পাঠক : আমার কতগুলো প্রশ্ন আছে। প্রথমেই বলি, এই অমৃত মহৎকালটিকে (Amrit Mahotsav) আপনি কেমনভাবে দেখলেন?
সম্পাদক : আমরা গতবছর অগাস্ট মাসে গান্ধীজির ‘হিন্দ স্বরাজে’র অনুকরণে এইভাবে কথা বলেছিলাম। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে এলাম। কিছু পাইনি এমন কথা বলব না। তবে এই পবিত্র মুহূর্তে তো মণিপুর জ্বলছে!
পাঠক : দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সামাজিক স্থিতি অনেকদিনই বিপন্ন। মণিপুরে অতীতেও সামরিক বাহিনীর বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ আন্দোলন করেছেন। ২০০৪-এ ‘আপুনবা লুপে’র আন্দোলন তো আমরা ভুলিনি।
সম্পাদক : সেটা ছিল সরাসরি রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে। এখানে সমস্যা অন্য। রাষ্ট্রীয় সুবিধা বণ্টন নিয়ে সমাজের অভ্যন্তরেই সমস্যার জন্ম হয়েছে বা বাধানো হয়েছে! তার থেকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা। এর প্রভাব কিন্তু সুদূরপ্রসারী!
পাঠক : আপনি বলতে চান সংরক্ষণের দাবির কথা। সেই দাবির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ থেকেই সমস্যা তৈরি হয়েছে। এতে সুদূরপ্রসারী ফল কী হতে পারে?
সম্পাদক : একটি রাজ্য বা সমগ্র দেশে যখন রাষ্ট্রশক্তির অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করেন এবং সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের একটি সামাজিক প্রশ্রয় থাকে, রাষ্ট্রশক্তির একমাত্র উপায় হল জনসাধারণের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধের সূত্রগুলিকে উসকে দেওয়া অথবা যখন সেই বিরোধ দেখা গেল তখন হাত গুটিয়ে বসে থাকা। অর্থাৎ হিংসাকে পরোক্ষে প্রশ্রয় দেওয়া। এতে শান্তিপ্রিয় জনসাধারণের কাছে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রশক্তিই একমাত্র বিকল্প হয়ে উঠবে এবং আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে কেউ আর আপত্তি তুলবেন না। এভাবে সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এদেশে এই ভেদনীতি কার্যকর আছে। আর একটা ব্যাপার আছে!
পাঠক : আপনি নিশ্চয়ই সংরক্ষণের নীতির কথা বলছেন?
সম্পাদক: অনেকটা সেরকমই। ধরুন শুধু তো মণিপুর নয়! কর্নাটকে আমরা দেখতে পেয়েছি সংরক্ষণ নীতির বিরুদ্ধে কিছু কথা হয়েছে বিধানসভা নির্বাচনের আগে। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলেও এই বিষয়ে তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যদিও উভয় ক্ষেত্রেই জনসাধারণের শুভবুদ্ধি এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম ও রাজনৈতিক কৌশল দিয়ে সেই তৎপরতাকে ভোঁতা করা গিয়েছে। কিন্তু সমস্যা একটা তৈরি হচ্ছে। এটা সারাদেশ জুড়েই আগামিদিনে হতে পারে!
পাঠক : কী ধরনের সমস্যার কথা বলছেন?
সম্পাদক : সরাসরি ধর্মীয় ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সংরক্ষণের আওতাভুক্ত করার দাবি উঠতে পারে। এতে অবশ্যই যাঁরা এখন সংরক্ষণের আওতাভুক্ত আছেন তাঁরা বিপন্ন বোধ করবেন, কারণ সরাসরি ধর্মের ভিত্তিতে বা জেনারেল ক্যাটিগরির আসন ধরে আইনসম্মত ভাবে কোনও ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। এতে সংরক্ষণের আওতাভুক্ত মানুষদের মধ্যেই বিরোধ বাধবে। এতে বলার সুযোগ হবে যে সংরক্ষণ বিষয়টিই গোলমেলে অতএব ওটা তুলে দেওয়া হোক।
পাঠক : আপনার কী মনে হয় সেরকম সমস্যা হলে কেন্দ্রীয় শাসকদলের বিরোধী দলগুলো সেটা নিয়ে কিছু বলবে না? বিশেষত ইন্ডিয়া জোট?
