বাংলা প্রবাদে রয়েছে ‘কীসের বার কীসের তিথি, আষাঢ়ের সাত অম্বুবাচী।’ এই দিন থেকেই শুরু হয় অম্বুবাচী। এই নিয়ে জ্যোতিষ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, সূর্য যেদিন যে সময়ে মিথুন রাশিতে গমন করে, তার পরবর্তীতে সেই বারের সেই কালেই হয় অম্বুবাচী। আধ্যাত্মিক সাধকেরা বলেন, পৃথিবী এই সময়ে ঋতুমতী হন। পৌরাণিক যুগেও পৃথিবীকে ধরিত্রী মাতা বলা হয়েছে। আষাঢ় মাসের মৃগশিরা নক্ষত্রের চতুর্থ পদে ঋতুমতী হন ধরিত্রী।
আরও পড়ুন-নির্জনতা ছড়িয়ে রয়েছে অক্ষরের ভাঁজে-ভাঁজে
আর এই ‘অম্বুবাচী’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘অম্বু’ বা জল। এ ছাড়াও বলা হয় ‘রজোযুকক্ষ্মাম্বুবাচী’। কালসাধকেরা, পৃথিবীকে এই সময়ে ঋতুমতী হিসেবে কল্পনা করে। আষাঢ় মাসের প্রথম ৬ দিন ৪০ দণ্ডে মৃগশিরা নক্ষত্রের শেষ দুই পাদে সূর্যের ভোগ হয়। ‘অম্বুবাচী’ একটি কৃষি-প্রধান অনুষ্ঠান। এই অম্বুবাচীর পর থেকেই পৃথিবীর উর্বরতা বাড়ে। রজস্বলা হলে নারীও উর্বরা হয়। মায়াবতী হয়। নিরয়ান পঞ্জিকা মতে, আষাঢ় মাসের প্রথম ছ’দিন চল্লিশ দণ্ডে মৃগশিরা নক্ষত্রের শেষ দুই পাদে সূর্যের ভোগ হয়। তার পরে যে তিনদিন বিশ দণ্ড পর্যন্ত সূর্য আর্দ্রা নক্ষত্রের প্রথম পাদে থাকেন, তা-ই অম্বুবাচী। সূর্যের দক্ষিণায়নের দিন থেকে তিনদিন অর্থাৎ, আষাঢ় মাসের ৭ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত দিনগুলিতে অম্বুবাচী পালন করা হয়। এই সময় মাটি কর্ষণ বারণ। তাই কৃষকরা এই সময়ে কৃষিকাজও বন্ধ রাখেন। অম্বুবাচী উপলক্ষে বাংলার কৃষকেরা ঘরে-ঘরে পিঠে-পায়েস তৈরি করে। এই অনুষ্ঠান বিধবা মহিলারা তিনদিন মানত রেখে পালন করেন। অম্বুবাচীর আগের দিন রান্না করে পরের তিনদিন সেইসব পান্তা খাবারই খান। উনুন জ্বালানো নিষেধ এই সময়।
আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামে ফের বিজেপিতে ভাঙন, উন্নয়নের প্রচার গ্রাম থেকে গ্রামে, বাংলা জুড়ে তৃণমূল ঝড়
বাংলার কোথাও কোথাও সূর্যের তাপে খাবার গরম করে নেওয়ার প্রথাও প্রচলিত রয়েছে।
অসমের শক্তিপীঠ কামরূপ কামাখ্যায় এই তিনদিন পুজোপাঠ হয়। তান্ত্রিকরা নানা উপাচারে ব্যস্ত থাকেন। এই অম্বুবাচীতে সমস্ত দেবীর মন্দির বন্ধ থাকে কামাখ্যায়। আশ্চর্যের কথা হল, কামরূপ কামাখ্যায় মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে এই সময় একটি লাল তরল বের হয়। ভক্তরা তাঁকে মায়ের ঋতুস্রাবের রক্ত বলে অভিহিত করে। শক্তির এই যাপনই আধ্যাত্মিক যাপন।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর সভা ঘিরে উন্মাদনা কোচবিহারে, জনসভা করবেন জলপাইগুড়িতেও
