন্নয়নের গ্রাফ বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে একটু নিচের দিকে। এমন মহতী উদ্দেশ্যেকে রূপদান করতে এগিয়ে আসেন আবদুল হান্নান মল্লিক, বন্ধু সেখ হায়দার আলি, মাসুদুর রহমান, মহসিন হালদার, রসিদুল মোল্লা, আফসার রহমান, সেখ জহিরুল আহমেদ লস্কর, মাস্টার রুহুল আমিন প্রমুখ। এঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শুরু হয় হিদায়া ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট এবং দ্বিনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজ। ট্রাস্টের জন্য অর্থ সংগ্রহে তাঁরা গেছেন দূর থেকে দূরান্তে। তাঁরা একা নন পাশে রাখেছেন তাঁদের অর্ধাঙ্গিনীদেরও। যাঁদের মধ্যে অন্যতম শামিমা মল্লিক।
আরও পড়ুন-চমক আর চমক, তোমার কি আর কিছুই নাই, মোদিপক্ষ?
হিদায়া ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট হাওড়ায় এখন বেশ পরিচিত একটা সমাজসেবী সংগঠন। এই ফাউন্ডেশনেরই মহিলা প্রেসিডেন্ট হলেন শামিমা। এখান থেকেই শামিমার যাত্রাপথ শুরু। সামাজিক উন্নয়নে স্বামীর পথ অনুসরণ করে নিজেকে নিয়োজিত করেন সমাজসেবা ও নারী-কল্যাণমূলক কর্মে।
কলকাতার এন্টালির বাসিন্দা শামিমা ছোট থেকে উদার পরিবেশে বড় হয়েছিলেন। সবসময় চেয়েছিলেন এই সমাজের জন্য, জাতধর্ম নির্বিশেষের জন্য বিশেষ করে মুসলিম মেয়েদের জন্য কিছু করতে। স্কুল-কলেজ জীবন থেকেই সমাজকল্যাণমূলক কর্মে যুক্ত হয়েছেন বারবার। প্রচুর বই পড়েছেন জেনেছেন প্রতিটা ধর্মের সারাৎসার। শামিমার মতে, ‘ধর্ম মানে ধারণ করা। যা আমরা ধারণ করি তাই তো ধর্ম।’ বাবার উদার মনোভাব শামিমাকে প্রভাবিত করে সেই সঙ্গে প্রতিবেশী পিসিমা পূরবী দত্তের গভীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। বিয়ের পরেই তাঁর আসল কর্মযজ্ঞের শুরু। একচল্লিশ দিনের কঠিন হজযাত্রা করেছেন একরত্তি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। স্বামী আবদুল হান্নান মল্লিকের সংস্পর্শে এসে সমাজের জন্য মানুষের জন্য তাঁর অনেক কিছু করার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে শুরু করে।
আরও পড়ুন-বিরোধী দলনেতাকে পাল্টা জবাবে তুলোধোনা করে বিধায়কের চ্যালেঞ্জ
হিদায়া ফাউন্ডেশন ট্রাস্টে রয়েছে একটি পুরুষদের গ্রুপ, তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে একটি মহিলা গ্রুপ এবং একটি জুনিয়র গ্রুপ। তিনটি গ্রুপই সমানতালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে চলেছে। সুন্দরবন, সাগরদ্বীপ অঞ্চলে আয়লা এবং আমফান-বিধ্বস্ত দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, ভয়াবহ বন্যা-কবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ, কোভিডকালে দুঃস্থদের খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, পুলিশকর্মীদের বিনামূল্যে মাস্ক, স্যানিটাইজার বিতরণ, নেপালে ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, পনেরোশোর বেশি দুঃস্থ শিশুদের বিনামূল্যে বইখাতা এবং স্কুলের জিনিসপত্র দেওয়া থেকে শুরু— আরও বহুবিধ কর্মসূচি প্রতিদিন করে থাকেন এই সংস্থাটি, যার অন্যতম কান্ডারি