১০.১৭-র ডাউন বারাকপুর লোকাল। আগের দিন অর্থাৎ ২০ জুলাই সন্ধ্যায় পার্টি অফিসে বসে সবাই মিলে ঠিক করলাম গতবারের মতো এবারেও আমরা বারাকপুর লোকালে চেপেই শিয়ালদহ স্টেশন পৌঁছব এবং ওখান থেকে মিছিল করে শহিদতীর্থ ধর্মতলায়। কথামতো আমরা নির্দিষ্ট বগিতে সবাই উঠে বসেছি, ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে, স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত পুরো ট্রেন কম্পার্টম্যান্ট, গার্ড হুইসেল বাজিয়ে দিয়েছে, ড্রাইভারের কাউন্টার হুইসেল হয়ে সবেমাত্র ট্রেন চলতে শুরু করেছে, ঠিক এই সময় দরজার দিকে নজর চলে গেল আমার, এক বয়স্ক ব্যক্তি একেবারে হুড়মুড়িয়ে আমাদের কামরায় উঠতে চেষ্টা করছেন, কোনওমতে মাঝের রডটা ধরতে পেরেছেন, গেটে দাঁড়ানো একটি অল্পবয়সি ছেলে তাঁকে জাপটে ধরে কোনওমতে ঠেলে ট্রেনের ভেতরে তুলে দিলেন। কয়েক সেকেন্ডের দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে এসে আমি সিট ছেড়ে উঠে গিয়ে ভদ্রলোকের সামনে যেতেই অবাক হয়ে গেলাম, আরে এ তো আমাদের দীপক কাকু! ইছাপুরের বাসিন্দা, একনিষ্ঠ সক্রিয় তৃণমূল কর্মী এবং মমতা দিদির অন্ধ অনুগামী। গত ডিসেম্বরে সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছিল কাকুর, দীর্ঘ দেড় মাস যমে-মানুষে টানাটানির পর সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছিল দীপক কাকু। ট্রেনে আমাকে দেখেই আমার হাতদুটো ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল— ‘বল মা, আজকের দিনে বাড়িতে বসে থাকতে পারি?’ …আমি একটু রেগে গিয়েই বললাম, এভাবে এই বয়সে কেউ ট্রেনে ওঠে? দীপক কাকুর উত্তর— ‘তোর কাকিমার সঙ্গে ঝগড়া করে কোনওমতে ইছাপুর স্টেশনে পৌঁছে দেখি আমাদের সেই ৯.৪৭-এর নৈহাটি লোকাল বেরিয়ে গিয়েছে, কী করব, সোজা অটো ধরে বারাকপুর, তারপর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছতে পৌঁছতেই দেখি ট্রেন স্টার্ট, আমিও মনে মনে মমতা দিদির নাম স্মরণ করে ঝুলে পড়লামরড ধরে, তারপর সোজা ধরা পড়লাম তোর হাতে, বাড়ির কাউকে কিছু বলিস না কিন্তু মা’… আমি উত্তরে কী বলব ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, শুধু অপলক চোখে দীপককাকুর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে নিজের মনকেই প্রশ্ন করলাম, কোন অদৃশ্য জাদু জুড়ে আছে এই একুশে জুলাইয়ের সঙ্গে যা প্রতিটি একনিষ্ঠ তৃণমূল কর্মীকে সব বাধা-বিপত্তি তুচ্ছ করে ঠিক শহিদ তীর্থে পৌঁছে দেয়? কোন অমোঘ টানে আজ এতগুলো বছর অতিক্রম করেও একুশে জুলাইয়ের (21 july) শহিদ মঞ্চের হাতছানি উপেক্ষা করতে পারে না কোনও সাচ্চা তৃণমূল কর্মী? কী আছে এই একুশে জুলাইয়ের শহিদ তীর্থে, যেখানে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় ঠেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে রোদে পুড়ে এবং শেষ পর্যন্ত বৃষ্টিস্নাত হয়ে ভিজে জামা গায়ে বাড়ি ফিরেও মন প্রশান্তিতে ভরে থাকে? দিনযাপনের সব প্রতিকূলতাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে দীপককাকুদের মতন লক্ষ লক্ষ তৃণমূল কর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী এই দিনটায় কালীঘাটের পটুয়াপাড়ার ওই বস্তির মেয়েটার আহ্বানে গুটি-গুটি পায়ে ঠিক পৌঁছে যায় ধর্মতলার শহিদ তীর্থে শহিদদের স্মৃতিতর্পণে। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্প আমরা সবাই জানি, কিন্তু এ-জনস্রোত যেন সেই রূপকথাকেও হার মানিয়ে দেয় একুশের (21 july) শহিদ তীর্থের পুণ্যভূমিতে।
আরও পড়ুন- কোনও জেট নয় একটা গোটা ট্রেনের মালিক লুধিয়ানার কৃষক! কীভাবে হল এমনটা
অশক্ত শরীরের আবেগতাড়িত স্বতঃস্ফূর্ততায় উদীপ্ত দীপককাকুকে সঙ্গে নিয়েই শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরের ক্যাম্প ছুঁয়ে আমাদের মিছিল এগিয়ে যাচ্ছিল বি আর সিং-এর সামনে দিয়ে, হঠাৎ দেখি এক মধ্যবয়সি প্রতিবন্ধী যুবক আমাদের মিছিলের সামনে রাস্তায় দুহাতে ভর দিয়ে এগিয়ে চলছে। ওর পিঠের দিকে জামার পিছনে জোড়া ফুল পতাকার লাঠি একেবারে সেলাই করে সাঁটা, দুহাতেই দুটি আধ ক্ষয়ে যাওয়া হাওয়াই চটি, যার ওপর ভর করে ছেলেটি এগিয়ে চলেছে, আর মুখে মমতাবাদের স্লোগান! শিহরিত হয়ে উঠল আমার সারা শরীর, ‘চটি পিসির’ ডাকে একুশের রাজপথে এও তো এক ‘চটি চাটা’ যুবক যার পথচলার একমাত্র সহায় সেই হাওয়াই চটি! এই ‘চটি চাটা’র মুল্য পৃথিবীর কোনও কারেন্সিতে নির্ধারণ করা সম্ভব? আমি মৌলালির কাছে এসে ছেলেটির দিকে একটা জলের বোতল এগিয়ে দিলাম, ও একটা মনভোলানো হাসি আমাকে উপহার দিয়ে বলল, ‘দিদি, এত গরম লাগছে, কিন্তু দেখো প্রতিবারের মতো এবারেও দিদি মঞ্চে উঠলেই বৃষ্টি হবে।’
(এরপর আগামিকাল)