সুব্রত বক্সি: তৃণমূল কংগ্রেস আজ মহীরুহ। আমাদের প্রাণপ্রিয় সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেত্রী তথা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিপিএমের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই আমাদের দলকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। নেত্রী আমাদের পথ দেখিয়েছেন, আমরা সেই পথে হেঁটেছি। আজ বাংলার বুকে আমরা শাসক দল। তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার গত ১২টা বছর ধরে বাংলার সব প্রান্তের, সর্বস্তরের মানুষের জন্য যে উন্নয়ন করেছে, একের পর এক সামাজিক প্রকল্প এনে বিপ্লব ঘটিয়েছে তার তুলনা গোটা দেশে নেই।
আরও পড়ুন-বৃষ্টিতেও জল দাঁড়াবে না মহানগরীতে, একুশের সভা নিয়ে পুর নিকাশি দফতরের তৎপরতা
এখন অন্যান্য রাজ্য অনুসরণ শুধু নয়, বাংলাকে অনুকরণ করে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রীর মতো যুগান্তকারী সামাজিক প্রকল্পগুলি একাধিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। সর্বভারতীয় স্তরে জনবিরোধী বিভিন্ন ইস্যুতে বিজেপি সরকারকে চেপে ধরছেন তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভা ও রাজ্যসভার সাংসদরা। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে দেশে বিজেপি বিরোধী ২৬টি বিরোধী দলকে এক ছাতার তলায় আনতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন দেশনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাটনার পর বেঙ্গালুরু বৈঠকেও নেত্রীর সক্রিয় ভূমিকা গোটা দেশের রাজনৈতিক মহলে চর্চিত হচ্ছে। বিরোধী জোটের নাম দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-মোহনবাগান মিডিয়া সেন্টার উদ্বোধনে অঞ্জন স্মরণ, এশিয়াডে যাক দল : বিজয়ন
ইন্ডিয়া (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স)। আজ দল এই জায়গায় এমনি এমনি আসেনি। এর পিছনে নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিরলস আপসহীন সংগ্রাম- অক্লান্ত পরিশ্রম যেমন আছে, তেমনই তৃণমূল কংগ্রেসের হাজার হাজার কর্মীর বলিদান রয়েছে। দলের একটার পর একটা আন্দোলন রয়েছে। নেত্রী আমাদের শিখিয়েছেন মানুষের সুখের সময় না থাকলেও বিপদে তাদের পাশে দাঁড়াতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই আদর্শ-নীতি-নির্দেশকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছি আমরা। তৃণমূল কংগ্রেস একটা বৃহত্তর পরিবার। এখন দলের অনেক শাখা সংগঠন। ছাত্র-যুবরা রয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন ছেলেমেয়েরা উঠে আসছে। তারা একদিকে যেমন প্রতিভাবান, আবার তাদের মধ্যে আগামীর নেতা-নেত্রী হওয়ার মশলাও রয়েছে। তাদের দেখে মন ভরে যায়।
আরও পড়ুন-বিশ্বকাপ ২০২৩, শাহরুখ আইসিসির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার
অল্প বয়েসেই তাদের অনেকে দারুণ বক্তা। দারুণ সংগঠক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ছাত্র রাজনীতি করে উঠে এসেছেন। তিনি নিজেও এই নতুন প্রজন্মকে উৎসাহ দেন। আমাদের কয়েকটা প্রজন্মকে তিনি হাতে ধরে তৈরি করেছেন। কাউন্সিলর-বিধায়ক-সাংসদ-মন্ত্রী করেছেন। নতুনদের নিয়েও নেত্রী আশাবাদী। আজ দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সামনে থেকে বুক চিতিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে দলকে। ওকে এইটুকু থেকে বড় হতে দেখলাম। এখন ও পরিণত রাজনীতিতে। যত সময় যাচ্ছে তত পরিণত দেখাচ্ছে অভিষেক। দলের ছাত্র-যুবরা ওর জন্য পাগল। বিরোধীরাও একযোগে অভিষেককে নিশানা করছে। ও-ও লড়ছে