শামিমা। এই মুহূর্তে একশোর বেশি মেয়ে এই সংস্থার আয়োজিত বিভিন্ন ক্যাম্পে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, পাশাপাশি শিশু মনস্তত্ত্ব, হেলথ কেয়ার এবং পুষ্টি-সংক্রান্ত নানা ক্যাম্পেরও আয়োজন করে থাকে। এই ফাউন্ডেশনের নানা আলাপ-আলোচনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন শামিমা। সংস্থার অন্য সদস্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আর্তের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন-জয় শ্রীরাম স্লোগান দিয়ে কুর্মিদের ছদ্মবেশে হামলা, কড়া বার্তা অভিষেকের
শামিমা তথা হিদায়া ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের যাঁরা কান্ডারি, তাঁদের অন্যতম আর-একটি অবদান হল মুসলিম মহিলাদের জন্য নির্মিত কলেজ। এই কলেজটির নাম দ্বিনিয়াত মুয়াল্লিমা কলেজ বা ডিএমসি।
দেখা গেছে গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ মুসলিম পরিবারভুক্ত মেয়েরা খুব বেশি দূর অবধি পড়াশুনো করেন না। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত গিয়ে তাঁদের বেশিরভাগের বিয়ে হয়ে যায় বা কোনও কারণে পড়া বন্ধ হয়ে যায়। ফলত উন্নয়ন ও অগ্রগতির আলো তাঁদের কাছে অর্ধেকটাই পৌঁছয়। গ্রামাঞ্চলের মুসলিম মেয়েদের ক্ষমতায়নকে বাস্তবায়িত করতে শামিমার স্বামী এবং তাঁর ব্যবসায়ী-বন্ধুরা মিলেই গড়ে তুললেন দ্বিনিয়াত মুয়াল্লেমা কলেজ। এখানে সক্রিয়ভাবে রয়েছেন শামিমা মহিলা গ্রুপের সদস্যরা। এই কলেজটি ইতিমধ্যেই মুসলিম মেয়েদের জন্য এক অভিনব শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করে নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়েছে বলা যেতে পারে। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে পাঁচশোর বেশি ছাত্রী মুয়াল্লিমা অর্থাৎ শিক্ষিকা হিসেবে মিশন, মক্তব এবং নানান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এই কলেজটির মূল নীতি হল জীবনমুখী এবং জনমুখী শিক্ষার মাধ্যমে মুসলিম মেয়েদের সার্বিক মানোন্নয়ন ও উচ্চশিক্ষার প্রচেষ্টা। কলেজের পাঠ্যসূচিতে স্থান পেয়েছে ইসলামের মূল বিষয়গুলি যেমন কুরআন, হাদিস, আকাইদ ও মাসায়েল, ইসলামি তারবিয়াত ও আরবি-উর্দু ভাষা শিক্ষা। পাশাপাশি কম্পিউটার, নিউট্রিশন, হেলথ হোম ম্যানেজমেন্ট, চাইল্ড সাইকোলজি, টিচিং মেথড নিয়েও এখানে পড়াশুনো করছেন ছাত্রীরা।
আরও পড়ুন-জঙ্গলমহলে জনপ্লাবন
শামিমার কথায়, ‘‘চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট সমাজসেবী শেখ মাসুদুর রহমান সাহেবের আন্তরিক মহানুভবতায় তাঁর নিজস্ব ভবনটি কলেজের জন্য দিয়ে দেন। এখানে রেসিডেন্সিয়াল এবং নন-রেসিডেন্সিয়াল— দু’ধরনের ব্যবস্থাই রয়েছে। অনেকেই এখানে থেকে পড়াশুনো করেন। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরেই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এখানে আসেন মেয়েরা। কোরান শরিফ শেখেন। তাঁরা শুধু শেখেন এমন নয়, পরবর্তীতে শিক্ষয়িত্রী হিসেবে শেখাচ্ছেন এবং স্বনির্ভর হয়ে উঠছেন। কোরান শরিফ শেখানোর মূল উদ্দেশ্য হল মহিলা মৌলানা তৈরি করা। নতুন কনসেপ্টে তৈরি এই কলেজের কথা বলতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রাণপুরুষ কলেজ সেক্রেটারি শেখ হায়দার আলির কথা বলতে ভোলেন না শামিমা। তাঁর অবদান অপরিসীম। সঙ্গে সক্রিয়ভাবে রয়েছেন আবদুল হান্নান মল্লিক-সহ হিদায়া ফাউন্ডেশনের সব কর্তাব্যক্তি। সহযোগী কর্মী হিসেবে তাঁদের পাশে কাজ করে চলেছেন শামিমা মল্লিক সহ অন্য সদস্যারা। যাঁর মধ্যে অন্যতম হলেন হাওড়া জেলার কর্মাধ্যক্ষ আম্বিয়া খাতুন। কলেজের ছাত্রীদের পুঙ্খানুপুঙ্খ তত্ত্বাবধানে রয়েছেন নাসিমআরা খাতুন। প্রত্যেকের ভূমিকাই এখানে অনস্বীকার্য। শামিমা মাঝে-মাঝে উপস্থিত হয়ে কলেজের একজন মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে ছাত্রীদের মানসিক উন্নতিসাধনের দায়িত্ব পালন করেন। ইসলামের ব্যাপ্তি বোঝানো, আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, ভয়কে জয় করার পথে পরিচালনা করেন তিনি। দায়িত্বের ফাঁকে মহিলা গ্রুপের সদস্যারা একযোগে বছরে একটা দিন আনন্দে মেতে ওঠেন। কলেজের সম্প্রসারণ নিয়ে আগামীতে বহু পরিকল্পনা রয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষের। সম্প্রতি সরকারি অনুদানও পেয়েছে।
এর বাইরে ‘আমরা ফ্যামিলি গ্রুপ’ নামের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত শামিমা। রাজা ব্যানার্জি পরিচালিত এই গ্রুপটি ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মানুষের জন্য কাজ করেন। রক্তদান শিবির থেকে দুঃস্থদের বস্ত্রদান ইত্যাদি সমাজসেবামূলক কর্ম এবং মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধি বপন করাই গ্রুপটির উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুন-জরিমানায় স্থগিতাদেশ
শামিমা সম্প্রতি ‘মানবিক সুচেতনা সমিতি’ বলে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য হয়েছেন। এই সংস্থাটি হাওড়ায় নানা সমাজকল্যাণমূলক কাজ করে চলেছে। তাঁর অবসর যাপনের সঙ্গী কাব্য-কবিতা। কবি বলে শামিমার বিশেষ পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তা রয়েছে পরিচিত মহলে। বিভিন্ন ম্যাগাজিন এবং পত্র-পত্রিকার ইদ সংখ্যায় এবং নানাধরনের বিশেষ সংখ্যায় শামিমার কবিতা নিয়মিত ছাপা হয়।
শামিমার গুণের শেষ নেই। জি বাংলার জনপ্রিয় শো দিদি নাম্বার ১-এ অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হয়ে তিনি এখন বেশ পরিচিত একটি মুখ। তাঁর পরিচিতির বড় কারণ হল, তিনি উল্টো করে বাংলা কথা বলতে পারেন অনর্গল। রচনা ব্যানার্জি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন তাঁর এই উল্টো করে বাংলা শুনে। দিদি সাবেয়া আহমেদের সঙ্গেই শামিমা উল্টো করে বাংলা বলেন যা শুনলে বাংলা বললে বিশ্বাস হবে না। তিনি শুধু স্ত্রী নন, একজন সফল মা এবং শাশুড়িও। পরিবারের মেয়েদের স্বাধীন চিন্তাধারায় বিশ্বাসী হতে শিখিয়েছেন শামিমা।
শামিমা হলেন আজকের মুসলিম নারীর প্রতিনিধিত্বে থাকা এক সফল মুখ। কিন্তু তিনি আসলেই জাতপাত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষের ঊর্ধ্বে উঠে এই সমাজ তথা গোটা দেশের নারীশক্তির প্রতীক।