স্বাধীনতার পূর্বের বাংলা প্রত্যক্ষ করেছিল একের পর এক জাতি দাঙ্গা। সেই দাঙ্গার সুযোগ নিয়েই, তৎকালীন রাজনীতির কারবারিরা বাংলাকে টুকরো করেছিল। বাংলার মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল দুর্ভিক্ষ, দেশভাগের যন্ত্রণা, উদ্বাস্তু হওয়ার কষ্ট। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলা হঠাৎই পিছিয়ে পড়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে। বাড়তে থাকে দারিদ্র্য। ফলে, জাতি দাঙ্গার ফল কী হতে পারে তা ভালভাবেই জানেন এই বাংলার মানুষ।
আরও পড়ুন-৩২ হাজার চাকরি বাতিল নয় : কোর্ট
স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরে এসে ফের একবার অসাধু শক্তি চেষ্টা করছে বাংলার ভিতর রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করার। যে বাংলার মাটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-নজরুল ইসলামের নাম এক সঙ্গে উচ্চারিত হয়, সেখানেই ধর্মের ভিত্তিতে, জাতির ভিত্তিতে নিজেদের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থকে চরিতার্থ করতে, কিছু মানুষ নেমে পড়েছেন ময়দানে। কখনও সিপিআইএমের প্রত্যক্ষ মদতে আইএসএফের মতো একটি রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বিপথে চালনা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অপর দিকে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বে পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্স অঞ্চলে এবং পশ্চিমাঞ্চলে জঙ্গলমহলের কিছু জনগোষ্ঠীকে দিয়ে বাংলাকে অশান্ত করার চক্রান্ত চলছে।
আরও পড়ুন-আজ পঞ্চায়েত ভোট, উন্নয়নই প্রধান অস্ত্র তৃণমূলের
তথ্য ও পরিসংখ্যান বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে যতগুলি সরকার বাংলায় গঠিত হয়েছে তার মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের আমলেই বাংলায় সংখ্যালঘু নাগরিকদের সার্বিক জীবনযাত্রার সবচেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবেও বাংলার সংখ্যালঘুরা অনেক এগিয়েছেন ১২ বছরে৷ হাই মাদ্রাসা, আলিম ও ফাজিল থেকে শুরু করে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক বা স্নাতক-স্নাতকোত্তর স্তরেও সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা রেকর্ড হারে বেড়েছে। ‘ঐক্যশ্রী’র স্কলারশিপ সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে গবেষণা ক্ষেত্রে এগিয়ে দিচ্ছে৷ অথচ সিপিআইএমের জোট সঙ্গী আইএসএফ, সেই সমস্ত কিছুকেই অগ্রাহ্য করে স্রেফ ধর্ম বা জাতির ভিত্তিতে রাজনীতির ফায়দা তোলার জন্য মরিয়া।
আরও পড়ুন-এজেন্টরা যা করবেন
আশার কথা, এই দুষ্ট চক্রান্তকে পরাস্ত করতে বাংলার সংখ্যালঘু নাগরিকদের মধ্যে থেকেই আওয়াজ উঠছে। শিক্ষিত সংখ্যালঘু নাগরিকদের সিংহভাগই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপরেই আস্থা রাখছেন। তাঁরা বুঝতে পারছেন, বাংলার বাইরে উত্তরপ্রদেশ-মধ্যপ্রদেশ-সহ প্রত্যেকটি বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে কীভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন চলছে। সংখ্যালঘুদের খুন-ধর্ষণ থেকে ঘর-বাড়ি ‘বুলডোজার’ দিয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে সেখানকার বিজেপি সরকার! অথচ, আইএসএফ বা সিপিআইএমের নেতৃত্ব সামান্য প্রতিবাদটুকু করেন না। বিজেপি নেতাদের নির্দেশেই মুখ বন্ধ রাখেন। আবার জাতির নামে বাংলাকে ভাগের চক্রান্ত করছে বিজেপিও। স্থানীয় জনজাতির কিছু মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বাংলা ভাগের ডাক দিচ্ছেন তাঁরা। কখনও বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তা, সৌমিত্র খাঁ, জন বার্লারা প্রকাশ্যে বাংলা ভাগের ডাক দিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা। বিজেপি-শাসিত প্রতিবেশী রাজ্যের ‘সেফ শেল্টারে’ বসে সেই সব বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা ভিডিও প্রকাশ করে বাংলার জনজাতির মানুষকে উত্তেজিত করছেন৷ উদ্দেশ্য, জাতিদাঙ্গা লাগানোর।
আরও পড়ুন-বেলডাঙায় খুন তৃণমূল কর্মী, নন্দীগ্রামে অপহৃত দলীয় প্রার্থী
