১২ জুন, ২০২৩। তিনটে ঘটনা প্রকাশ্যে। মোদি সরকারের বুকনি আর বাস্তব অবস্থার ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে পড়ল সত্যিকার বেড়ালটা। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ‘আসলি হকিকত’।
‘মালয়লা মনোরমা’র প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছে কো-উইন প্ল্যাটফর্ম থেকে তথ্য ফাঁস হওয়ার সংবাদ।
জ্যাক ডোরসে, ট্যুইটারের প্রাক্তন সিইও একটি সাক্ষাৎকারে জানালেন কৃষক আন্দোলন চলার সময় কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন ট্যুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার জন্য ট্যুইটার (Twitter) কর্তৃপক্ষকে হুমকি দেয়।
ওই দিনেই কেন্দ্রের ইলেকট্রনিক ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রক শুরু করল দু-দিনের গ্লোবাল ডিপিআই সামিট। ডিপিআই-এর অর্থ ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার।
‘মালয়লা মনোরমা’য় প্রকাশিত সংবাদের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিল কেন্দ্রের দুটি মন্ত্রক, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক এবং ইলেকট্রনিক ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক বলল খবরটা ‘ক্ষতিকারক’ (Mischievous) আর রাজীব চন্দ্রশেখর বললেন, ওসব আগেভাগে চুরি যাওয়া তথ্য। বিকেলে প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো একটি বিস্তারিত বিবৃতিযোগে জানাল, স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কো-উইন পোর্টাল সম্পূর্ণ নিরাপদ। তথ্যগুলোয় গোপনীয়তা সুরক্ষিত রাখার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
মোদ্দা কথা উদ্বেগের কিছুই নেই। কিন্তু শাক দিয়ে মাছ ঢাকা আর কতদিন চলবে? লোকে আর কতদিন সরকারের মুখের কথায় আস্থা রাখবে?
অগাস্ট, ২০২২। কর্মচারী ভবিষ্যনিধি সংগঠন (ইপিএফও)-এর তথ্য চুরি হয়েছিল।
নভেম্বর, ২০২২। অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস (এইমস)-এ র্যা নসাম ওয়্যারের হানার ঘটনা ঘটেছিল।
এ-ধরনের ঘটনার তদন্তভার অর্পিত হয় কম্পিউটার এমার্জেন্সি রেসপন্স টিম (CERT-In)-এর ওপর। ওই সংগঠন সদা নীরব থাকে, ফলে জনসমক্ষে তদন্তের অগ্রগতি-সংক্রান্ত কোনও তথ্য আসে না। ফলে উল্লিখিত ঘটনাগুলির তদন্ত এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে, কেউ জানে না, ফলে, জনগণের আস্থা এক্ষেত্রে সরকারের ওপর নেই বললেই চলে। এর পর, বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো রয়েছে ন্যাশনাল সাইবার সিকিওরিটি স্ট্র্যাটেজি। ডিসেম্বর, ২০১৯-এ এর খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য পরামর্শ চাওয়া হয়। আজও সে-কাজ সম্পন্ন হয়নি।
২০২২-এ আনা হয়েছিল ডিজিটাল পার্সোনাল ডেটা প্রোটেকশনের প্রস্তাবিত খসড়া। ইলেকট্রনিক্স ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রক এই খসড়া এনেছিল। তাতে সরকারি সংস্থাগুলোকে তথ্য সংরক্ষণের আওতার বাইরে রাখা হয়। কোনও আইনি দায়বদ্ধতা নেই। তারই পরিণতিতে রেলযাত্রী পোর্টাল থেকে তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার অভিযোগ শোনা যায় ২০২০, ২০২২ এবং ২০২৩-এ।
