সৌপ্তিক বন্দ্যোপাধ্যায় : দশেরা, অর্থাৎ দুর্গা দশমী। বাঙালিদের দেবী বিসর্জনের দিন আর উত্তর ও মধ্য ভারত-সহ অন্যত্র এই দিন রাবণ বধের। মহাধুমধামে পালিত হয় দিনটি। কিন্তু আমাদের দেশেরই এক অঞ্চলে তা পালিত হয় টানা ৭৫ দিন ধরে। অবাক হওয়ার মতোই বিচিত্র এই বিশাল সময়ব্যাপী উৎসব।
ছত্তিশগড় রাজ্যের বস্তার জেলা। এখানকার দন্তেওয়াড়ায় দশেরা পালিত হয় ৭৫ দিন ধরে। প্রচলিত প্রথা মেনে প্রায় ৬০০ বছর ধরে এমন ভাবেই পালিত হয়ে আসছে এখানকার দশেরা। বস্তার জেলার এই দশেরা উৎসব পালিত হয় আড়াই মাস ধরে, যা বিশ্বের দীর্ঘতম দশেরা উৎসব। অগাস্টে হরিয়ালি উৎসবের সময় শুরু হয়ে অক্টোবরে বিজয়া দশমীর দিন শেষ। বস্তারের দশেরাতে দেশের অন্যান্য জায়গার মতো রাবণ দহন করা হয় না। যে দেবীকে কেন্দ্র করে এই ৭৫ দিনব্যাপী দশেরা উৎসব পালিত হয় তিনি হলেন মা দন্তেশ্বরী দেবী। রাবণ দহনের বদলে দশেরার দিন বেরোয় সুসজ্জিত রথ।
আরও পড়ুন-রায়পুরে বিশেষ সেনা ট্রেনে বিস্ফোরণ, জখম ৬ জওয়ান
বস্তারের দন্তেওয়ারাতে শঙ্খিনী ও ডঙ্কিনী নদীর সঙ্গমস্থলে মা দন্তেশ্বরী বিরাজমান। ইনি বস্তার রাজবংশের কুলদেবী। তন্ত্র চূড়ামণি অনুসারে ৫২ শক্তিপীঠের একটি পীঠ হল এই দন্তেওয়াড়া। বলা হয়ে থাকে এখানে মা দন্তেশ্বরীর দাঁত পড়েছিল। মা দন্তেশ্বরীকে আবাহন ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের উৎসবই হল বস্তারের দশেরা। ৬০০ বছরের পুরনো এই দশেরা উৎসব আজও পরম্পরা মেনে পালিত হয়ে আসছে। হরিয়ালি অমাবস্যার দিন পাটাযাত্রা প্রথার মাধ্যমে বস্তার দশেরা শুরু হয়। আশ্বিন শুক্লপক্ষের প্রথম থেকে ১৫ দিনে ১২টিরও বেশি নানারকম প্রথা পালিত হয়। আজও দশেরা উৎসবের প্রস্তুতির জন্য গ্রামে-গ্রামে নিয়ম মেনে নাজির, পূজারি, কোতোয়াল, পটেল, নায়েকদের দশেরা উৎসবে অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।
জনশ্রুতি আছে, বস্তারের চালুক্য বংশের রাজা হয়রাজদেবের পুত্র পুরুষোত্তমদেব একবার পুরীতে শ্রী জগন্নাথদেবের মন্দির পদব্রজে যাত্রা করেন। সেখানে এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা ও বস্ত্র দান করেন। এরপর জগন্নাথদেব তাঁর এক ভক্তকে স্বপ্নাদেশ দেন যে পরম ভক্ত পুরুষোত্তমদেবকে রথপতি উপাধি দিতে হবে এবং ১২ চাকার রথ দান করতে হবে। পুরুষোত্তমদেব রথপতি উপাধি নিয়ে সেই রথে চড়ে ফিরে আসেন বস্তারে। সেই থেকে দশেরার সময় রথ চালানোর প্রথা শুরু হয়। ১২ চাকার রথ চালানো অসুবিধা বলে দশেরার সময় দুটি রথ চালানো হয়। একটা চারচাকা ও অন্যটি আট চাকার।
আরও পড়ুন-তোলাবাজ মোদি সরকার : চিদম্বরম
যে প্রথা দিয়ে বস্তার দশেরা শুরু, তা হল পাটাযাত্রা। হরিয়ালি অমাবস্যার দিন টুবলু খোটরা নামের গাছের কাঠ জগদলপুর রাজমহলের পাশে দন্তেশ্বরী মায়ের মন্দির প্রাঙ্গণে এনে পুজো করা হয়। তারপর এই কাঠ দিয়ে জগদলপুরের কারিগররা রথ বানানো শুরু করেন।এই পাটাযাত্রা প্রথায় কালো ছাগল ও মাগুর মাছ বলি দিয়ে সেই রক্ত কাঠের গায়ে লাগিয়ে তারপর রথের চাকার মাঝে ছিদ্র করা হয়। এই প্রথাকে বলে নারকর্ণী। বস্তার দশেরার পরবর্তী পর্ব হল ডেরি গাদাই-এর প্রথা। কাঠের দুটি খণ্ড পুজো করে সেগুলি ভূমিতে স্থাপন করা হয়। এর পরবর্তী প্রথার নাম কাছিন গদি। এই প্রথা পালিত হয় কাছন গুড়ি নামক স্থানে। এই প্রথায় কাছিন দেবীকে সিংহাসন বা গদি দিয়ে আহ্বান করা হয়। এই দেবীর সিংহাসন তৈরি হয় বেলের কাঁটা দিয়ে ঝুলা বা দোলনা বানিয়ে। কাছিন দেবী বস্তারের মৃগান জাতির কুলদেবী। প্রতিদিন আলাদা আলাদা জনগোষ্ঠীর মানুষ রথের রশি টেনে থাকেন। বস্তার দশেরার একটি প্রথা হচ্ছে ভিতর রাইনি ও বাহার রাইনি প্রথা। বিজয়া দশমীর দিন সকালে ভিতর রাইনির পুজো করা হয়। সন্ধের সময় সিরহাসার চক থেকে আট চাকার পুষ্পসজ্জিত ৩৫ ফুটের বিশাল রথ দন্তেশ্বরী মন্দিরের দিকে আসে। হাজার হাজার আদিবাসী মানুষ যখন রথের দড়ি টানেন, তখন এক অসাধারণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আদিবাসী ভূমিপুত্রদের আবেগ জড়িত এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে।