সুন্দরবনের নাম করলে অনেকের কাছেপিঠে দু-এক রাত্তির জল ও অরণ্যের কোলে কাটিয়ে আসার বাসনা তীব্র হয়। এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্যময় সুন্দরবন প্রকৃতির এক অমূল্য সম্পদ। এখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণী-সম্পদ বৈচিত্র্যময়। এখানেই গড়ে উঠেছে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বা গ্যাঞ্জেটিক ডেল্টা। তৈরি হয়েছে অসংখ্য দ্বীপ। তাদের মধ্যে মানুষের পদচিহ্ন তেমনভাবে পড়েনি এমন দ্বীপও আছে। সুন্দরবনে প্রায় ৬৫ ভাগ বনাঞ্চল ও এক ভাগ জল। জোয়ারের সময় অনেক দ্বীপকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। আবার ভাটার টানে জল সরে গেলে দ্বীপগুলো জেগে ওঠে। সাগরের নোনা জলে নদীনালা, খাঁড়ি, অরণ্যের অনেকাংশ সারাদিনের অনেকটা সময়ই জলমগ্ন থাকে। তাই সুন্দরবনের পরিবেশ লবণাক্ত। এমন লবণাক্ত পরিবেশেও স্বল্প অক্সিজেন-যুক্ত মাটিতে বেঁচে থাকার জন্য সুন্দরবনের বৃক্ষরাজি নিজেদের নানাভাবে নানারূপে অভিযোজিত করে এক অভিনব অরণ্যের সৃষ্টি করেছে। সমষ্টিগতভাবে এদের বলা হয় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (Mangrove-forest) বা লিটরাল বা টাইডাল ফরেস্ট। বাংলায় বাদাবন বা লবণাক্ত জলাভূমির অরণ্য অথবা লবণাম্বু অরণ্য।
বৃক্ষের বৈচিত্র্যে
এই অরণ্যের অনেক গাছের শিকড় ও কাণ্ডের দৈর্ঘ্য প্রায় সমান। জল-কাদায় সোজাভাবে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য রয়েছে ঠেস মূল বা স্টিল্ট রুট। অনেক গাছের মূল মাটির তলায় না গিয়ে নোনা মাটির উপরের দিকে খোঁচা-খোঁচা হয়ে উঁচিয়ে থাকে। এদের বলে শ্বাস মূল বা ব্রিদিং রুট। স্থানীয় ভাষায় বলে শুলো। ম্যানগ্রোভের (Mangrove-forest) এই শিকড়বাকড় দারুণভাবে ভূমিক্ষয় রোধ করে। এই বাদাবনে শিকারের সময় ছুটন্ত হরিণ বা বন্য শুয়োর ধরতে গিয়ে অনেক সময় বাঘেদের পায়ের নখ ভেঙে যায়। পায়ের তলায় শ্বাস মূল ঢুকে যায়। অনেক গাছের বীজ জলে পড়ে যাতে নষ্ট না হয়ে না যায় তার জন্য গাছে থাকাকালীন বীজ অঙ্কুরোদ্গমের বিশেষ ব্যবস্থা আছে। এর নাম জরায়ুজ অঙ্কুরোদ্গম বা ভিভিপেরাস জারমিনেসন। সুন্দরবনের অরণ্যে প্রায় ৮৬টি প্রজাতির বৃক্ষ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে সুন্দরী, গরান, গর্জন, কেওড়া, বাইন, হেঁতাল, গোলপাতা, গেঁওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আরও পড়ুন- মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় আরও কিছু পদক্ষেপ
প্রাণী বৈচিত্র্যে
প্রাণী বৈচিত্র্যেও সুন্দরবন অনন্য। প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে বাঘ ছাড়াও চিতল হরিণ, বন্য শুয়োর, নানা প্রজাতির বানর, জংলি বিড়াল, মেছো বিড়াল, লেপার্ড বিড়াল, গাঙ্গেয় শুশুক ইত্যাদি। এখানে প্রায় ১৮০ প্রজাতির পাখি এবং ৮০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির আনাগোনা রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে নানান ধরনের বক, হাঁস, মাছরাঙা, পানকৌড়ি, শ্বেতসিন্ধু ঈগল, মেছো বাজ, নানা ধরনের হেরন, ধনেশ ইত্যাদি। আছে নানান ধরনের সমুদ্রের কচ্ছপ, মোহনার কুমির, তার্কেল, গোসাপ, নানা ধরনের সাপ— যেমন কেউটে, শঙ্খচূড়, ময়াল, কালাজ, শাখামুর্টি ইত্যাদি। প্রায় ১২০ প্রজাতির মাছ সুন্দরবনে পাওয়া যায়। এখানে মাডস্কিপার নামে এক ধরনের মাছ পাওয়া যায়। এরা জোয়ারের সময় জলে নেমে যায় আর ভাটায় ডাঙায় উঠে আসে। অমেরুদণ্ডী প্রাণীও প্রচুর যেমন ২২ রকমের বৈচিত্র্যময় চিংড়ি, ৪৮ প্রজাতির কাঁকড়া, গেছো শামুক, নানান প্রজাতির কীটপতঙ্গ, মৌমাছি ইত্যাদি সুন্দরবনের প্রাণী-সম্পদকে বৈশিষ্ট্যময় করে তুলেছে।