সামনে থেকে। এভাবেই তো এগোতে হবে আগামীর পথে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময় একটা কথা বলেন। নতুনরা যারা দলে আসছে তারা যেন তৃণমূল কংগ্রেসের ইতিহাসটা জানে। মনে রাখে। আজকের এই দিন কিন্তু শুরুতে ছিল না। নেত্রীর নির্দেশে আমি যেখানেই বক্তব্য রাখি, দু’চার কথা বলি দলের ইতিহাস নিয়ে। কেন তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি হল! এই যে ২১ জুলাইয়ের শহিদ সমাবেশই বা কেন? জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে ১৯৯৩ সালে।
আরও পড়ুন-১১টি জেলাকে ‘ভূমি সম্মান’ রাষ্ট্রপতির, গর্বিত মুখ্যমন্ত্রী
তখন ঘোর বাম জমানা। বাংলার আকাশে তখন সিপিএমের কালো মেঘ। তাদের পেশিশক্তির দাপটে কাঁপছে গোটা বাংলা। তখন ভোটের নামে চলে শুধু প্রহসন। ভোটার কার্ড বলে তখনও কিছুই নেই। তৎকালীন কংগ্রেস সভানেত্রী বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লড়ছেন সিপিএমের বিরুদ্ধে। গড়ে তুলছেন প্রতিবাদ-আন্দোলন। ১৯৯৩ সালেই নেত্রী ডাক দিলেন ‘নো আইডেন্টিটি কার্ড, নো ভোট’। সচিত্র পরিচয়পত্র-সহ ভোটের দাবিতে মহাকরণ অভিযানের ডাক দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ১৪ জুলাই মহাকরণ অভিযান হবে। কিন্তু আচমকাই তৎকালীন রাজ্যপাল নুরুল হাসান ১২ জুলাই প্রয়াত হন। রাজনৈতিক শিষ্টাচার মেনে মহাকরণ অভিযান পিছিয়ে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর একুশে জুলাই হয় সেই মহাকরণ অভিযান। ব্রেবোর্ন রোড, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ, মেয়ো রোড— একাধিক দিক দিয়ে যুব কংগ্রেসের মিছিল আসতে শুরু করে। কিন্তু কোনওরকম প্ররোচনা ছাড়াই পুলিশ গুলি চালালে ১৩ জন তরতাজা যুবক শহিদ হন। আহত হন আরও অনেকে। কোনওরকমে বেঁচে যান নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার রাজপথ তখন রক্তে লাল।
আরও পড়ুন-আজ মিডিয়া সেন্টার উদ্বোধনে বিজয়ন, মোহনবাগান দিবসে সংবর্ধনা সুনীলকে
চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়তেই স্তব্ধ হয়ে যায় কলকাতা-সহ গোটা বাংলা। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এই দিনটি রক্তে রাঙানো দিন হিসেবে থেকে যাবে চিরকাল।
এরপরই তৎকালীন বাম নেতারা বলতে শুরু করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকরণ দখল করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তা ছিল ডাহা মিথ্যে কথা। মহাকরণ অভিযানের আসল কারণ ছিল, সে-সময় সেখানে বসতেন নির্বাচন কমিশনার। সেখান থেকে পরিচালিত হত যাবতীয় নির্বাচনী কাজকর্ম। ফলে সচিত্র পরিচয়পত্র-সহ ভোটের দাবিতে সতীর্থদের নিয়ে মহাকরণ অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিপিএমের তৎকাল নেতারা রাজনৈতিক উৎসাহ ও নিজেদের ক্ষমাহীন অপরাধ ঢাকতে মিথ্যে প্রচার শুরু করে। যদিও তা ফলপ্রসূ হয়নি। সেদিনও বাংলার মানুষ ওদের বিশ্বাস করেনি। সবাই বুঝেছিল যুব কংগ্রেসের মিছিলে সিপিএমের পুলিশ বিনা প্ররোচনায় গুলি চালিয়ে ১৩ জন তরতাজা যুবককে হত্যা করেছিল।
আরও পড়ুন-আজ থেকে শুরু হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং কাউন্সেলিং
