কাবাব-বিপ্লব

নরম তুলতুলে জ্যুসি কাবাবের ঠেক ‘রোস্টেড কার্ট’। কসবার ফুটপাথে কাবাবপ্রেমীদের জন্য একটু টুকরো স্বর্গ। এই মহার্ঘ পদটিতে বিপ্লব ঘটিয়েছেন কর্ণধার দেবাংশু দে। মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে শুধু প্যাশনের টানে পেয়েছেন অবিশ্বাস্য সাফল্য। তাঁর সঙ্গে কথা বললেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

কসবার বোসপুকুর। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামলেই ম-ম করে কাবাবের সুগন্ধে। ভিড় জমে যায় ভোজন রসিকদের। রাস্তার ধারে ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে নেন গরমাগরম কাবাবের স্বর্গীয় স্বাদ। এককথায় দক্ষিণ কলকাতায় কাবাব-বিপ্লব ঘটেছে এখানকার ছোট্ট দোকান ‘রোস্টেড কার্ট’-এর মাধ্যমে। দেবাংশু দে-র হাত ধরে। বাঙালির ব্যবসা নিয়ে যাঁরা নাক কুঁচকোন, তাঁদের রীতিমতো ভুল প্রমাণ করেছেন মধ্যবিত্ত পরিবারের এই লড়াকু সন্তান। চেষ্টায় কী না হয়। গত পাঁচ বছরে দেবাংশু কাবাব বেচে পেয়েছেন অবিশ্বাস্য সাফল্য।

আরও পড়ুন-রোল কর্নার

তবে খুব সহজে হয়নি তাঁর উত্থান। স্কুল শিক্ষকের ছেলে তিনি। মা সাধারণ গৃহবধূ। পড়াশুনো করেছেন জুলজি নিয়ে। দেবাংশু চাকরি করতেন নামী বিজ্ঞাপন সংস্থায়, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপে। মোটা টাকার মাইনে। তবু একদিন ছেড়ে দিয়েছিলেন চাকরি। কেন? রোস্টেড কার্ট-এর সামনে দাঁড়িয়ে ক্লায়েন্ট সামলাতে সামলাতে হাসি মুখে দেবাংশু বললেন, ‘‘বিজ্ঞাপন সংস্থা এবং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজে মারাত্মক মানসিক চাপ। কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রবলেম ফেস করছিলাম। পাচ্ছিলাম না কোনওরকম অ্যাপ্রিসিয়েশন। সে যত ভাল কাজই করি না কেন। প্রশংসিত হচ্ছিল তারা, যারা পদলেহন করতে পারে। আমি অন্য মানসিকতার ছেলে। সবকিছু মেনে নিয়েই ১৩ বছর কাজ করে গিয়েছি। দাঁতে দাঁত চেপে। একটা সময় ভেতরে ভেতরে হতাশার জন্ম হচ্ছিল। তীব্র ভাবে। এই কারণে যে, এত পরিশ্রম করেও কোনও নাম পাচ্ছিলাম না। ক্লায়েন্টরা খুশি হলেও অফিস থেকে কোনওরকম বাহবা পাচ্ছিলাম না। দমবন্ধ হয়ে আসছিল। পারছিলাম না সেলফ স্যাটিসফায়েড হতে। সায় দিচ্ছিল না মন। একটা সময় চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কথা বলি স্ত্রীর সঙ্গে। সে স্কুলে পড়ায়। জানতে চায়, চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমি কী করতে চাই? বলি, ব্যবসা করব। চা বিক্রি করব। শেষমেশ চা নয়, কাবাব বেছে নিলাম।’’

আরও পড়ুন-তেলেভাজা থেকে মোমো

কাবাব কেন? দেবাংশু বললেন, ‘‘ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে রাস্তায় বেরোলেই নাকে আসত দোকান, রেস্টুরেন্টের লোভনীয় খাবারের মনমাতানো গন্ধ। বাবা বলতেন নাক বন্ধ করে যেতে৷ তখন বুঝিনি কারণটা। এখন বুঝি। পকেট পারমিট করত না বাবার। এটাও বুঝি— কিনে দিতে না পারার জন্য তখন কতটা খারাপ লাগত তাঁর। সেই দিনগুলোর কথা মনে রেখেই চালু করেছিলাম কাবাবের দোকান। আমি খাবারের বিষয়ে বরাবরই প্যাশনেট। তা ছাড়া কাবাব আমার খুব প্রিয়। একটা সময় ছিল রান্নার শখ। একদিন কপাল ঠুকে নেমে পড়লাম। ফুটপাথে চালু করলাম দোকান। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। ঠিক করলাম, আমার দোকানে খাওয়ার জন্য কাউকেই যেন পকেটের চিন্তা করতে না হয়। তখনও কিন্তু আমি চাকরি করি। অফিস এবং ব্যবসা পাশাপাশি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম।’’

আরও পড়ুন-রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে অচলাবস্থা তৈরি করছেন কে?

চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি স্ট্রিট ফুডের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়লেন কোন সময়? দেবাংশু জানালেন, ‘‘২০২০ সাল। এল করোনা অতিমারি। শুরু হল লকডাউন। অফিস থেকে জানানো হল, ওয়ার্ক ফ্রম হোম। স্যালারির ৪০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হবে। বললাম, আমি কাজ করব না। ছেড়ে দিলাম মোটা মাইনের চাকরি।’’
তারপর? ঘাম মুছতে মুছতে দেবাংশু বললেন, ‘‘তখন লকডাউন। দোকানও বন্ধ। ঘরে বসেই টুকটাক রান্না করতাম। ছবি দিতাম ফেসবুকে। চার-পাঁচ মাসে কাবাব বেচে আমার যে ক্লায়েন্ট বেস তৈরি হয়েছিল তাঁরা আমার পোস্ট দেখে রকমারি খাবার অর্ডার দিতে থাকলেন। সমস্ত খাবার বানিয়ে আমি নিজে পৌঁছে দিতাম। করোনা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসার পর আবার চালু করলাম দোকান। আগের মতো ক্লায়েন্টদের দিতে থাকলাম কাবাবের স্বাদ। সেই থেকে চলছে। ধীরে ধীরে ব্যবসা বেড়েছে। কসবার মূল দোকানের পাশাপাশি আরও তিনটি দোকান খুলেছিলাম। তৈরি করছিলাম বিরিয়ানি। চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। তবে সেই অভিজ্ঞতা ভাল হয়নি। সাহায্য পাইনি কর্মীদের। তাই বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। তারপর আরও বেশি মনোনিবেশ করলাম কাবাবে। একটা সময় আমার সাফল্য অনেকের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দোকানে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল আগুন। কিন্তু আমি হার মানিনি। পরের দিন খুলেছিলাম দোকান। তারপর দোকানের আনুষ্ঠানিক নামকরণ করা হয় রোস্টেড কার্ট। অর্থাৎ পোড়া গাড়ি।’’

আরও পড়ুন-পুজোর আগে সেজে উঠছে নিউ দিঘা

রোস্টেড কার্ট-এর ফ্র্যাঞ্চাইজি দেওয়া শুরু হয়েছে? দেবাংশু জানালেন, ‘‘হ্যাঁ, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমি ফ্র্যাঞ্চাইজি দিচ্ছি। প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি খোলা হয়েছে হাওড়া হাঁসখালি পোলে। কথা চলছে বেহালায়।’’
ঝুঁকি নিয়ে সফল হয়েছেন। হাসি ফুটেছে পরিবারের মুখে? হাসতে হাসতে দেবাংশু বললেন, ‘‘অবশ্যই। আমার স্ত্রী প্রথম থেকেই এই লড়াইয়ে ছিল আমার সঙ্গে। প্রথমদিকে মায়ের মৃদু আপত্তি ছিল। স্কুল শিক্ষকের ছেলে, ফুটপাথে হাত পুড়িয়ে রান্না করবে, মানতে পারেননি তিনি। পরে অনেকের কাছে আমার কাবাবের প্রশংসা শুনে মা এখন খুব খুশি। আছে আমার দুই সন্তান। সবাইকে নিয়ে এই মুহূর্তে আমি বেশ আছি। ভালই আছি। কাবাব বেচে কিনেছি গাড়ি। একটু একটু করে পূরণ করছি নিজের স্বপ্ন।’’

আরও পড়ুন-স্টেডিয়ামের নতুন পরিচালন কমিটি

আপনার ক্লায়েন্ট কারা? দেবাংশুর উত্তর, ‘‘সব বয়সিরাই আসেন আমার দোকানে। সব ধরনের মানুষ। কলেজ পড়ুয়া থেকে শুরু করে আইটি বা কর্পোরেট। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আসেন সমাজের বিশিষ্টজনেরাও। বহু সেলিব্রেটি বিভিন্ন সময় আমার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কাবাবের স্বাদ নিয়ে গেছেন। দক্ষিণ কলকাতার পাশাপাশি আসেন উত্তর কলকাতা, হাওড়া-সহ অন্যান্য জেলার মানুষ। এসেছেন বিদেশিরাও। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে আমার দোকানের নাম। সত্যি বলতে কী, এখানে সবাই আলাদা আনন্দ নিয়ে খান। সেটা আমি তাঁদের চোখে-মুখে দেখতে পাই। বুঝতে পারি, ফুটপাথে, খোলা আকাশের নিচে অদ্ভুত প্রাণ আছে। পাকা দোকান খুললে হয়তো সেটা হারিয়ে যাবে। তাই আমার এই ফুটপাথই ভাল। বছরের বারো মাস দিব্যি কেটে যাচ্ছে। কয়েকজন সহযোগী আছে। আমি নিজেও হাত লাগাই। কাবাব বানাই। পরিবেশন করি। ভাল লাগছে মধ্যবিত্তের সাধ মেটাতে পেরে।’’

আরও পড়ুন-মিজোরাম থেকে ফিরল আরও চার শ্রমিকের দেহ

রোস্টেড কার্ট-এ পাওয়া যায় যায় রকমারি আইটেম। টিক্কা কাবাব, টিক্কা মালাই কাবাব, পাহাড়ি কাবাব, হরিয়ালি কাবাব, শিক মালাই কাবাব, মাটন চাপলি কাবাব, চিকেন তন্দুরি প্রভৃতি। দারুণ চাহিদা। সন্ধে থেকে পড়ে যায় লম্বা লাইন। ভিড় থাকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত। জিভে জল আনা খাবার। রকমারি দাম। সবটাই মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে। রেগুলার আইটেমের সঙ্গে প্রতিদিন থাকে কিছু স্পেশাল আইটেম। দেবাংশু জানালেন, ‘‘কাবাবের পাশাপাশি বিরিয়ানি লঞ্চ করতে চাই। ইউনিক বিরিয়ানি। নতুন ধরনের কিছু। আমার বিশ্বাস সেটাও কাবাবের মতোই চলবে। খাবার নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছি। এটা আগামী দিনেও চালিয়ে নিয়ে যাব। আসলে আমি নিজে একজন ভোজনবিলাসী। খেতে খুব ভালবাসি। তবে অন্যদের খাইয়ে যে কী আনন্দ সেটা এখন বেশ অনুভব করছি।’’

Latest article