প্রতিবেদন : পুজো পর্ব শেষ আবার এক বছরের প্রতীক্ষা। আবার মা আসবে ঠিক একটি বছর পর। তিল তিল করে বাঙালি এখন থেকেই শুরু করে দেবে পরের দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি। যতই করোনা আসুক বাঙালি যেন পুজো এলে সব ভুলে যায়। কিন্তু বছরভর এই প্ল্যানিংয়ের পর যখন দুর্গাপুজো আসে তখন মনে হয় চোখের নিমেষে চারটে দিন কোথা থেকে পেরিয়ে গেল। এক-দু’মাস আগে থাকতেই শুরু হয় কেনাকাটি পর্ব, অনেকের তো পুজোর মধ্যেও চলে অফিস, বিশেষ করে যাঁরা এমারজেন্সি সার্ভিসে আছেন। সবাই ফাঁকফোকর খুঁজে আনন্দে মেতে ওঠেন।
পুজোর চার-পাঁচটা দিন খাওয়া-দাওয়া, সাজগোজ, রোজ রাতজেগে প্যান্ডেল হপিং, গরমে ঘেমেনেয়ে ঠাকুর দেখা, বাড়ি ফেরা, মেক আপ না তুলেই একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আবার ঝটপট উঠে নতুন জামা গায়ে দিয়ে মণ্ডপে ছুট, আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে ফ্যামিলি গেট টুগেদার, রেস্তরাঁয় যাওয়া, লম্বা লাইনে অপেক্ষা, বাড়িতে পঞ্চব্যাঞ্জন রান্না— সব সবমিলিয়ে নিয়ম ভাঙার মহাপর্ব আমাদের দুর্গাপুজো। আবার যাঁরা পুজোয় বেড়াতে যান তাঁদেরও সব নিয়ম ভেঙে একাকার। যিনি খুব ঘুমোতে ভালোবাসে এই চার-পাঁচটা দিন তাঁর চোখে ঘুম নেই, যিনি খুব খেতে ভালোবাসেন এই ক’দিন তিনি হয়েছেন বাঁধনহারা। আরও একটু বেশি খেয়ে ফেলেছেন। আবার যিনি বাইরে বেড়াতে গেছেন তাঁরও ডায়েটের দফারফা, ওজন বেড়ে গিয়েছে এক লাফে অনেকটা। এক্সারসাইজ করলেও এই সময়টা বন্ধ। প্রচুর মেকআপ করেছেন তাই ত্বকে ক্লান্তি, চোখে কালি, শরীরে অপ্রয়োজনীয় মেদ, ধকল। রোজকার রুটিনের থেকে দীর্ঘায়িত ব্রেক, একরাশ অনিয়ম আর অযত্ন। পুজো শেষ হঠাৎ করেই আবার রোজকার রুটিনে ফেরা।
আরও পড়ুন : আইসিএসই স্থগিত আইএসসি পরীক্ষা
ত্বকের নিয়মানুবর্তিতা
উৎসব মানেই রাত জেগে ঠাকুর দেখা, আড্ডা, পার্টি অর্থাৎ ঘুম একদম কম, খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম, প্রচণ্ড সাজগোজ, সারাবছর যাঁরা মুখে কেউ কিছুই মাখেন না পুজোয় তাঁরাও একটু-আধটু মেকআপ করেন। কিন্তু যাঁরা মেকআপ করতে অভ্যস্ত নন তাঁরা মেকআপ তুলতেও অভ্যস্ত নন। রাত জেগে ঠাকুর দেখেছেন ফলে ত্বকের ক্ষতি হয়েছে অনেকটা। সেই মেকআপ না তুলেই বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। যাঁদের বাড়িতে দুর্গাপুজো তাঁদের ত্বক নিয়ে হুঁশ ছিল না। আজ লক্ষ্মীপুজো একের পর এক। চোখের নিচেও মুখের ত্বকে একটা ক্লান্তির প্রলেপ কালচে ছোপ, ফোলাভাব, ডাল এবং ড্রাই। ত্বকের ক্লান্তি নিমেষে দূর করতে রোজ রাতে শুতে যাবার আগে বরফ মুখে ঘষুন আলতো করে। বরফ কিউব নিয়ে একটা পাতলা কাপড় মুড়ে মুখে ঘষুন সার্কুলার মোশনে। মেকআপ এতদিন ত্বককে ঠিকমতো শ্বাস নিতে দেয়নি। তাড়াহুড়োয় আধখাপছা মেকআপ তুলেছেন কী তোলেননি। একটুকরো বরফ আপনাকে ফিরিয়ে দেবে সেই ফ্রেশনেস নতুন করে। বরফ শুধু ত্বককে স্বস্তি দেয় তাই নয় মুখের রোমকূপের ছিদ্রগুলো বন্ধ হয়ে যায় ফলে ত্বক পরিষ্কার থাকে। জেল্লা ফিরে আসে। ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার শুরু করুন রোজ দিনে দু থেকে তিনবার। ময়েশ্চারাইজার ত্বকের আর্দ্রতাকে ত্বকেই লক করে দেয় এবং বাইরের দূষণ থেকে ত্বককে রক্ষা করে। ম্যাসাজ করবেন সার্কুলার মোশনে। ত্বক অনুযায়ী ময়েশ্চারাইজার বাছুন। গ্রিন টি তৈরি করে সেটা আইস কিউব করে রাখুন। সেই আইস কিউবও মুখে ঘষে নিতে পারেন। গ্রিন টি-র আইস কিউব চোখের কালি, চোখের এবং মুখের ফোলা ঘুম কম হওয়া ভাবটা কাটিয়ে দেবে সহজে। ত্বক টানটান হবে। হাতে একটু সময় থাকলে দিনে বা রাতে যে-কোনও সময় শসা স্লাইস করে কেটে ডিপ ফ্রিজে রেখে দিন, এবার ওটা চোখের ওপর রেখে পাঁচ থেকে দশ মিনিট শুয়ে থাকুন— উপকার পাবেন।
