১৯৪৫ সালে মুর্শিদাবাদের কান্দির রাজ পরিবারে জন্ম হয় তাঁর। স্নাতকস্তরের পড়াশোনা করেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। মূলত সেখান থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন তিনি, বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানে। ভারতের পরমাণু গবেষণা এবং ভ্যারিয়েবল ও হাই এনার্জি গবেষণার ক্ষেত্রে অন্যতম বিজ্ঞানী তিনি। নিজের দীর্ঘ গবেষণা ক্ষেত্রে ভারতের পরমাণু পরীক্ষণ থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অংশ ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত ছিলেন ভাবা অ্যাটমিক সেন্টার এবং ভ্যারিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টারের সঙ্গে। ১৯৮৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর অসামান্য গবেষণার স্বীকৃতি হিসাবে তিনি মর্যাদাপূর্ণ ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির ফেলো নির্বাচিত হন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এর ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্বও পালন করেন তিনি। এই ব্যক্তিটি আর কেউ নন, তাঁর নাম বিকাশ সিনহা (Scientist Bikash Sinha)।
পরিবার পরিচিতি ও শিক্ষা
মুর্শিদাবাদের সিনহা পরিবারের সদস্যেরা শিক্ষা-দীক্ষা থেকে শুরু করে রাজনীতি, সমাজের নানান পরিসরে সর্বদাই সক্রিয় থেকেছেন, আর এর অন্যথা বিকাশবাবুর ক্ষেত্রেও কখনও হয়নি। বাবা বৃন্দাবনচন্দ্র সিনহা। বিকাশ সিনহা তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে স্নাতক হওয়ার পর উচ্চতর শিক্ষার জন্য পাড়ি দেন বিদেশে, কেমব্রিজের কিংস কলেজ থেকে পাশ করে ফিরে ১৯৭৬ সালে যোগ দেন মুম্বইয়ের ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে। পরবর্তী সময়ে কলকাতার সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এবং ভ্যারিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টারের ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করেন। ১৯৯৪-এ বিজ্ঞানাচার্য সত্যন্দ্রনাথ বসুর জন্মশতবর্ষ সম্মানের প্রাপক ছিলেন এই বিকাশ সিনহা।
গবেষণা ও কাজ
বিজ্ঞানী বিকাশ সিনহার (Scientist Bikash Sinha) কোয়ার্ক–গ্লুয়ন প্লাজমার ওপর গবেষণা এবং এই বিষয়ে তাঁর অবদান তাঁর ঝুলিতে বহু সম্মাননা, বহু পুরষ্কার পুরে দিয়েছে। কোয়ান্টাম ক্রোমো-ডাইনামিক্সে কোয়ার্ক-গ্লুয়ন প্লাজমা বা কোয়ার্ক-গ্লুয়ন স্যুপ হল পদার্থের এমন এক দশা যা অতি উচ্চ তাপমাত্রা এবং উচ্চ ঘনত্বে বিদ্যমান থাকে। পদার্থের এই দশাটি অনন্ত স্পর্শক স্বাধীন সবল মিথস্ক্রিয়াশীল কোয়ার্ক ও গ্লুয়নের সমন্বয়ে গঠিত হয় এবং তা সাধারণত পারমাণবিক নিউক্লিয়াস বা অন্যান্য হ্যাড্রনের রং বন্ধন বা colour confinement দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। তাই এদের আলাদা আলাদা ভাবে পাওয়া যায় না। এবার প্রশ্ন হল, কোয়ার্ক কী? কোয়ার্ক হল একটি প্রাথমিক কণা এবং বস্তুর একটি সরল মৌলিক উপাদান। এই কোয়ার্কগুলি হ্যাড্রন নামে যৌগিক কণা গঠন করে, যার মধ্যে সবচেয়ে স্থিতিশীল কণাগুলি হল পরমাণুর নিউক্লিয়াসের উপাদান প্রোটন এবং নিউট্রন। Colour confinement বা রং বন্ধনের জন্য কোয়ার্ক সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা বা বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যায় না। এদের একমাত্র পাওয়া যায় হ্যাড্রনগুলির মধ্যে, যার মধ্যে রয়েছে ব্যারিয়ন (যেমন প্রোটন এবং নিউট্রন) এবং মেসন। এই কারণে, কোয়ার্কের সম্পর্কে যা কিছু জানা গিয়েছে তা হ্যাড্রনের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই জানা গিয়েছে। কোয়ার্কের তড়িৎ আধান, ভর, রং আধান, এবং ঘূর্ণন সহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বর্তমান। এরা কণা পদার্থবিজ্ঞানের মডেলের একমাত্র মৌলিক কণা যা মৌলিক বল (তড়িচ্চুম্বকীয় বল, মহাকর্ষ বল, সবল