গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্র

এবারের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে গণতন্ত্রের প্রতিস্পর্ধী রূপে একনায়কতন্ত্রের দাঁত ও নখের বিস্তার চিন্তার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লিখছেন অনির্বাণ ধর

Must read

কে সি হ্যোয়ার বলেছেন, ভারতে কোয়াসি ফেডারেল কাঠামো বিরাজমান। কিন্তু সেই বৈশিষ্ট্য ক্রম অপস্রিয়মাণ। কারণ আদৌ দুর্লক্ষ্য নয়।
বর্তমান ভারত সরকার অত্যন্ত সুকৌশলে একটি পরীক্ষা শুরু করেছে। সেই প্রক্রিয়াগুলিকে মনে করা হয় রাজনৈতিক ঘটনাপুঞ্জ। আসলে কিন্তু পুরোপুরি তা নয়। সেগুলির প্রত্যেকটি একটি করে লিটমাস টেস্ট। ভারতকে করা হয়েছে ল্যাবরেটরি। পরীক্ষার লক্ষ্য হল, গণতন্ত্র (Democracy) এবং সংবিধানের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে আদৌ কতটা ভারতবাসী অবহিত সেটা বুঝে নেওয়া। এবং ধীরে ধীরে একটু একটু করে অধিকার খর্ব করা। আসল উদ্দেশ্য ভারতকে ক্রমেই পরোক্ষে কেন্দ্রীয় শাসনের দিকে নিয়ে যাওয়া। সংবিধানে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, অর্থাৎ একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার থাকবে আবার পাশাপাশি শক্তিশালী এবং স্বশাসিত রাজ্যও থাকবে। পরস্পরের সহায়ক এবং পরিপূরক হয়ে তথা দায়িত্ব বিভাজনের মাধ্যমে দেশ চলবে। কেন এই ব্যবস্থা? কারণ, ভারত বহু ভাষাভাষী এবং বহু সংস্কৃতির একটি দেশ। তাই একটিই শাসন ব্যবস্থা গোটা দেশে চলতে পারে না। এভাবেই এতকাল চলে এসেছে। এবার স্ট্র্যাটেজি হল, এই ব্যবস্থাটি ধ্বংস করা হবে না পুরোপুরি। ভারত সরকারের ক্ষমতাসীন বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর লক্ষ্য হল, ক্রমেই এই ব্যবস্থার কাঠামোটি বজায় রেখে ভিতরে ভিতরে আমূল বদল ঘটানো। প্রধানত রাজ্যের অধিকারকে দুর্বল করে দেওয়া। তাদের কেন্দ্রনির্ভর করে ফেলা। এভাবে ধীরে ধীরে কেন্দ্রীয় সরকারই সব রাজ্যের যে কোনও সিদ্ধান্ত কিংবা নীতির সর্বশক্তিমান কর্তা হয়ে যাবে।
কাশ্মীরের ৩৭০ নং ধারা অবলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। ওই সিদ্ধান্ত নিয়েই নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষান্ত হয়নি। তার সঙ্গে আস্ত রাজ্যকে দু’টুকরো করে দিয়েছে। যে ছিল পূর্ণ রাজ্য, তাকে দুটি ক্ষুদ্র কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাশ্মীর নিয়ে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। সেটি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে শুনলে বোঝা যাবে, তিনি ঠিক কী চান। তিনি বলেছিলেন, যেদিন থেকে রাজ্যপালের শাসন কাশ্মীরে চালু হয়েছে, সেদিন থেকে প্রশাসন সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করেছে। এই কারণেই সুশাসন আর উন্নয়ন চোখে পড়ছে। যেসব সরকারি প্রকল্প আগে কাগজে-কলমে থাকত, এখন সেগুলি বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। বিগত কয়েক মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সংযোগস্থাপনের কারণেই দ্রুতগতিতে সব কাজ হয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এই বাক্যগুলিতেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি মনে করেন কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি অধীনে কোনও রাজ্য থাকলে সেখানে উন্নয়ন এবং প্রশাসনিক কাজ অনেক সফলভাবে করা যায়।
সেজন্যই সম্ভবত ভোটে পরাজয় ঘটলেও যে কোনও রাজ্যের সরকার গঠন করতে তাঁর দল প্রচণ্ড মরিয়া হয়। কোনও নীতি অথবা নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করেন না তাঁরা। যেভাবেই হোক রাজ্যটা দখল করতে হবে এই হল লক্ষ্য। যত বেশি রাজ্য হাতে থাকবে, তত বেশি করে কেন্দ্রীয় শাসনের আওতা বাড়বে। তত বেশি করে রাজ্যের রাজকোষের উপর অধিকার কায়েম করা যাবে। তত বেশি করে সেই রাজ্য থেকে রাজ্যসভার এমপি নির্বাচিত করে নিয়ে আসা যাবে। ফলে সোজাপথে এবং ঘুরপথে সংসদের দুই কক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা যাবে। কারণ, সংবিধানে এমন বহু অধিকার দেওয়া হয়েছে, যেগুলি সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকার কার্যকর করতে পারে না। সংসদকে সেই অধিকার দেওয়া আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে সেই অধিকারকে নিজেদের পক্ষেই চালনা করা যায়। যেমন? যেমন রাজ্যের সীমানা বদলে দেওয়া। রাজ্যকে দু-টুকরো করে দেওয়া, রাষ্ট্রপতি শাসন চালু করা ইত্যাদি।

