গত চোদ্দ তারিখে অন্ধপ্রদেশের সমুদ্র-উপকূলবর্তী শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে দুপুর আড়াইটের দিকে যখন সাদা রঙের প্রকাণ্ড রকেটটি একরাশ আগুন ছড়িয়ে রওনা দেবার মুহূর্ত থেকেই কোটি-কোটি ভারতবাসীর বুকে জাগিয়ে রেখে গেল এক বুকভরা আশা— চাঁদের মাটিতে যেন এই যন্ত্রযানটি নির্বিঘ্নে নামতে পারে। ওই রকেটের সঙ্গেই জুড়ে দেওয়া রয়েছে ভারতের তৃতীয় চন্দ্রাভিযানের (chandrayaan 3) জন্য উপযুক্ত একটি যন্ত্র, যার নাম ‘প্রোপালশন মডিউল’। আর এই মডিউলের সঙ্গেই যুক্ত আছে দুটি যন্ত্র— ল্যান্ডার আর রোভার। এগুলোই অভিযানের মূল সদস্য। মার্ক-৩ (GSLV-Mk 111) নামে এই রকেটটি তৈরি হয়েছে ভারতের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন’ (ISRO)-এর উদ্যোগে।
পূর্ব অভিজ্ঞতা
এটা ভারতের তৃতীয় চন্দ্র-অভিযান (chandrayaan 3)। এর আগের দুটো অভিযান হয়েছিল ২০০৮ এবং ২০১৯-এ। দ্বিতীয় ওই অভিযানও গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছিল কারণ সেবারেও আমাদের দেশের চন্দ্রযানের নামার কথা ছিল এবারের মতো একই জায়গাতেই, যদিও ওই সময়ে শেষরক্ষা হয়নি, চাঁদের মাটিতে নামবার পরেই যন্ত্রযানটি ভেঙে পড়ে। জায়গাটা নানা কারণেই বিজ্ঞানীদের কাছে লোভনীয়। চাঁদের ওই দক্ষিণ মেরুর দিকটায়, যেখানে যথেষ্ট পরিমাণে পাথুরে বরফ রয়েছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা, সেই বিশেষ জায়গাটাতেই স্বয়ংক্রিয় এই ল্যান্ডার-রোভারের নামার কথা অগাস্টের তেইশ অথবা চব্বিশ তারিখে। এর আগে অন্যান্য দেশের যে ক’টি এরকম যন্ত্রযান চাঁদের মাটিতে নেমেছে, সেগুলোর সবই প্রায় চাঁদের মাঝামাঝি এলাকার দিকে নেমেছিল; ওগুলো ছাড়া এইরকম দক্ষিণ মেরুর দিকে যে ক’টা নামার চেষ্টা করেছে, সেগুলোর সব-ক’টাই ধ্বংস হয়েছে। কারণ ওই এলাকায় সূর্যের আলো পৌঁছয় না যথেষ্ট পরিমাণে, আর ওখানে উঁচু-উঁচু পাহাড়ের সংখ্যাও বেশি, যে কারণে যন্ত্রযানকে নিরাপদে অবতরণ করানো বেশ চাপের। সেদিক থেকেও একটা ইতিহাস তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের এই অভিযানে।
মূল যন্ত্রযানের চেহারা-পরিচয়
রকেটের সঙ্গে যুক্ত ওই মডিউলটিই বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘুরবে চাঁদের কক্ষপথে, আর ওটা থেকেই চাঁদের বুকে নামবে ওর ভেতরে থাকা দেড় হাজার কেজি ওজনের মূল ল্যান্ডার-রোভারটি। আসলে যেটা চাঁদের বুকে নেমে হেঁটে-চলে বেড়াবে, সেটাকে ধারণ করছে এই যন্ত্রটিই। এর চেহারা দেখানো হয়েছে ছবিতে। ২০১৯ সালে আগের ‘চন্দ্রযান-২’ মিশনের সময় এইরকম একটি যন্ত্রই চাঁদের বুকে নামতে গিয়েই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সেবারের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবারে এই যন্ত্রটির গঠনে আরও সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছে।
এই ল্যান্ডারটির নাম ‘বিক্রম’, ভারতের মহাকাশ গবেষণার প্রাণপুরুষ বিক্রম সারাভাই-এর নামে। আর ল্যান্ডার যে রোভার বা ছ-চাকাবিশিষ্ট যানটিকে নামিয়ে দেবে চাঁদের মাটিতে হেঁটে-চলে বেড়ানোর জন্য, সেটার নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রজ্ঞান’, সংস্কৃতে যার অর্থ ‘বিশেষ জ্ঞান’। আগের ‘চন্দ্রযান-২’-এও ল্যান্ডার-রোভারের একই নাম ছিল। এই রোভার যন্ত্রটি চলবে ওর গায়ে বসানো সোলার সেলের সাহায্যে শক্তি তৈরি করে নিয়ে। সব মিলিয়ে প্রায় সপ্তাহদুয়েক চলবার মতো রসদ ভরে দেওয়া হয়েছে ওগুলোর মধ্যে। চাঁদের ওই এলাকার হিসেবে ওটা এক চান্দ্র-দিন। আর যদি কোনওভাবে চন্দ্র-রাতটুকুও কাটিয়ে দিতে পারে, আরও পনেরো দিন টিকে থাকবে যন্ত্রযানটি।
আরও পড়ুন- মণিপুরের পাপ ঢাকতে অন্য রাজ্যের তুলনা কেন? সুপ্রিম ভর্ৎসনা কেন্দ্রকে
যন্ত্রযানের কর্মকাণ্ড
এই রোভারের সঙ্গে লাগানো রয়েছে একটি ‘স্পেক্ট্রোস্কোপ’, যেটা দিয়ে ও চাঁদের মাটির উপাদান সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করবে, দেখবে সেগুলোর রাসায়নিক গঠন। রয়েছে একটা ‘সিসমোমিটার’ যা পরীক্ষা করবে চাঁদের ভূমিকম্প। এ ছাড়া রয়েছে থার্মোমিটারের মতো এক যন্ত্র যা দিয়ে চাঁদের ভূমির ভেতরের দিকে উষ্ণতা কেমন, তা মাপা যাবে। আর রয়েছে একটা ‘রেট্রোরিফ্লেক্টর’ নামে যন্ত্র, যেটা চাঁদের গতিবিধি বুঝতে সাহায্য করবে। এই যন্ত্রটি আমাদের চন্দ্রযানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার জন্য দান করেছে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা-প্রতিষ্ঠান ‘নাসা’।
ক্যামেরাম্যান বিজ্ঞানী অনুজ
ইসরো-র এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত রয়েছেন এক বাঙালি বিজ্ঞানী অনুজ নন্দী, এই ল্যান্ডার-রোভারের সঙ্গে যুক্ত থাকা ক্যামেরার ডিজাইন তৈরির দায়িত্ব ছিল এঁরই কাঁধে। উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরের বাসিন্দা তিনি। আমবাগান প্রাইমারি স্কুলে তাঁর পড়াশুনো শুরু। ইসলামপুর হাই স্কুলে পড়াশোনা শেষ করার পর রায়গঞ্জ কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক হন অনুজ। এরপর কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স করেন। এই বিজ্ঞানী ইসরোয় চাকরি করছেন গত আট বছর ধরে। কিন্তু জন্মভিটের টান ভোলেননি অনুজ। সময় পেলেই চলে আসেন পরিবারের কাছে। ছেলের এই সাফল্যে উচ্ছ্বসিত ও গর্বিত তাঁর মা শোভা নন্দী। তিনি বলেন, একমাস আগেই ইসলামপুরের বাড়িতে এসেছিল সে। বেঙ্গালুরু থেকে ফোনে সবটা জানিয়েছে। আমরা এখানে বসেই মোবাইল ফোনে চন্দ্রযান (chandrayaan 3) অভিযানের দৃশ্যের সাক্ষী থাকলাম। এই প্রকাণ্ড মাপের কাজে তাঁর ভূমিকার কথা জানবার পর এখন ওই গ্রামে একই সঙ্গে বইছে আনন্দ এবং টেনশনের হাওয়া।
যাত্রাপথের বিবরণ
পৃথিবীর মাটি থেকে রওনা দেওয়ার মিনিট পনেরো পরে রকেটটির পৌঁছে যাওয়ার কথা পৃথিবীর চারপাশের কক্ষপথে। এরপর ওর শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে মডিউলটি। সেটা এরপর পাঁচবার লাট্টুর মতো পৃথিবীকে ঘিরে পাক খাবে। প্রতিবারে ওর কক্ষপথ বড় হতে থাকবে। এরপর এক সময় গতি বাড়িয়ে সোজা চলে যাবে চাঁদের দিকে, চাঁদের কক্ষে পৌঁছে সেখানেও চারবার পাক খেয়ে-খেয়ে নিজের কক্ষপথ কমিয়ে আনবে। তারপর এক সময় চাঁদের কাছাকাছি পৌঁছে গেলে ওর গা থেকে খুলে যাবে ল্যান্ডার-রোভার, সেটা এরপর আস্তে-আস্তে পাক খেতে খেতে নামবে চাঁদের মাটিতে।
শেষ কথা
‘মাত্র’ ছ’শো কোটির কিছু বেশি টাকা বরাদ্দ হয়েছে এই মিশনের জন্য। যা উন্নত দেশগুলোর চেয়ে অন্তত সাত-আট ভাগের এক ভাগ। ‘নাসা’র এক-একটা চন্দ্র-অভিযান প্রোজেক্টে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। আমাদের এই খরচ সেই তুলনায় বলতে গেলে কিছুই না। তবে ভারতের মতো উন্নয়নশীল একটা দেশের পক্ষে এই টাকাটাও খরচ করা উচিত কি না, সে-প্রশ্ন ওঠে মাঝেমধ্যেই। বিজ্ঞান-গবেষণার এই ক্ষেত্রটি সত্যিই দেশের উপকার করবে কি না এ-প্রশ্নও ওঠে। তবে ভারতের এই প্রচেষ্টা যে বিশ্বের বড়-বড় দেশের কাছ থেকে শ্রদ্ধা অর্জন করে, এটা মোটেই অস্বীকার করা যায় না।