এই ক’দিন একটানা মেকআপ আর না-ঘুমোনো ত্বকে ব্ল্যাকহেডস বাড়িয়ে দিতে পারে। নাকে পোর ক্লিনজিং স্ট্রিপ দিয়ে ব্ল্যাকহেডসগুলো রিমুভ করে নিন। মার্কেটেই কিনতে পাবেন এই স্ট্রিপ। পুজোর পর ত্বক একটু যেন রুক্ষ। এই ক্লান্ত, রুক্ষ ত্বক থেকে মুক্তি দেবে দুধ। দুধ খুব ভাল ক্লেনজার। ঠান্ডা দুধ তুলোয় করে নিয়ে মুখে লাগিয়ে নিন বা দুধের সঙ্গে অলিভ অয়েল মিশিয়ে তুলো ভিজিয়ে মুখে দিন। জেল্লা ফিরবে। পুজোয় রোদে রোদে ঘুরে ঠাকুর দেখতে গিয়ে বুঝতেই পারেননি কখন ত্বক সানবার্ন হয়ে গেছে। আসলে সানবার্নকে কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেন না। অনেকেই জানেন না যে সানবার্ন থেকেই ধীরে ধীরে ট্যান তৈরি হয়। যা রিমুভ করা কিন্তু বেশ কঠিন। তাই রোদে পুড়ে যাওয়া ত্বক প্রথমেই সারিয়ে ফেলুন ট্যানিং হওয়ার আগেই। একটু টমেটো, চটকে ছেঁকে নিয়ে সানবার্ন হয়ে যাওয়া অংশে লাগিয়ে নিন। কিছুক্ষণ পর ধুয়ে ফেলুন। টমেটোতে রয়েছে লাইকোপেন। এটি একটি এনজাইম যা ত্বকে ন্যাচরাল সানস্ক্রিনের কাজ করে। টকদইও রোজ স্নানের আগে ব্যবহার করতে পারেন। যা পুজোয় হয়ে যাওয়া সানবার্ন ক্লিন করবে। চোখের নিচ একটু ফোলা মনে হলে ব্যবহার করা যায় টি-ব্যাগ। ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে দুটো চোখের ওপর দশ মিনিট দিয়ে রাখুন। প্রচুর জল খান কারণ এতদিন পর্যাপ্ত জল খেতে ভুলে গেছেন। এতে ফোলাভাব কমবে।
আরও পড়ুন : .উত্তরাখণ্ডে মৃত ৪২, দার্জিলিংয়ে ধস
আবার ব্যায়াম
সারাবছর মন দিয়ে ব্যয়াম করলেও পুজোর ছুটিতে ব্যায়ামকেও ছুটি দিয়েছেন। আবার শুরু করে দিন। সকালে কিছু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করুন। নিজের বাড়ির ছাদে সকালে একটু হাঁটুন। শরীরে যে ম্যাজমেজে ভাব, আলস্য কেটে যাবে। ছোট ছোট পা ফেলে জোরে হাঁটুন যাকে বলে ব্রিস্ক ওয়াকিং। জগিং করতে পারেন। স্পট জগিং করলে অবশ্যই যোগা ম্যাটের ওপর করুন। সকালে খালি পেটে একগ্লাস জল, দুটো আমন্ড আর একটা খেজুর খেয়ে এক্সারসাইজ শুরু করতে পারেন। অন্তত তিরিশ মিনিট ব্যায়াম করুন। অফিস যাতায়াত করলে খানিকটা পথ যদি হেঁটে নিতে পারেন অনেকটা কাজ হবে। হালকা দৌড়োন দশ মিনিটের বেশি দরকার নেই। দৌড়োনোর সময় পায়ের সামনের পাতায় ভর দিয়ে দৌড়োন। স্কিপিং করতে পারেন যদি হাঁটুতে কোনও সমস্যা না থাকে। কয়েকটা ব্রিদিং এক্সারসাইজ করুন এর সঙ্গে। খেয়ে ঘুমিয়ে সবচেয়ে বেশি যেটা বেড়ে রায় তা হল পেট এবং কোমরের মেদ। ঘুম থেকে উঠে বিছানাতেই সিটআপ করে নিন দশবার। প্লাঙ্ক জাতীয় ব্যায়াম করতে পারেন। বিভিন্ন অ্যাবস ওয়র্কআউট এই সময় খুব কাজ দেবে৷
ঘুমকে নিয়মে ফেরান
আবার নিয়ম মেনে ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুমোন। পর্যাপ্ত ঘুম এখন ভীষণ জরুরি কারণ পুজোয় কম বা বেশি পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব সকলের হয়। আর ঘুম কম হলে তার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে ত্বকে এবং শরীরে। ঘুম কম হলে ওজন বেড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। যেসব ভাল-মন্দ খেয়েছেন এই ক’দিন সবটাই হজমের সমস্যাকে তরান্বিত করেছে ঘুম কম হয়েছে বলে। ত্বক হয়ে পড়েছে নিষ্প্রাণ। সুস্বাস্থ্যর জন্য ঘুম খুব জরুরি। কাজেই ঘুমকে রুটিনে ফেরান।
আরও পড়ুন : মোদিতন্ত্রে সুশাসন কোথায়?