আরও পড়ুন- ক্ষুদ্রশিল্প বিকাশে ৩০০ কোটি তৈরি লক্ষাধিক কর্মসংস্থান

একনায়কতন্ত্র চালু করতে হলে সর্বাগ্রে গণতন্ত্রের (Democracy) পরিসর ক্ষুদ্র করে দিতে হয়। গণতন্ত্রের সবথেকে বড় মাধ্যম হল ভোট। একজন নাগরিকের একক ও স্বাধীন সার্বভৌম শক্তি হল তাঁর ভোটাধিকার। তাই জনগণ মনে করে তার ভোটের মূল্য রয়েছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে কতবার কত সরকার ও শাসককে সে ভোট দিয়ে পাল্টে দিয়েছে। শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু একনায়কতন্ত্রের পদধ্বনি তখনই শোনা যাবে যখন দেখা যায় সেই ভোটকেই শাসক ক্রমে গুরুত্বহীন এবং মূল্যহীন করে দিচ্ছে। অর্থাৎ জনগণ কাকে ভোট দিচ্ছে এবং কে জয়ী হচ্ছে, তার যদি কোনও অর্থই না থাকে, তাহলে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সবথেকে বড় সুবিধা হয়। ২০১৫ সাল থেকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে লক্ষ করা গিয়েছে, ভোটে পরাস্ত হয়েও রাজ্যে রাজ্যে অন্য দলের বিধায়কদের ভাঙিয়ে নিয়ে এসে বিজেপি সেইসব রাজ্যে সরকার গঠন করেছে। এই প্রবণতা এখনও বিদ্যমান। আগামী দিনেও দেখা যাবে। অর্থাৎ জনতা যাকে ভোট দিয়েছে, সে আগামী দিনে সেই দলে থাকবে তার নিশ্চয়তা নেই। জনতা যে দলকে সরকারে দেখতে চেয়েছে বলে ভোট দিয়েছে, দেখা যাচ্ছে তাদের সরকারে হয় বসতে দেওয়া হল না অথবা তাদের সরিয়ে দেওয়া হল কোনও দল তথা সরকারে ফাটল ধরিয়ে। তারপর পরাস্ত হওয়া দল সরকারে বসছে। এসবের আসল লক্ষ্য হল, ভোট ব্যাপারটাকেই গুরুত্বহীন করে দেওয়া।
এই লক্ষ্যেই দিল্লি সার্ভিসেস বিল ২০২৩ পাশ হয়ে গেল।
এই লক্ষ্যেই দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আর রাখা হবে না সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে এই নয়া বিল পাশ করানোর উদ্যোগ নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক।
কোনও প্রতিবাদ করা যাবে না।
চুপ! মোদিরাজ চলছে। সংসদের ভিতরে-বাইরে চলছে বুলডোজার রাজ।
তাই, ২০২৪-এর ভোটই সম্ভবত শেষ বারের মতো আমরা সুযোগ পাব এই স্বৈরতন্ত্রের অবসানের জন্য।

Latest article