এরপর থেকেই প্রতি বছর একুশে জুলাই শহিদদিবস পালন করি আমরা। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি হওয়ার পরও যা অব্যাহত থেকেছে। যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী থাকাকালীনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, কংগ্রেসের মধ্যে থেকে সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে তিনি গোটা বাংলা জুড়ে সভা করতে গিয়ে আরও একটা বিষয় বুঝতে পারেন, প্রত্যেকটি জনসভায় প্রচুর মানুষের ভিড় হলেও তা ভোট বাক্সে প্রতিফলিত হচ্ছে না, কারণ সিপিএম তাদের পেশিশক্তি দিয়ে বাংলার মানুষের ভোটাধিকার দাবিয়ে রাখত। ভোট লুট হত অবাধে। অথচ তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বের তা নিয়ে কোনও হেলদোল ছিল না। তাঁরা তলায় তলায় সিপিএমের সঙ্গে সেটিং করে চলছেন। কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৈরি করলেন নতুন দল। ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি তৈরি হল ‘তৃণমূল কংগ্রেস’। একের পর এক ইস্যু নিয়ে বাংলার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সিপিএমের বিরুদ্ধে চলতে থাকল আপসহীন লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলন। ভয় পেতে শুরু করে সিপিএম-সহ বাম সরকার। নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর শুরু হয় ন্যক্কারজনক আক্রমণ। গোটা বাংলা জুড়ে খুন হতে থাকেন একের পর এক তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু তাতেও দমিয়ে রাখা যায়নি আপসহীন সংগ্রামের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। চলতে থাকে লড়াই-সংগ্রাম।
আরও পড়ুন-বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইলেন মণিপুর-রাজ্যপাল
এরপর সিপিএমের বিরুদ্ধে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঐতিহাসিক আন্দোলন পর্ব পেরিয়ে এসে ২০১১ সালে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে ঘটে গেল এক উলটপুরাণ। হল পরিবর্তন। বাংলার মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীদের দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন। সবুজ-ঝড়ে উড়ে গেল ৩৪ বছরের জগদ্দল পাথর হয়ে বসে থাকা সিপিএম ও বামেরা। ওরা ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গেল বাংলার মাটি থেকে। বাংলার আকাশ থেকে সরে গেল সিপিএমের কালো ছায়া। সেই পর্ব পেরিয়ে এসে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও প্রবল আর্থিক চাপের মধ্যেও মাথা উঁচু করে হেলায় হারিয়ে দিয়ে আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে।
আরও পড়ুন-জ্বলছে মণিপুর: তবু ৭৮ দিন ধরে মোদির মুখে কুলুপ, আক্রমণ তৃণমূলের
এত বছর ধরে ধর্মতলায় একুশে জুলাই শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে হয় সমাবেশ। বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সর্বস্তরের মানুষ এসে হাজির হন কলকাতার রাজপথে। কোভিডের কারণে দু’বছর এই সমাবেশ করা যায়নি। ভার্চুয়ালি করতে হয়েছে। এখন কোভিড নেই। বাংলা আবার ধর্মতলামুখী। এবছর ঐতিহাসিক জমায়েত হবে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই বিপুল জয় মানুষের মনে এক অভূতপূর্ব উচ্ছ্বাস এনে দিয়েছে। তবে এটা বিজয় সমাবেশ নয়। নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে এবার শ্রদ্ধা দিবস হিসেবে পালন করব আমরা দিনটিকে। উপস্থিত থাকবেন শহিদ পরিবারও। তৎকালীন সভানেত্রী কংগ্রেস ছাড়লেও একুশে জুলাই শহিদ সমাবেশকে তৃণমূল কংগ্রেসে এসেও পালন করে চলেছেন। কংগ্রেসের দোরগোড়ায় ছেড়ে আসেননি। নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। করছেন। আগামী দিনেও করবেন। এবারের বাড়তি তাৎপর্য, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ও জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যে বার্তা ও দিকনির্দেশ দেবেন তা নিয়ে আমরা ফিরে যাব যে যার জায়গায়। আগামী এক বছর সেই নির্দেশ পালনই হবে আমাদের অঙ্গীকার-শপথ।