নতুন করে ডায়েট
আনন্দ উৎসবের রুটিনে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে আমাদের পেট। তেল, ঝাল, মশলা, বিরিয়ানি, মাটন, কাবাব থেকে শুরু করে মালাই চমচম, দই, রাবড়ি, লুচি, পায়েস, আইসক্রিম, কোল্ডড্রিঙ্কস, ফুচকা, চাট— সবকিছুই পাল্লা দিয়ে উদরস্থ হয়েছে বাঙালির। কাজেই ওজন ঊর্ধ্বমুখী স্বাভাবিকভাবেই। এবার একটু গুড ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ফিরিয়ে আনবার পালা। ওজন কমাতে হবে। সকালে এক গ্লাস উষ্ণজলে অর্ধেক পাতিলেবুর রস চিপে খান। সকালে এক গ্লাস জলে এক চা-চামচ অ্যাপেল সিডার ভিনিগার দিয়েও খেতে পারেন। টকদই হয়ত এই ক’দিন খাননি বা খাবার অভ্যেস ছিল না তা হলে টকদই খাওয়া শুরু করে দিন। ব্রেকফাস্ট বা ভাতপাতে এমনকী রাতেও খেতে পারেন টকদই। এবার একটু হালকা খান লাঞ্চ এবং ডিনারে। জিরেবাটা দিয়ে মাছের ঝোল, ইলিশ মাছ হোক বা পাবদা— পাতলা ঝোল উপকারী। ডাল, চিকেন স্টিউ, যে কোনও স্যালাড বেশি করে খান। ডিমসেদ্ধ খান। হাইপ্রেশার না থাকলে দুটো ডিমও খেতে পারেন। কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য পরিমাণে কমিয়ে ফেলুন। পাউরুটি বিশেষ করে হোয়াইট ব্রেড, পাস্তা, প্যাকেটজাত খাদ্য কিছুদিন আর খাবেন না। বদলে ওটস, ব্রাউন ব্রেড, দালিয়া, ফ্ল্যাকসিড ইত্যাদি খান। প্রোটিন বেশি করে রাখুন তালিকায়। একবারে অনেকটা খাবার না খেয়ে বারে বারে ছোট ছোট মিল খান। ফাইবার জাতীয় খাবার খান। জলখাবার রোজ একটু বদলে বদলে খেতে পারেন ওটস পরিজ খেতে পারেন, সেদ্ধসবজি, একটা ডিম, শসা, টকদই খেতে পারেন, স্মুদি তৈরি করে খেতে পারেন, মাল্টিগ্রেন রুটি বা ব্রেডটোস্ট সঙ্গে স্কিমড মিল্ক ইয়োগার্ট খেতে পারেন। ভাত দুপুরে না খেয়ে সবরকম সবজি দিয়ে দালিয়া বা সবজিসেদ্ধ, গ্রিল করা চিকেন বা চিকেন সেদ্ধ করে হালকা অয়েল ব্রাশ করে সঁতে করে লেবু দিয়ে খেতে পারেন। রাতে ভেজিটেবল স্টিউ বা চিকেন স্টিউ বা পাতলা ঝোল খেতে পারেন। ব্রেডটোস্ট আর সুপ খেতে পারেন। যেটাই খাবেন খুব ধীরে ধীরে খান— গবেষণা বলছে এটা আপনার অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করবে। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ইন্টারমিট্টেন্ট ফাস্টিং করতে পারেন, এতে চট করে অনেকটা মেদ ঝরিয়ে ফেলতে পারবেন। রেস্তরাঁর খাবার বা জাঙ্ক ফুড, মিষ্টি, লুচি, পরোটা, কেক, পেস্ট্রি এখন থাক না ক’টা দিন বন্ধ— তারপর আবার খাবেন।