(গতকালের পর)
আদতে বর্তমান যুবসমাজের কাছে, ইতিহাসের কাছে বিনায়ক সাভারকার (Veer Savarkar) এক পলায়নকারী ‘বিপ্লবী’ রূপেই পরিচিত। বিজেপি আরএসএস সাত-সাতবার তাঁর মুচলেকা দেওয়ার প্রসঙ্গ একদা অস্বীকার করেছে এবং পরবর্তীকালে সেই মুচলেকা দেওয়াকে ‘রাজনৈতিক কৌশল’ এবং ‘মহাত্মা গান্ধীর পরামর্শ’ বলে প্রচার করেছে। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস এই যে, ১৯১১ সালে সেলুলার জেলে বন্দি হওয়ার এক মাসের মধ্যেই তিনি প্রথমবার মুচলেকা দেন ৩০ অগাস্ট, ১৯১১ সালে। এরপর তারপর ২৯ অক্টোবর, ১৯১২; নভেম্বর ১৯১৩, সেপ্টেম্বর ১৯১৪। তারপর ১৯১৫ এবং ১৯১৭। শেষ দুটোতে আগের আগুনখেকো বিপ্লবী সাভারকার ওকালতি করছেন হোমরুলের পক্ষে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গান্ধীজি আফ্রিকা থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে ভারতে জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপে যুক্ত হন ১৯১৫ সালে। ১৯২০ সালে গান্ধীজি ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় সাভারকারের মুক্তির দাবিতে লেখা প্রকাশ করেন। কিন্তু ১৯২০-র আগেই অন্ততপক্ষে ৬ বার লেখা মুচলেকা তিনি কার পরামর্শে লিখলেন? এবং ১৯২১-এ সেলুলার থেকে রত্নগিরি জেল এবং ১৯২৪-এ মুক্তির পরে কোন বৈপ্লবিক ব্রিটিশ-বিরোধী রাজনৈতিক কার্যকলাপে সাভারকারের নাম যুক্ত হয়েছে? বরং তাঁর ‘মাফিনামা পত্র’তে তিনি নিজেকে ‘ব্রিটিশ মায়ের সন্তান’ বলে উল্লেখ করে তাদের ‘সব রকম সহযোগিতা’র বার্তা দিয়ে বলেন— ‘‘ব্রিটিশ ডোমিনিয়নের সঙ্গে ‘ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং পারস্পরিক সাহায্যের বাঁধনকে শক্ত করতে’ এবং রাজকীয় সনদে বর্ণিত সাম্রাজ্যের সঙ্গে সাংবিধানিক নিয়মতান্ত্রিক পথে এক সম্পর্ক” গড়ে তোলবার কথা। এই ইতিহাসকে আড়াল করতেই তাই সাভারকারের নামের সঙ্গে শহিদ ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং বা নেতাজির নাম জুড়ে দেওয়া প্রয়োজন। যাতে বিকৃত ইতিহাসে সাভারকার গ্রহণযোগ্যতা পায়।
সাভারকার (Veer Savarkar) ১৯২২-’২৩ সালে রত্নাগিরি কারাগারে থাকাকালীন যে বহু আলোচিত এবং বিতর্কিত গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন— ‘হিন্দুত্ব : হু ইজ হিন্দু’ সেই বইটির বিষয় ও দৃষ্টিভঙ্গির অন্বেষণেই আমরা যুগপৎ কেন বিজেপি সরকারের এই সাভারকার প্রীতি এবং তাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রকৃত অভিসন্ধি ও লক্ষ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারব। সাভারকার এই গ্রন্থে ‘হিন্দুত্ব’কে জাতিসত্তাগত ভিত্তিতে স্থাপন করেছেন। তিনি বলেন— ‘বৈদিক, সনাতন, জৈন, বৌদ্ধ, লিঙ্গায়েত এবং শিখ ধর্ম ও আর্য, দেব, ব্রাহ্ম ও প্রার্থনা সমাজের মতো ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্ম যেহেতু ভারতে, তাই এগুলি স্বাভাবিকভাবেই হিন্দুত্বের অঙ্গীভূত’। তা-বলে এমনটা মনে করবার কোনও অবকাশ নেই যে অ-হিন্দু, ভারতে বসবাসকারী যে কেউ-ই হিন্দুত্বের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। সাভারকার