যারা অবলুপ্ত
গত একশো বছর আগেও এক-শিং গণ্ডার, জলহস্তী, জলাভূমির হরিণ, ওয়াটার বাফেলো, ঘড়িয়াল ইত্যাদির প্রাচুর্য ছিল। কিন্তু আজ বাঘ ছাড়া ওইসব প্রাণীর আর দেখা মেলে না। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকেও এখানে হাতির প্রাচুর্য ছিল বলে জানা গেছে।
ম্যানগ্রোভের আশ্রয়
১৯৮৪ সালে সুন্দরবনকে জাতীয় উদ্যান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এই অরণ্যের পরিবেশ ও জীবমণ্ডলকে সংরক্ষণের জন্য ১৯৮৫ সালে জীব-পরিমণ্ডল বা বায়োস্ফিয়ার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। পৃথিবীর সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখতে প্রকৃতির নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। সমুদ্রের জলতল বৃদ্ধি এবং সামুদ্রিক ঝড়ের হাত থেকে দ্বীপগুলিকে রক্ষা করে সেই এলাকার বনভূমি। কিছুদিন আগেও সুন্দরবন এলাকার বাদাবন আয়লার কবল থেকে কলকাতাকে অনেকাংশেই বাঁচিয়েছে। ২৪ পরগনার বিভিন্ন ব্লকের নদীবাঁধের পাশে জেগে থাকা প্রাকৃতিক প্রাচীর সুরক্ষা দিচ্ছে আশপাশের শত-শত গ্রামকে। কিন্তু দুঃখের কথা আজও সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ (Mangrove-forest) বা বাদাবন সমানেই ধ্বংস হচ্ছে নানান কারণে। গ্রাম সংলগ্ন বাদাবন যা স্বাভাবিক ভাবে জন্মেছে বা নানা প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে তাদের সঠিক সংরক্ষণে ঘাটতি রয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় ওড়িশার কেন্দ্রপাড়া জেলার প্রহরাজপুরের বাসিন্দারা ১৯৭৫ সালে উপকূল অঞ্চলের বাদাবন তৈরি করেন। ফলে ১৯৮২ সালে সেভাবে সুপার সাইক্লোন তাদের ক্ষতি করতে পারেনি। কিন্তু পাশের গ্রাম সুনদ্রিখাল ও পেন্টাগ্রামে বাদাবন নেই। সেখানকার বেশিরভাগ ঘরই ধুয়ে-মুছে শেষ হয়ে গেছে। সেই থেকে প্রহরাজপুরের বাসিন্দরা বনরক্ষা কমিটি তৈরি করে বাদাবন তৈরিতে আরও জোর দেন। গ্রামবাসীদের নিজেদের তৈরি বাদাবন থেকে কাঠ-মধু-ফল সবই পাচ্ছেন। এই ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ওড়িশা উপকূলের বহু গ্রামই বাদাবন তৈরি করে চলেছে। আমাদের রাজ্যেও ১৯৮৯-’৯০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০০ হেক্টর জমিতে কৃত্রিম ম্যানগ্রোভ বন (Mangrove-forest) তৈরি করা হয়েছে। দুর্গম অঞ্চলে আকাশ পথে ম্যানগ্রোভ গাছের বীজ ছড়ানোর ব্যবস্থা হয়েছে। বিভিন্ন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিবিধ কারণে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। যেহেতু বাদাবন আমাদের ঢালের মতো আগলে রাখে, প্রাণ দিয়ে ম্যানগ্রোভ অরণ্য রক্ষা করা এবং কৃত্রিম বাদাবন তৈরিতে বিশেষভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন।