রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে অচলাবস্থা তৈরি করছেন কে?

রাজ্য জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অঙ্গনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। এর পিছনে কে কলকাঠি নাড়ছেন ? সেই উত্তরের খোঁজে প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. শিবরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

Must read

কয়েকদিন আগে নতুন প্রতিষ্ঠিত মফসসল শহরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক আধিকারিক অসহায়ভাবে ফোন করে জানালেন, ৩১ মে, ২০২৩ উপাচার্য চলে যাওয়ার পর নতুন উপাচার্য নিয়োগ করা হয়নি। ফলে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা জুন মাস থেকে বেতন পাননি। উক্ত চুক্তিভিত্তিক আধিকারিকের কার্যকালের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। ওই শূন্যপদে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবার কেউ নেই। অপর একটি মফসসল ভিত্তিক বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জানালেন, বহু গবেষকের পিএইচডি-র মৌখিক পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাঁদের ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়া সম্ভব হয়নি, কারণ উপাচার্যের চূড়ান্ত অনুমোদন আবশ্যক। উপাচার্য পদটি শূন্য থাকার ফলে গবেষকরা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। এই ধরনের অনেক অনিশ্চয়তা ও অসুবিধা চলছে।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

রাজ্যের কলেজগুলিতে স্নাতকস্তরে ভর্তির প্রক্রিয়া প্রায় সমাপ্তির মুখে। বহু সংখ্যক কলেজে অনেক আসন ফাঁকা পড়ে আছে। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে উদ্বেগের কথা। প্রায় সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কলেজগুলিতে পরীক্ষা চলছে। এই শিক্ষাবর্ষ থেকে স্নাতকস্তরে চার বছরের পাঠ্যক্রম চালু হয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ্যক্রম চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি, কারণ উপাচার্য নেই ও কার্যনির্বাহী কমিটির (Executive Council) বৈঠক ডাকা যাচ্ছে না। এই সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কলেজ প্রশাসনে সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখা। কিন্তু সেটা ব্যাহত হচ্ছে, কারণ রাজ্যের বিশ্ববিদ্যলয়গুলিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে চলছে বরং বলা যায় অচলাবস্থা সৃষ্টি করানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন-সুবিধা পোর্টাল শুরু করেই রাজ্য জিতে নিল কেন্দ্রের স্বর্ণপদক

রাজ্য সরকার অনুদানপ্রাপ্ত বহু সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য-বিহীন। অর্থাৎ পাইলট ছাড়া বিমান চলছে। যেখানে তথাকথিত অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করা হয়েছে, সেইসমস্ত ক্ষেত্রে নির্বাচিত রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনও পরামর্শ করা হয়নি। এইসব তথাকথিত অস্থায়ী উপাচার্যরা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। তাঁরা জানেন না কতদিন এই পদে থাকতে পারবেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-উপাচার্যকে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করা হল। তারপর তাঁকে অকস্মাৎ অপসারণ করা হল। কিছুদিন উপাচার্যহীন থাকার পর (যে সময়ের মধ্যে বিরলতরর মধ্যে বিরলতম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে গেল) ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন-লজ্জায় ফেলে দিল ওপেন থিয়েটার

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে অচলাবস্থা চলতে থাকলে, তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া কলেজগুলির উপর পড়তে বাধ্য। কলেজগুলি বহুলাংশে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া, অভিযোগ হল, যাঁদের তথাকথিত অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করা হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশেরই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন নির্ধারিত যোগ্যতা নেই। কর্নাটক হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করা হয়েছে। কেরল পুলিশের জনৈক অবসরপ্রাপ্ত মহানির্দেশক আধিকারিককে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মাননীয় বিচারপতি অবশ্যই আইন বিশারদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। অবসরপ্রাপ্ত মহানির্দেশক নিশ্চয়ই দক্ষ পুলিশ আধিকারিক এবং আশা করি, বিদগ্ধ ব্যক্তি। কিন্তু উপাচার্যের দায়িত্ব নেবার নির্ধারিত যোগ্যতা এঁদের আছে কি?

আরও পড়ুন-লড়াই করেও হার প্রণয়ের

সম্প্রতি মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত ব্যাপারে একটি রায় দিয়েছে। এই রায় সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করছি না। এই রায়কে মান্যতা দিয়েও আমার মনে হয়েছে, তথাকথিত অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের দরকার ছিল কি? আমার বোঝার ভুল থাকলে আমি সংশোধিত হতে রাজি আছি। বিষয়টি একটু বিশ্লষণ করছি। উল্লেখ করছি, ‘‘West Bengal State Universities (Terms and Conditions of Service of the Vice-Chancellors and the Manner and Procedure of Official Communication) Rules, 2019”। এই বিধি (Rules) কার্যকর হওয়ার তারিখ হল ০৯.১২.২০১৯। এই বিধির ৩ নম্বর ধারার ৪ নম্বর উপধারা এখানে প্রাসঙ্গিক। উপাচার্য যদি না থাকেন, ছুটি নিতে পারেন, অসুস্থ থাকতে পারেন বা অন্য কোনও কারণ থাকতে পারে, যেমন, তিনি পদত্যাগ করেছেন অথবা তাঁর কার্যকালের মেয়াদ শেষ হয়েছে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুসারে পরবর্তী উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। তখন কী হবে?

আরও পড়ুন-পাঞ্জাবে বিবাদ চরমে: রাষ্ট্রপতি শাসনের হুমকি রাজ্যপালের!

উল্লিখিত ৪ নম্বর উপধারায় চারটি বিকল্পের কথা বলা হয়েছে—
(১) বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্যকে দায়িত্ব দিতে হবে।
(২) অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-উপাচার্য পদ নেই। তখন রাজ্য সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত পার্শ্ববর্তী কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা সহ-উপাচার্যকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। তবে রাজ্য সরকারের অনুমোদন বাধ্যতামূলক।
(৩) যদি এটাও সম্ভব না হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বরিষ্ঠতম (seniormost) ডিনকে (Dean) দায়িত্ব দেওয়া হবে।
(৪) তৃতীয় বিকল্পটি কার্যকর করা সম্ভব না হলে শেষ বিকল্প হল, বিশ্ববিদ্যালয়ের বরিষ্ঠতম অধ্যাপককে (‘প্রফেসর’ পদমর্যাদার) এই দায়িত্ব দেওয়া হবে। অবশ্যই উচ্চশিক্ষা বিভাগকে জানাতে হবে।

আরও পড়ুন-পুজোর আগে সেজে উঠছে নিউ দিঘা

তাহলে আলাদা করে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের প্রয়োজন ছিল কি? ৫ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, এই সমস্ত অস্থায়ী উপাচার্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিছক ‘রুটিন’ (Routine) কাজ করবেন। এ ছাড়া তাঁরা রাজ্য সরকারের আগাম অনুমতি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট, সিনেট, পরিচালন সমিতি, এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল সিন্ডিকেট প্রভৃতির বৈঠক ডাকতে পারবেন না। খবর আছে, কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের বৈঠক হয়েছে। রাজ্য সরকারের আগাম অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কি? না হয়ে থাকলে এই বৈঠকগুলি পুরোপুরি অবৈধ।
(পরবর্তী অংশ আগামিকাল)

Latest article