এ-বিষয়ে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন, মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদিদেরও যদিও এই দেশ ‘পিতৃভূমি’ (লক্ষণীয় মাতৃভূমি নয়) অর্থাৎ জন্মভূমি, তথাপি এদেশ তাদের ‘পুণ্যভূমি’ অর্থাৎ তাদের ধর্মের জন্মস্থান নয় তাই হিন্দুত্বের সীমানায় তারা ব্রাত্য। এমনটা ভাববার কোনও কারণ নেই যে সাভারকার নিতান্তই এতটা অজ্ঞ যে বৈদিক ধর্মের প্রতিষ্ঠাকারী আর্যরা এদেশের আদি অধিবাসী নয়, তারা মধ্য এশিয়া থেকে আগত— এ-কথা তাঁর জানা ছিল না। অথবা এই বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি ধর্ম বা ব্রাহ্ম, প্রার্থনা ইত্যাদি সম্প্রদায় হিন্দু ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদকে খর্ব করার উদ্দেশ্যেই সৃষ্ট হয়েছে তা সাভারকারের অজ্ঞাত ছিল তেমনটা নয়। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় সভ্যতাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে তার বিকাশ ও রূপান্তর ঘটেছে এক ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে আনুগত্য প্রদর্শন ও হীনতার একটি পারস্পরিক সহাবস্থানের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে। এই ধর্মীয় বিশ্বাসগুলি যেমন একে অপরের বিপ্রতীপে আবার একই সঙ্গে একে অন্যের পরিপূরকও। ঠিক যেভাবে মুসলমান সমাজের ‘সত্যপীর’ হিন্দু সমাজে গ্রাহ্য হয়েছেন ‘সত্যনারায়ণ’ রূপে। সাভারকার তাঁর এই ‘হিন্দুত্ব’ গ্রন্থে ভারতীয় সভ্যতার অগ্রগতিতে এই অপরিহার্য বহুত্ববাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে মুছে দিয়ে ভারতীয় সভ্যতার নামে আদতে সংকীর্ণ হিন্দুত্ববাদীর কাল্পনিকতার জন্ম দিয়ে ইসলামিক সংস্কৃতির নেতীকরণ ঘটাতে চেয়েছিলেন। এমনকী ‘আত্মগত ঐক্য নির্মাণ’-এর নামে তিনি মুসলমান-বিরোধী ‘ঘৃণামূলক প্রচার’ (hate campaign)-কে প্রধান করে তোলার নিদান দেন, যার সুযোগ্য উত্তরাধিকার হয়ে উঠেছে আজকের ভারতীয় জনতা পার্টি।
ইতিমধ্যেই সেলুলার জেলে শহিদ উল্লাসকর দত্ত, ইন্দুভূষণ রায়ের মতো প্রায় চারশো বাঙালি বিপ্লবীর পরিবর্তে আন্দামান বিমানবন্দরের নামকরণ হয়েছে সাতবার মুচলেকা দেওয়া সাভারকারের নামে। শুধুমাত্র তাই-ই নয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পার্লামেন্ট থেকে নাকি মুক্ত নয়া পার্লামেন্ট ভবনের উদ্বোধন হয়েছে সেই সাভারকারের জন্মদিনের তারিখেই। সাভারকার, যিনি মুচলেকায় মুক্তিপ্রাপ্ত, যিনি হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান-এর তত্ত্বে দেশের বহুত্ববাদকে বিনষ্টের তত্ত্ব দেন, যিনি ভাষাতাত্ত্বিক ইতিহাসের ভিত্তিতে ভাষার সৃষ্টিকে অস্বীকার করে (হিন্দি ও উর্দু একই ভাষা, হিন্দুস্তানির দুই ভিন্ন রূপ, সূত্র ODBL, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়) হিন্দিকে ‘জাতীয় ভাষা’ করার কথা বলেন হিন্দু, উর্দুর মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টির অভিপ্রায়ে, যিনি মেয়েদের ‘রান্না ও ঘরের কাজ’ই আসল কাজ বলে সংকীর্ণ পুরুষতান্ত্রিক ভাবনার পরিচয় রাখেন, যার আশীর্বাদধন্য গান্ধীহত্যাকারী নাথুরাম গডসে— সেই