এই তথ্য ফাঁসের অভিযোগ বারংবার ওঠায় কয়েকটা বিষয় দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যায়।
প্রথমেই প্রশাসনিক দুর্বলতার প্রসঙ্গটা উঠে আসবে। যে ডিপিআই সামিট হল সেই ডিপিআই-এর আওতাভুক্ত আধারের বায়োমেট্রিক সিস্টেম, আরোগ্য সেতুর কনট্যাক্ট ট্রেসিং প্রসেস, কো-উইন টিকাদান পদ্ধতি, সরকারের আমাজন-এর কেতায় তৈরি বাজারে GEM অর্থাৎ গভর্নমেন্ট ই-মার্কেটপ্লেস। লক্ষণীয়ভাবে, আধার ছাড়া এগুলোর কোনওটারই আইনি বৈধতা নেই। ভারতের সংবিধান প্রণীত আইন আধার ব্যতীত এগুলোর কোনওটারই পরিধি, ভূমিকা, দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেয়নি।
‘আধার’-এর হাল আমাদের সকলেরই জানা। তথ্যগত অসম্পূর্ণতা ‘আধার’কে কীভাবে পদে পদে বিড়ম্বিত করছে। সেটা অমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি। কোভিড প্রতিরোধে আরোগ্য সেতুর অপরাঙ্গমতার কথাও আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার সূত্রেই অবগত আছি। জি-ইএম-এর বিষয়ে সাপ্লায়রদের অযুত সংখ্যক অভিযোগ রয়েছে। সুতরাং, ডিপিআই-এর জনসেবায় দক্ষতা যে কত, তা সর্বস্তরেই বেশ মালুম হচ্ছে। কিন্তু উল্লিখিত সব ক’টি প্ল্যাটফর্মেই হানা দিয়েছে তথ্য-হাঙররা। সব ক’টি প্লাটফর্ম থেকেই নাগরিকদের তথ্য ফাঁস হয়েছে।
লিথুয়ানিয়ার নর্ড সিকিউরিটির নর্ড ভিপিএন একটা সমীক্ষা চালিয়েছিল। সেই সমীক্ষার ফলে উঠে এসেছিল এক ভয়ানক তথ্য। বট মার্কেট বা তথ্যের চোরাবাজারে বিকোচ্ছে ভারতের ছয় লক্ষাধিক তথ্য। প্রত্যেকটি তথ্যের গড় দাম
৫.৯৫ মার্কিন ডলার, ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪৯০ টাকা। এই তথ্যের মধ্যে আছে ব্যবহারকারীদের লগইন, কুকিজ, ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট, স্ক্রিনশট-সহ আরও নানাবিধ তথ্য। অর্থাৎ কেবল ব্যক্তগত সংবাদ নয়, তার সঙ্গে বেচাকেনা চলছে আরও বহুবিধ জিনিসের। ২০২৮ থেকে এই বট বাজার কার্যকর।
১৪ ডিসেম্বর, ২০২২-এ রাজ্যসভায় জিরো আওয়ারে সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় জানিয়েছিলেন, ৬ লক্ষ ভারতীয়ের তথ্য ৪৯০ টাকা দরে আনলাইনে বট মার্কেটে বিক্রি হয়েছে। এজন্য শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি তোলেন তিনি।
এরও আগে ডিসেম্বর ২০১৭-তে সুখেন্দুবাবুই রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে সরকারকে জানান আধার কার্ড থেকে নাগরিকদের সংবেদনশীল তথ্য চুরি হয়ে যাচ্ছে। দেশের নিরাপত্তার পক্ষেও সেটা শুভলক্ষণ নয়।
সরকার সেদিন এসব তথ্য ও সংবাদে কর্ণপাত করেনি। অভিযোগ আশঙ্কাগুলো সেদিন বধির কর্ণে পতিত হয়েছিল।
এখনও শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইছে। সবকিছু অপপ্রচার বলে ধামাচাপা দিতে চাইছে।
সুতরাং, মোদিজির আরও একাধিক ‘গুলবাজি’র মতো নিশ্ছিদ্র, নিরাপদ, সুরক্ষিত ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ভাবনা-চিন্তা-স্বপ্ন একটি বৃহৎ ‘গুল’-এ পরিণত হতে চলেছে।
এই সরকারের হাতে মানুষের জীবন ও তথ্য, কোনওটাই নিরাপদ নয়, ২০২৪-এ এই মোদি সরকারকে বিদায় করা দরকার।
আরও পড়ুন: দীর্ঘ টালবাহানার পর ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিল্লি পুলিশের