নিউক্লিয় বল এবং দুর্বল নিউক্লিয় বল) নামে পরিচিত চারটি মৌলিক মিথস্ক্রিয়ার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, সেইসঙ্গে একমাত্র পরিচিত কণা যার তড়িৎ আধান কোনও প্রাথমিক আধানের পূর্ণসংখ্যার গুণিতক নয়। বিজ্ঞানী মুরে জেল-ম্যান এদের নাম দেন কোয়ার্ক। নামটি জেমস জয়েস-এর ফিনেগান্স ওয়েক উপন্যাসের একটি হেঁয়ালিপূর্ণ উক্তি: ‘‘মাস্টার মার্কের তিনটি কোয়ার্ক!” থেকে নেওয়া হয়েছে। কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিক্সে যেই ভেক্টর গেজ বোসনগুলি (কণা পদার্থবিজ্ঞানে, গেজ বোসন হল একটি বলের বাহক, একটি বোসনিক কণা যা মৌলিক মিথস্ক্রিয়ার বাহক, সাধারণ ভাষায় বল) কোয়ার্কের সবল মিথস্ক্রিয়ায় মধ্যস্থতা করে তারাই গ্লুয়ন। গ্লুয়নই সবল মিথস্ক্রিয়ার রং আধান বহন করে। এরা ফোটনের মতো নয় যা তড়িৎ-চৌম্বক বলের আধানহীন বাহক। এরপর আসা যাক হ্যাড্রনের কথায়। হ্যাড্রন (গ্রিক ভাষায়: hadrós, ‘‘stout, thick’’) হল এক ধরনের যৌগিক কণা যা কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত। তড়িৎচুম্বকীয় শক্তির মাধ্যমে যেভাবে অণু ও পরমাণুসমূহ পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তেমনি কোয়ার্কও পরস্পরের সঙ্গে সবল নিউক্লীয় বলের সাহায্যে সংবদ্ধ থাকে। হ্যাড্রনকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে যথা ব্যারিয়ন (তিনটি কোয়ার্ক দিয়ে গঠিত) এবং মেসন (একটি কোয়ার্ক এবং একটি অ্যান্টিকোয়ার্ক দিয়ে গঠিত)। সবচেয়ে পরিচিত হ্যাড্রনের মধ্যে অন্যতম হল প্রোটন এবং নিউট্রন (দুটিই ব্যারিয়নশ্রেণির) যেগুলি পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের উপাদান। প্রোটন ছাড়া অন্য সব ধরনের হ্যাড্রন অস্থিতিশীল এবং অন্য ধরনের কণায় পরিবর্তনশীল। সর্বাপেক্ষা পরিচিত মেসন হল পায়োন এবং কায়োন, যেগুলি ১৯৪০-এর শেষার্ধে এবং ১৯৫০-এর প্রথমার্ধে মহাজাগতিক রশ্মি পরীক্ষার সময় আবিষ্কৃত হয়। যদিও এরাই হ্যাড্রনের একমাত্র উদাহরণ নয়; আরও বহু বহু কণা আবিষ্কৃত হয়েছে এবং আবিষ্কারের প্রক্রিয়া চলছে নিরন্তর। সাধারণত বিগ-ব্যাং তত্ত্ব অনুসারে এটি মনে করা হয় সৃষ্টির আদিকালে গোটা ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে এই কোয়ার্ক-গ্লুয়ন প্লাজমার স্তরের আবরণ ছিল।
আরও পড়ুন- মোদি সরকারের বিরাট দুর্নীতি, ক্যাগ রিপোর্টে পর্দা ফাঁস
স্বীকৃতি ও সম্মাননা
বিজ্ঞানী বিকাশ সিনহার (Scientist Bikash Sinha) নিরলস বিজ্ঞানসেবা তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছে। স্বদেশে ২০০১ সালে বিজ্ঞানী রাজা রমন্নার নামাঙ্কিত পুরস্কার থেকে শুরু করে ইউক্রেনের ন্যাশনাল অ্যাকডেমি অব সায়েন্সের দেওয়া সাম্মানিক ডক্টরেট, জার্মানির আম্বোল্ট রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তি তারই সাক্ষ্য দেয়। ভারত সরকার ২০০১ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে, ২০১০ সালে তিনি সম্মানিত হন পদ্মভূষণে। ২০২২ সালে তিনি বঙ্গবিভূষণ হন। ওই বছর রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কারও দেওয়া হয় তাঁকে। ২০০৫ সালে ২৭ জানুয়ারি তাঁকে ‘সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইসারি কাউন্সিল’-এর সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহ। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে দ্বিতীয়বার ওই একই পদে নিযুক্ত হন তিনি। বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে বাংলা ভাষায় প্রচুর বই, প্রবন্ধ লেখেন এই বিজ্ঞানী। বেশ কিছু ইংরেজি বইয়ের সমান্তরালে বাংলায় ‘স্থান কাল বিশ্বলোক’ বা ‘সৃষ্টি ও কৃষ্টি: বন্ধনহীন গ্রন্থি’-র মতো বই তাঁর সেই উদ্যোগেরই সাক্ষী দেয়। বিজ্ঞান বিষয় ক্রমাগত লিখে গিয়েছেন বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায়। তাঁর নিরলস বিজ্ঞানচর্চার সমাপ্তি ঘটে ১১ অগাস্ট ২০২৩-এ।