সাভারকারের (Veer Savarkar) নামেই বন্দর, সেই সাভারকারের বাণীই মোদিজির ‘মন কি বাত’-এ, সেই সাভারকারের জন্মদিনেই আইনসভার নবনির্মিত ভবনের উদ্বোধন এবং সর্বোপরি ইতিহাসের নামে নির্ভেজাল মিথ্যাচারের মাধ্যমে সাভারকারকে তাঁর জীবন আধারিত চলচ্চিত্রতে উজ্জ্বল করে দেখিয়ে দেশবাসীর কাছে বিকৃত ও বিক্রীত ইতিহাসকে প্রচার করা, এটাই হয়েছে কৌশল। একই সাথে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইতিহাসকে। ইতিহাসের সঙ্গে বিমিশ্রিত হচ্ছে পুরাণ এমনকী খানিকটা রূপকথার ঢঙে কাল্পনিকতাও। এই দামোদর সাভারকারকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয়েছে এমন কাহিনি। যেমন রাজ্যে সরকারে থাকাকালীন কর্ণাটকে স্কুলপাঠ্য বইয়ে পড়ানো হয়েছে ‘আন্দামানে সেলুলার জেলে থাকাকালীন সাভারকার নাকি বুলবুলি পাখির ডানায় চড়ে ভারতভ্রমণ করে আবার সেলের ছোট্ট কুঠুরিতে ফিরে যেতেন প্রতিদিন’। এটা শুধুই কল্পনার ডানায় ভর করে গড়ে তোলা রূপকথা নয়, আদতে শৈশব থেকেই একপ্রকার ‘সুপারহিরো’ বানিয়ে সাভারকারের (Veer Savarkar) মূর্তিটি শিশুহৃদয়ে স্থায়ীভাবে গড়ে তোলার এক সূক্ষ্ম কৌশল। ইতিহাসের চর্চা এবং তার সম্প্রসারণই পারে দেশবাসীকে এ-মিথ্যাচার থেকে সচেতন করতে। কিন্তু সে-কাজ ততটা সহজসাধ্য নয়, যতটা সহজ ‘WhatsApp University’র প্রোপাগান্ডাকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেওয়া।
১৯৩৮-র আমেরিকা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত দেশ তখন আরও এক বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে অবস্থিত। সে-সময়েই সেখানের নাগরিক পরিচিত হল এক কমিক সুপারহিরো ‘সুপারম্যান’-এর সঙ্গে। যে অতিমানব নাকি ঘায়েল করতে পারে জোরদার ‘দুশমন’কে। দিতে পারে স্বপন উড়ান। গোটা মার্কিন সমাজ বুঁদ হয়ে গেল সেই সুপারহিরোর মহিমায়। বিশ শতক পেরিয়ে এই বিশ্বায়িত দুনিয়ায় আজও উড়ছে এই সুপারহিরো। আমাদের বিপর্যস্ত রাষ্ট্র, যা রক্ষা করতে পারে না ছাত্র-যুব-শ্রমিক-কৃষক কাউকেই, যা মানে মানুষের মতপ্রকাশ, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারকে, যা দূরীভূত করতে পারে না দারিদ্র্যকে, ভারত যখন ‘হ্যাপি ইনডেক্স’-এ তলানিতে, তখন কখনও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদি, কখনও-বা এমন সাভারকার রূপে মানুষের কাছে নিজেকে জাহির করাতে চায় সুপারহিরো রূপে। মৌলিক প্রশ্নগুলো ছেড়ে যাতে তারা সেই ধর্মীয় বিদ্বেষ-বড়ি গ্রহণ করে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। দেশকে বশীভূত করার আরও এক সংযোজন এই সাভারকার অধ্যায়।
সাভারকারের পূজারিরা আজ দেশ চালাচ্ছে
সাভারকারকে সুপারহিরো বানিয়ে শিশুহৃদয়ে সেটির প্রতিষ্ঠা একটি সূক্ষ্ম রাজনৈতিক কৌশল। প্রকৃত ইতিহাসের চর্চা এবং তার সম্প্রসারণই পারে দেশবাসীকে এই মিথ্যাচারের কবল থেকে রক্ষা করতে। 'WhatsApp University'র প্রোপাগান্ডাকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেওয়া ওদের কাজ। সেটাও রুখতে হবে। লিখছেন তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক মৃত্যুঞ্জয় পাল