বাংলায় অম্বুবাচী একটি ধর্মীয় আচার হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের প্রাচীন কৃষি পদ্ধতির নানান রীতিনীতি। আষাঢ় মাসের শুরুতে পৃথিবী যখন বর্ষার জলে সিক্ত হয়ে ওঠে তখন তাঁকে ঋতুমতী বলে মনে করা হয়। এরপরই তিনি হয়ে ওঠেন শস্য শ্যামলা, সুজলা সফলা।
প্রাচীন কৃষি-নির্ভর আচার ‘অম্বুবাচী’, যার আধ্যাত্মিক দেহযাপনের ব্যাখ্যা রয়েছে। মেয়েরা রজস্বলা হলেই সন্তান ধারণ করতে পারে। তবে সে-সময়ে তাকে মিলনযাপনে যেতে হয়। বসুমতীকেও সেই রূপেই কল্পনা করা হয়। এই সময়ে তাঁকে তিনদিন বিশ্রাম দেওয়া হয়। চাষিরা ওই তিনদিন কোনও কৃষিকাজ করেন না। মাটিকে এই সময় কল্পনা করা হয় গর্ভবতী নারীর রূপ। গর্ভবতী নারীকে দেহমিলনে এই সময় যাওয়া বারণ। অম্বুবাচীর তিনদিন ধরিত্রীর ঋতুকাল ধরে নিয়ে চাষ থেকে বিরত থাকেন তাঁরা। তাঁরা মনে করেন, এই তিন দিন বর্ষার জলে সিক্ত হয়ে ধরিত্রী চাষের উপযোগী হয়ে উঠবে। রসবতী হবে মাটি। গর্ভবতীও। মাটির ভিতর জন্ম নেবে দেহ।
আরও পড়ুন-বিজিপিএমের দাপটে ছন্নছাড়া বিজেপি
এই ক্ষেত্রে উর্বরতাকেন্দ্রিক ভাবনায় নারী এবং ধরিত্রী যেন সমার্থক হয়ে ওঠে ভাবজগতের মানুষের কাছে। অম্বুবাচীর আগের দিনটিকে বলা হয় ‘অম্বুবাচী প্রবৃত্তি’। তিনদিনের পরের দিনটিকে বলা হয় ‘অম্বুবাচী নিবৃত্তি’। এর পরেই চাষিরা আবার চাষআবাদ শুরু করতে পারেন। দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের প্রায় প্রতিটি গ্রামে এই ধর্মীয় আচার মহাসমারোহে প্রচলিত। অম্বুবাচী উপলক্ষে দক্ষিণবঙ্গের অনেক গ্রামে মেলাও বসে। পুজো হয় ধরিত্রীর।
যে তিনদিন অম্বুবাচী পালন করা হয় সেই দিনগুলিতে কোনও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান, যেমন— গৃহপ্রবেশ, বিবাহ, উপনয়ন অনুষ্ঠিত হয় না। শুধু তা-ই নয়, কিছু কাজ কঠোর ভাবে করা বারণ। যেমন, বেদ পাঠ, ভূমি কর্ষণ, বীজ বপন, দেব-পিতৃ তর্পণ। এই সময় ধরা অশুচি থাকে। অম্বুবাচী উপলক্ষে গ্রামবাংলার বিধবা মহিলারা তিনদিন ধরে বিশেষ ব্রত রাখেন। আবার এই সময়ে যাঁরা ব্রহ্মচর্য পালন করেন, তাঁরা কোনও আমিষ খাবার খান না। ফলমূল খেয়ে ব্রত উদযাপন করেন।
আরও পড়ুন-বিজিপিএমের দাপটে ছন্নছাড়া বিজেপি
বাংলার পাশাপাশি অন্য প্রদেশেও ‘অম্বুবাচী ব্রত’ প্রচলিত রয়েছে, প্রাচীন আচারে। পার্শ্ববর্তী রাজ্য ওড়িশাতে এটি ‘রজ উৎসব’ নামে পালিত হয়। এই সময়ে কৃষকেরা ছুটি উৎসব পালন করেন। মেয়েদের কৃষি, গৃহকর্ম থেকে পুরোপুরি বিরত রাখা হয় এই সময়ে। অম্বুবাচীর দিনগুলি তাঁদের কাছে বিশ্রামের দিন। এই সময়ে তাঁরা নতুন জামা-কাপড় পরেন। সিঁদুর-আলতায় সুসজ্জিত হন।
