চন্দ্রযান-৩ (Chandrayaan-3) চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করল এমন একটা সময়ে যখন ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। চন্দ্রচূড় শব্দটির অর্থ চন্দ্র চূড়ায় অবস্থান করে যাঁর। সেজন্য চন্দ্রচূড়-এর শব্দার্থ শিব। এর পেছনে একটি পৌরাণিক আখ্যান বর্তমান।
চন্দ্র বহুপত্নীক। ২৭টি নক্ষত্র তাঁর পত্নী। বহু পত্নীক হওয়া সত্ত্বেও চন্দ্র তাঁর একজন পত্নীরই অনুগত। এই অন্যায় প্রীতিপক্ষপাতের কারণে তিনি ক্ষয়রোগগ্রস্ত।
অপর একটি পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, চন্দ্র ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হওয়ার অভিশাপ পেয়েছিলেন বৃহস্পতির পত্নী তারার প্রতি অবৈধ অনুরক্তির কারণে।
কারণ যা-ই হোক, ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হওয়ার অভিশাপের জন্য চন্দ্র আতঙ্কিত হয়ে পড়েন যে তিনি হয়তো ক্ষয় পেতে পেতে শেষ অবলুপ্ত হবেন। পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটবে তাঁর। এই আশঙ্কা থেকে মুক্তিলাভের উপায় জানতে চন্দ্র ছুটলেন দেবলোকে। সেখানে সবাই তাঁকে বললেন, একমাত্র শিব তাঁকে রক্ষা করতে পারেন। কারণ শিবের মস্তকোপরি গঙ্গার অধিষ্ঠান আর গঙ্গাই মৃতে প্রাণ সঞ্চার করতে সমর্থ।
দেবতাদের পরামর্শ অনুসারে চন্দ্র শিবের তপস্যা করতে বসলেন। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব গুজরাতের সোমনাথে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে আবিভূর্ত হলেন। নিজের মাথার জটায় স্থাপন করলেন চন্দ্রকে। ক্ষয়রোগে আক্রান্ত চন্দ্র সেখানে কলাবৃদ্ধির সুযোগ লাভ করল।
সোম হল যৌবন উদ্ধারকারী ওষধি। শিব যেহেতু ক্ষয়রোগীর রোগের উপশম ঘটাতে সক্ষম, সেহেতু সোমলতার সঙ্গে শিবকে এক করে দেখা হয়। তার জন্য শিবের আর এক নাম সোমেশ্বর। আর চন্দ্র ক্ষয়গ্রস্ত হয়েও তার কবল থেকে মুক্তিলাভে সক্ষম। তাই চন্দ্রের (Chandrayaan-3) আর-এক নাম সোম। সেই সোমকে মস্তকোপরি ধারণ করেন শিবশম্ভু। সেজন্যই তিনি চন্দ্রশেখর নামেও পরিচিত।
চন্দ্রের কলার হ্রাস-বৃদ্ধি, অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমায় অদৃশ্য অবস্থা থেকে পূর্ণাবয়বে প্রত্যাবর্তন এবং তারপর ফের ক্ষয়, এই পর্যায়বিন্যাস বুঝিয়ে দেয় যার বৃদ্ধি আছে তার ক্ষয়ও আছে, যেটার ক্ষয় হয় সেটার পুনঃবৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। মন্দির হোক বা গণতন্ত্র, সুশীল সমাজ হোক বা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, সর্বক্ষেত্রে এই হ্রাস-বৃদ্ধির নীতি প্রযোজ্য।
কিংবদন্তি অনুসারে, ছত্রপতি শিবাজি যিনি সপ্তদশ শতাব্দীতে মুঘল সাম্রাজ্যের শিরদাঁড়ায় কাঁপন ধরিয়ে ছেড়েছিলেন, তিনি কপালে চন্দ্রচিহ্ন ধারণ করতেন। এই চন্দ্রকলা একটি বিশিষ্ট ভাবনার প্রতীকরূপ। এটির মাধ্যমে শিবাজি জনগণকে বোঝাতে চাইতেন, অমাবস্যার আঁধার ঘনিয়েছে বলে হতাশ হয়ে বসে থাকলে চলবে না। স্বরাজ লাভের ভাবনা ত্যাগ করে হাল ছাড়লে চলবে না। অন্ধকার কেটে দিয়ে চন্দ্রকলার পুনর্বৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী। তাই, যোদ্ধাকে অমাবস্যার তিমির ধ্বান্ত প্রহরেও পূর্ণিমার আশা নিয়ে এগোতে হবে। ছত্রপতি শিবাজির সেই পরম্পরা মেনেই বীর মারাঠা নরনারী, তাঁদের রাজন্যবর্গ ও যোদ্ধারা, কপালে টিপের ওপর জঙ্গম চন্দ্রকলা অঙ্কন করে নেন।