এই মুহূর্তে মণিপুরের ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে গোটা দেশ। সেখানেও জাতিদাঙ্গার ফলে প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বিজেপি-পরিচালিত সেখানকার রাজ্য সরকার বা অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র দপ্তর সেই জাতিদাঙ্গাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। একই ঘটনা লক্ষ্য করবেন জম্মু কাশ্মীরেও। ২০১৯ সালে ধারা ৩৭০ বিলোপের পর কাশ্মীরকে দুটি ভাগে ভেঙে কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চল করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর দাবি ভূস্বর্গ সম্পূর্ণ শান্ত। অথচ ২০২৩-এর জুলাই মাস চলছে। প্রায় চার বছর জম্মু-কাশ্মীরে নির্বাচন করাতে পারেনি কেন্দ্রীয় সরকার। অর্থাৎ জাতি দাঙ্গা বা অশান্তি এই সব অনভিপ্রেত ঘটনার ফলে দিনের শেষে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই রাজ্যের সাধারণ নাগরিক। অতএব সাধু সাবধান! বাংলার বুকে ধর্মীয় বা জাতি বিভাজনকারী শক্তিকে সমূলে উৎপাটন করাই এই মুহূর্তে যেকোনও নাগরিকের প্রথম কর্তব্য। সেটা আইএসএফ-সিপিএম-কংগ্রেস দ্বারা হোক বা বিজেপি এবং তাদের সহযোগী কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার দ্বারা। বাংলার বুকে আদিবাসী- মূলবাসী-রাজবংশী-সংখ্যালঘু-মতুয়া বা গোর্খা-লেপচা- ভুটিয়া-সহ প্রতিটি প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের অধিকার যদি কেউ একশো শতাংশ নিশ্চিত করে থাকেন, তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটা ‘জয় বাংলা’, ‘জয় জোহারে’র মতো ‘পেনশন স্কিম’ চালু করা হোক বা জাতি শংসাপত্র প্রদান। শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘সিধু কানোহো’র নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়, ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা, মতুয়া সম্প্রাদায়ের হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ। আদিবাসী-মূলবাসী, মতুয়াদের মধ্যে জমির পাট্টা বিতরণের মধ্যে দিয়ে হোক। এমনকী বিশেষ আইন প্রণয়ন করে, আদিবাসী-মূলবাসীদের জমি জোর করে অধিগ্রহণ বা বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ার মতো দৃঢ় পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কর্তব্য করে চলেছেন। কিন্তু এতশত কার্যক্রমের পরেও যারা বাংলার বিভিন্ন জনজাতির মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়, তাদের উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট এবং বিপজ্জনক। রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও গত কয়েকদিনে তাঁর কয়েকটি বক্তব্য এবং গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকারেও এই বিপজ্জনক শক্তির দিকে আলোকপাত করেছেন। এবং বাংলার মধ্যে যে এক জাতিদাঙ্গা তৈরির বীজ রোপণ করছে কিছু বাংলাদ্রোহী শক্তি সিপিএম-আইএসএফ-কংগ্রেস এবং অবশ্যই বিজেপি সেটিও উল্লেখ করেছেন।
আরও পড়ুন-‘প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় বাহিনী কোথায়’ টুইট বার্তায় প্রশ্ন তৃণমূল কংগ্রেসের
বাংলায় গত দুশকের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ পঞ্চায়েত নির্বাচন যখন হতে চলেছে, বাংলার সাধারণ মানুষ যখন উৎসবের মেজাজে গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ উৎসবে শামিল হতে প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনই যেন এই বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি আরো বেশি করে নিজেদের নখ-দাঁত বের করছে। আর এ সবের মধ্যেই বিজেপির মুখপাত্রের মতো সেইসব রাজনৈতিক দলগুলিকে আরও ইন্ধন জোগাচ্ছেন মাননীয় রাজ্যপাল। নির্বাচন চলাকালীন যেখানে আইন-শৃঙ্খলা দেখভালের দায়িত্ব রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সেখানে ‘সমান্তরাল প্রশাসন’ চালিয়ে সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক কাজ করে চলেছেন রাজ্যপাল। ‘পিস রুম’ খোলা বা আক্রান্ত রাজনৈতিক কর্মীদের দেখতে যাওয়া রাজ্যপালের কাজ নয়। রাজভবনকে কার্যত বিজেপির কার্যালয় বানিয়ে ফেলা মাননীয় রাজ্যপালের প্রতিটি পদক্ষেপই সংবিধানের পরিপন্থী। কিন্তু বিজেপি এইটাই চায়!
