বোঝা গেল তিনি ভয় পেয়েছেন। গঠিত হয়েছে ২৬টি রাজনৈতিক দলের জোট। ‘ইন্ডিয়া’ (INDIA)। ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে প্রধানমন্ত্রী ভয় পেতে শুরু করেছেন। যাঁর বিশাল চওড়া ছাতি। যিনি একাই একশো। যিনি একাই সব বিরোধীদের চাইতে বড়। তাঁর হাবভাব এখন ভয়ার্ত এক রাজনীতিবিদের। বিরোধী দলগুলি মিলিত হয়েছেন মাত্র ২ বার। পাটনা তারপর বেঙ্গালুরু। পাটনা-সভার পর বেঙ্গালুরুতে বিরোধী দলের সঙ্গে ছিল যথেষ্ট বেশি। সোনিয়া গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মল্লিকার্জুন খাড়্গে, নীতীশ কুমার, রাহুল গান্ধী, সীতারাম ইয়েচুরি-সহ দেশের বিরোধী দলনেতারা উপস্থিত ছিলেন। সবাই পাটনায় ছবি তুলতে গিয়েছেন বলে বিদ্রুপ করেছিলেন। কিন্তু বেঙ্গালুরু সভাতেই তাঁরা বুঝে গেলেন হাওয়া খারাপ। বাধ্য হয়ে এবং আতঙ্কিত হয়ে বিজেপি তাদের জোট এনডিএ-এর সভা ডাকলেন ঠিক সেই দিনই। যে কাজটি বিগত ৭-৮ বছর নরেন্দ্র মোদি করেননি। প্রচার করলেন প্রায় ৪০টি দল নাকি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অনেকে বললেন এত দল নাকি দেশেই নেই! যাঁরা এনডিএ বলে সভা করলেন তাঁদের অনেকের সাংসদ নেই সংসদের কোনও কক্ষে। কোনও কোনও দল নিবন্ধীকৃতও নয়। আমার তো মনে হয়, কোনও কোনও ক্লাব প্রতিষ্ঠানকে এই সভায় সংযুক্ত করেছিল বিজেপি।
বিরোধীদের জোট নিয়ে এবার বিদ্রুপ শুরু করলেন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কেন জোটের নাম ‘ইন্ডিয়া’ (INDIA) হল তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হল। এমনকী প্রধানমন্ত্রী বললেন যে, দেশের কয়েকটি তথাকথিত জঙ্গি সংগঠনের নামের সঙ্গে ইন্ডিয়া শব্দটি যুক্ত আছে। তিনি ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন-এর নাম করলেন। যে বিরোধী দলের জোটের সঙ্গে যুক্ত আছেন গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীরা, বর্ষীয়ান নেতারা, যাদের দলের সুদীর্ঘদিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য আছে— তাদেরকে এমন নগ্ন আক্রমণ একমাত্র নরেন্দ্র মোদির মতো রাজনীতিকই করতে পারেন। যাদের দলের কোনও ঐতিহ্য নেই। স্বাধীনতার আন্দোলনের পবিত্র উত্তাপে যাদের দল বিন্দুমাত্র স্পর্শ পায়নি। মোদ্দা কথা হল, প্রধানমন্ত্রী-সহ বিজেপি’র সকল নেতা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তৃতীয় সভা হবে মুম্বইয়ে। তার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে।
জোট ইতিমধ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে সংসদের ভিতরে ও বাইরে কাজ শুরু করে দিয়েছে। জনবিরোধী প্রত্যেকটা পদক্ষেপ, যা বিজেপি সরকার গ্রহণ করতে যাচ্ছে তাতে বাধা দিচ্ছেন জোটের সাংসদরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে। গায়ের জোরে লোকসভায় বেশি সংখ্যক সাংসদ থাকার জন্য বিল পাশ করিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু রাজ্যসভায় সেটা সম্ভব নয়। প্রচুর বিল সেখানে আটকে আছে। বিশেষ করে দিল্লির জন্য ‘বিশেষ আইন’ রাজ্যসভায় এসে গিয়েছে। বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ। তা ছাড়া এই অধিবেশনেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সংক্রান্ত বিল নিয়ে আসার কথা বলেছিল বিজেপি। আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে এটা তাদের ‘ট্রাম্পকার্ড’ বলে চিহ্নিত ছিল। কিন্তু বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ মনোভাব দেখে সেটা তারা আনার এখন সাহস পাচ্ছে না।
আরও পড়ুন-মুম্বইয়ে ইন্ডিয়ার দু’দিনের বৈঠক শুরু ৩১ অগাস্ট
বিরোধী জোটের সবচাইতে বড় কর্মসূচি এই সময়ে ছিল মণিপুরের আক্রান্ত মানুষের পাশ দাঁড়ানো। বিরোধী সব দলের পক্ষ থেকে সাংসদদের টিম পৌঁছে গেল আক্রান্ত মণিপুরবাসীদের কাছে। গত মে মাস থেকে এই ছোট্ট রাজ্যটি জ্বলছে। ইতোমধ্যে ২৫০ জনের বেশি মানুষ শহিদ হয়েছেন। বহু মানুষ এলাকা ছাড়া হয়েছেন। বহু মানুষ পাহাড়ের গায়ে অনাহার, অনিদ্রাতে জীবন কাটাচ্ছেন। দাঙ্গার এত নগ্ন প্রকাশ আর কোথাও নেই। মণিপুরে বিজেপি’র সরকার। ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকারের তত্ত্ব বারবার সামনে আনে বিজেপি। কিন্তু বিজেপি’র এই তত্ত্ব যে মুখ থুবড়ে পড়েছে সেটা মণিপুর একটা জ্বলন্ত উদাহরণ। আক্রান্ত মানুষের কাছে পৌঁছে গেলেন বিরোধী জোটের সাংসদরা। এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, অ-বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীদের দল মণিপুর চলুক। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এ-ব্যাপারে কোনও ইতিবাচক সাড়া না দেবার ফলে হতে পারেনি।
নরেন্দ্র মোদি বুঝে গিয়েছেন ঘটনাপ্রবাহ কোন খাতে বইছে। সাংসদরা মণিপুর থেকে ফিরে আবার দিল্লিতে মিলিত হয়ে সব দলের নেতাদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তারপর ঐক্যবদ্ধভাবে গিয়েছেন মহামহিম রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিতে। মল্লিকাজুর্ন খাড়্গে, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়েরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। দেশের মানুষ দেখছে প্রধানমন্ত্রী সংসদে কিছু না বলে, বাইরে মণিপুর নিয়ে বক্তব্য নিয়ে ভাষণ দিচ্ছেন এবং সেটাকে লঘু করার যাবতীয় চেষ্টা নিয়ে।
ঐক্যবদ্ধভাবেই বিরোধীরা সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছেন। এটা বিরোধীদের পক্ষে একটি বড় পদক্ষেপ। শেষ পর্যন্ত অধ্যক্ষ এই প্রস্তাব মঞ্জুর করেছেন। প্রধানমন্ত্রী আলোচনার জবাব দেবেন সেটাই এখন পর্যন্ত ঠিক আছে।
বিরোধী দলের মুখ কে? জোটের মুখ কে? এটা এখন বিজেপির মাথাব্যথার কারণ। কিন্তু আমাদের দেশে সব সময়ই আন্দোলন থেকে নেতাদের উত্থান হয়েছে। বিরোধী জোটের সদস্যরা একটা বড় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেটা দেশকে বাঁচানোর আন্দোলন। দেশের সংবিধান, বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্রকে বাঁচানোর লড়াইয়ে নেমেছেন বিরোধী জোট। কোটি কোটি মানুষের সমর্থন আছে তাদের পিছনে। মনে রাখতে হবে দেশের ৬৩ ভাগ মানুষ গত লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। সুতরাং নেতার বা মুখের অভাব হবে না। ‘ইন্ডিয়া’ (INDIA) শব্দটি জোটে যুক্ত করার পিছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুচিন্তা রয়েছে। রাহুল গান্ধীর সরাসরি সংযোজন রয়েছে। তা ছাড়া সব বর্ষীয়ান নেতা অংশ নিয়ে তৈরি করেছেন। সারা দেশের মানুষ আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন। সামনের দিনে বেশ কয়েকটি রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন আছে। বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়বে। ইতোমধ্যে রাহুল গান্ধী সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ পেয়েছেন। বিজেপির কপালে বড় গভীর ভাঁজ পড়েছে। সেইজন্য কুৎসিত ভাষায় জোটকে আক্রমণ করেছে। কিন্তু দেশের মানুষ জোটকে সাদরে গ্রহণ করেছে। এখন সময়ের অপেক্ষা।