অনেকেই মনে করেন চন্দ্রকলা ইসলামের প্রতীক। আসলে পাকিস্তান ও তুরস্কের পতাকায় চন্দ্রকলার উপস্থিতি এরকম ভাবনার কারণ। আসলে পঞ্চদশ শতাব্দীতে পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়া অধিগত করেছিল অটোমান সম্রাটরা। বাইজান্টিয়াম বিজয়ের পর অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি চন্দ্রকলা দিগন্তের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বিরাট চন্দ্রকলা তাঁর স্বপ্নের সাম্রাজ্যের প্রতীক। প্রায় চার শতাব্দী ধরে অটোমান সুলতানরাই ইসলামি জগতে খলিফার মর্যাদা পেয়ে এসেছেন। সেই থেকে ইসলামিক জগতে চন্দ্রকলার প্রতীক বিশেষ মান্যতা লাভ করে আসছে।
অটোমান সুলতান ওসমানের মতো ভারতীয় সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নামও চন্দ্রের সঙ্গে জড়িত। একটি জৈন লোকগাথা অনুসারে, চন্দ্রগুপ্তের মা চাঁদের জল খাওয়ার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন। সে-বাসনা মিটিয়েছিলেন চাণক্য। তিনি চন্দ্রগুপ্তের জননীর কণ্ঠে এমন ভাবে জল ঢেলেছিলেন যাতে সেই জলে চন্দ্রালোক প্রতিফলিত হয়।
হিন্দু রাজবংশে দুটি ধারা প্রতিষ্ঠিত— হয় হিন্দু রাজারা সূর্যবংশীয় নয় তাঁরা সোমবংশীয় অর্থাৎ চন্দ্রবংশীয়। রামায়ণে সূর্যবংশীয়দের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। মহাভারতে চন্দ্রবংশীয়দের আখ্যান কথিত হয়েছে। দক্ষিণ ভারতের যাদবরাজারা চন্দ্রবংশীয় রূপে প্রসিদ্ধ।
অনেকে অবাক হয়ে ভাবেন, রামচন্দ্রের নামের শেষে ‘চন্দ্র’ আছে। অথচ রাম নাকি সূর্যবংশীয় রাজা হন কীভাবে? কিংবদন্তী বলছে, রামচন্দ্র ছোটবেলা থেকে চন্দ্রের অনুরাগী ছিলেন। মা যতক্ষণ না তাঁকে জলের পাত্রে চাঁদের প্রতিবিম্ব দেখাতেন ততক্ষণ তিনি ঘুমোতে যেতেন না। তাঁর কাছেও চন্দ্র (Chandrayaan-3) মাতুলপ্রতিম ছিলেন। আমাদের মতো তাঁর কাছেও চাঁদমামা ছিলেন।
মুণ্ডাদের কাছে চাঁদ (Chandrayaan-3) কিন্তু মামা নন, স্বয়ং মা। জাতকের কাহিনি বলছে চাঁদের বাহন যে শশক বা খরগোশ তিনি আদতে বুদ্ধদেবের অবতার। অতীতে কোনও এক জন্মে বুদ্ধদেব শশক অবতারে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সেই খরগোশ আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। মানুষের ক্ষুধা-নিবৃত্তির প্রণোদনায়। তাঁর সেই আত্মোৎসর্গে প্রসন্ন হয়ে দেবতারা তাঁকে চাঁদের বাহন হিসেবে স্থায়ী জায়গা করে দেন।
এইসব কাহিনি নির্মাণ করে ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাস।
চন্দ্রযানের চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ নির্মাণ করল ভারতের বিজ্ঞান চেতনার ইতিহাস।
দুটোই আমাদের গর্বের বিষয়। দুটোই আমাদের আনন্দ দেয়।
কিন্তু বিজ্ঞানকে উপকথার সঙ্গে, লোকগাথার সঙ্গে মিশিয়ে দিলে পুরো বিষয়টা ঘুলিয়ে যায়। সেটাও মনে রাখা দরকার।
বিজ্ঞান লিখল ইতিহাস
এতদিন চাঁদকে নিয়ে বহু লোককাহিনি, পৌরাণিক কাহিনি, উপকথা রচিত হয়েছে ভারতে। চন্দ্রযান-৩ চন্দ্রপৃষ্ঠের কুমেরুতে অবতরণের সূত্রে সেইসব পুরাণ-পরান কথা শোনাচ্ছেন দেবাশিস পাঠক