আরও পড়ুন-প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য দেশদ্রোহিতা নয়, বলছে কর্ণাটক হাইকোর্ট
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এভাবেই রাজ্যপালদের রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করছে মোদি-শাহ জুটি। দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কথাই ভাবুন। প্রতিনিয়ত সেখানকার নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছেন তিনি। এমনকী সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেও। তামিলনাড়ুতেও কেন্দ্রীয় এজেন্সি দ্বারা গ্রেপ্তার হওয়া মন্ত্রীকে বহিষ্কার করে দিয়েছেন সেখানকার রাজ্যপাল। যা সম্পূর্ণ রাজ্যপালের এক্তিয়ার বহির্ভূত। কিন্তু দিল্লির মসনদে যতক্ষণ মোদি-শাহ জুটি আছে তখন কে-ই বা সংবিধানকে তোয়াক্কা করছে। ফলে বাংলাতেও একই ঘটনা আমরা দেখছি। কিন্তু যেটা ভয়ের তা হল, বাংলার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এক্ষেত্রে এক অত্যন্ত কুৎসিত উদাহরণ রাখছে। বিভিন্ন ধর্ম-জাতিগুলির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে বাংলায় এক বৃহত্তর জাতি দাঙ্গার প্রেক্ষাপট তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে সম্ভবত। এবং ভবিষ্যতে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি দেখিয়ে মাননীয় রাজ্যপালের এই ‘সমান্তরাল সরকার’কেই হয়তো বাংলার শাসনভার দেওয়ার পরিকল্পনা রচিত হয়েছে। অর্থাৎ বাংলা ভাগ এবং বাংলাকে কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চল বানিয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বাংলার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারহরণ! কিন্তু এই যে, এত পরিকল্পনা এত চক্রান্তের জাল বিস্তার এই সমস্ত কিছুই আগামী দিনে অশ্বডিম্ব প্রসব করবে বলেই ধারণা। কারণ, বাংলার মানুষ জাতিভিত্তিক রাজনীতি কোনও কালেই পছন্দ করেনি।
আরও পড়ুন-বিস্ফোরণে তৃণমূল কর্মীর প্রাণ গেল, রেজিনগরে ভীত ভোটাররা
ইতিহাস দেখলেই বুঝবেন, উনিশশো সাতচল্লিশে বাংলা ভাগের সময় দুটি দল সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। মুসলিম লিগ এবং হিন্দু মহাসভা। স্বাধীনতার পর ১৯৫২ থেকে যখন ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন শুরু হল তারপর থেকে প্রতিটি নির্বাচনে এই দুটি দল অস্তিত্বহীন হয়ে গেল। আজকেও যারা জনজাতি-ধর্ম এবং কয়েকজন বাংলা-বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে নিয়ে ভাবছেন বাংলা দখল করবে, সেই রামধনু জোটের অবস্থাও কিন্তু সেদিনের মুসলিমলিগ-হিন্দু মহাসভার মতোই হতে যাচ্ছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সময়ের অপেক্ষা।