বাংলার বহু গ্রামে ‘মিথুন সংক্রান্তি’ বা ‘রজ পর্ব’ নামে পরিচিত এই উৎসব। তিনদিনের প্রথম দিনটিকে বলা হয় ‘পহিলি রজো’। দ্বিতীয় দিন থেকে মিথুন মাস শুরু হয়। যাকে বর্ষার প্রারম্ভও বলে। পুরাণ মতে, ভূদেবী এই সময় রজস্বলা হন। তৃতীয় দিনটি হল ‘ভূ দহ’ বা ‘বাসি রজো’। চতুর্থ দিনে বসুমতী স্নান। এই সময় ধরিত্রী মা বা ভূদেবীর স্নান হয়। ভূদেবী হলেন জগন্নাথের স্ত্রী। পুরীর মন্দিরেও জগন্নাথের পাশে রুপোর ভূদেবীর মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। সেখানেও এই রীতি মানা হয়।
আরও পড়ুন-বিরোধীরা আদালতেই থাকুন মানুষ থাকবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে
অম্বুবাচীকে কেন্দ্র করে প্রধান উৎসবটি হয় গুয়াহাটির কামাখ্যা মন্দিরে। মন্দিরের গুহা আকৃতিবিশিষ্ট মাঝের কক্ষে কোনও মূর্তি নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের বিশ্বাস, বছরের এই সময়ে দেবী কামাখ্যা ঋতুমতী হন। তাই অম্বুবাচীর সময়ে তিন দিন মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে। দেবী দর্শন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অম্বুবাচী নিবৃত্তির দিন দেবীর স্নান এবং পুজো শেষ হওয়ার পরে দর্শনের অনুমতি মেলে। এই দিনই মন্দিরের পান্ডারা আগত ভক্তদের উদ্দেশে লালবর্ণের বস্ত্র উপহার দেন। কথিত আছে, এই লালবস্ত্র ধারণ করলে ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ হয়। আবার এই দিন থেকেই মন্দিরের চারপাশে খোল-করতাল সহযোগে শুরু হয় কীর্তন।
আরও পড়ুন-দিনে ও রাতে বিদ্যুৎ খরচ আলাদা হচ্ছে
অম্বুবাচীকে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় ‘অমাবতী’ও বলা হয়। হিন্দু শাস্ত্রে পৃথিবীকে বলে মা। বৈদিক আর পুরাণকালে পৃথিবীকে মাদার আর্থ বলা হত। তারপরে দেখা যায় যে পৃথিবী আমাদের মা, কারণ এখানে কেবল আমাদের ফুল, পাখি, গাছপালা রয়েছে। এককথায়, আমরা সবাই এই মায়াবিশ্বের শিশু। মহাজাগতিক অর্থে, পৃথিবী সূর্যের মিথুনচিহ্নে থাকা দিন থেকেই বর্ষাকাল শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয়। মেয়েদের যেমন ঋতুস্রাব হয় এবং তার পরেই গর্ভধারণে তাঁরা সক্ষম হন। একইভাবে প্রতি বছর এই তিনদিন অম্বুবাচীকে বিশ্বের ঋতু হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
বর্ষাকালে সিক্তা পৃথিবী নতুন বছরে নতুন ফসল উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। আষাঢ় মাসের শুরুতে, যখন পৃথিবী বা বসুমতী মাতা নতুন বৃষ্টির জলে ভিজে যান, তখন তিনি ঋতুস্রাবকারী মহিলা হিসাবে বিবেচিত হন এবং অম্বুবাচী শুরু হয়, যা বাগ্দানের ঠিক তিনদিন পরে শেষ হয়।