সম্পাদক : বলবে না যে এমন কথা বলছি না। কিন্তু আমরা সবাই যদি এটাকে নিছক আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলে মনে করি বা পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসা কিংবা রাজস্থানের নারী নিগ্রহের সঙ্গে একাকার করে দিই তাহলে কিছুই বুঝতে পারব না তো! কাশ্মীর সমস্যার সহজ সমাধান আগে দেখেছি। রাজ্যটাকে দু’টুকরো করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে দেওয়া হল। পুনরায় রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হবে বলা হয়েছিল। কিছুই হল না এতদিনে। না হয় দুটো রাজ্যই হত! নির্বাচিত সরকার তো প্রয়োজন!
পাঠক : কিন্তু সবটাই কি এতটা সরল? আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বা ভোটে হিংসা নিয়ে কেউ কিছু বলবেন না?
সম্পাদক : বলবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু একাকার করে দিলেই মুশকিল। অনেকেই বলছেন, সব জায়গায় শাসকের এত ছবি কেন? পয়সা তো জনগণের! শাসক নিজের ঢাক পেটান কেন? এগুলিও প্রশ্ন! তাঁরা লিডারশিপের ধারণাটাই সম্ভবত তুলে দিতে চান। গণতন্ত্র থাকবে, তার অবশ্যমান্য নেতৃত্ব থাকবে, ‘বিপ্লবস্পন্দিত বুকে’ লেনিন থাকবেন, মাওয়ের চিন্তাধারায় শত শত প্রাণ বলিদান যাবে আর কেউ থাকবেন না! নির্বাচিত শাসক তো জনসাধারণের থেকে সমর্থন পেয়েছেন। যেদিন পাবেন না, সেদিন থেকে তাঁদের ছবি থাকবে শুধু দলীয় কার্যালয়ে। সরকারি মঞ্চে নয়। কেবল নোটে গান্ধীজির ছবি থাকবে। সেই নোট চোর বা সাধু যার পকেটেই থাকুক না কেন! অবশ্য নয়া গণতন্ত্রবাদীরা তীব্র আপত্তি করলে আলাদা কথা। সেক্ষেত্রে নোটে কেবল আয়কর দফতরের ছবি দিয়ে দিলেই হয়! সবাই ভয় পাবেন।
পাঠক : তার মানে আপনি বলছেন জনগণের পয়সায় সরকার চলছে না?
সম্পাদক : অবশ্যই জনগণের করের টাকায় সরকার চলে। কিন্তু সেই করের পরিমাণ এবং ধরন সরকারই ঠিক করেন। সরকারই নোট ছাপান আবার বাতিল করেন। আচমকা বাতিল করলে কী বিপর্যয় হয় আমরা নিকট অতীতে দেখেছি। এটাই প্রমাণ করে যে জনসাধারণের জীবন যাপনের সঙ্গে সরকারের একটা যোগসূত্র আছে যাকে অস্বীকার করা যায় না। সরকার কিছু দিলে সেটা মোটেই দয়ার দান নয়। এটি একটি অলিখিত সমঝোতা বা চুক্তির ফলশ্রুতি।
পাঠক : তাহলে অমৃতকালে (Amrit Mahotsav) আমরা বিভ্রান্তি ছাড়া কিছুই পাইনি?
সম্পাদক : আসলে যা পেয়েছি, সেটা একটা উপলব্ধি। আমাদের চেতনা বড় ক্ষণস্থায়ী। কোনও কিছু তলিয়ে ভাবি না। হাথরসের নির্যাতিতদের খবর রাখি? রাখি না। সিদ্দিক কাপ্পানের জন্য সারা দেশ আছে। নির্যাতিত সাংবাদিকের বন্ধু আছে। থাকার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। কিন্তু দৃষ্টি যে ঘুরে গেল সেদিকে খেয়াল করলাম কই? পরে কপাল চাপড়ে কোন লাভ নেই।
আরও পড়ুন- মোদি সরকারের বিরাট দুর্নীতি, ক্যাগ রিপোর্টে পর্দা ফাঁস