‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ নাটকে জুলিয়েটের সংলাপে শেক্সপিয়র লিখেছিলেন, ‘‘What’s in a name? That which we call a rose by any other name would smell just as sweet” (নামে কী আসে যায়? গোলাপকে যে নামেই ডাকে তা সুমিষ্ট গন্ধ ছড়ায়)।
দোশটাকে (Bharat vs India) যে নামেই ডাকে, দেশটার হাল কি বদলাবে?
এখন কথা হল, নয়া নামটা এল কোত্থেকে?
হোয়াট্সঅ্যাপ-এ একটা গল্প খুব ছড়াচ্ছে।
রামায়ণী কথার অঙ্গরূপে একটি কাহিনি। একদা এক রাজকন্যা ছিলেন যাঁর নাম ইন্দু বা ইন্দুমতী। তাঁর ভাই বিদর্ভরাজ ভোজ। তিনি তাঁর সহোদরার জন্য স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করলেন। ইন্দু তাঁর পতি হিসেবে বেছে নিলেন অযোধ্যার রাজা অজকে। এই অজ আর ইন্দুমতীর সন্তান হলেন দশরথ। এই দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীরামচন্দ্র। কৌশল্যার সন্তান। দ্বিতীয় পত্নী কৈকেয়ীর পুত্র ভরত। কৈকেয়ী দশরথের সিংহাসনে ভরতকে বসাতে চেয়েছিলেন। ভরত তাঁর সেই ষড়যন্ত্র প্রক্রিয়ার শরিফ হতে চাননি। জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে শ্রীরামচন্দ্র অযোধ্যার সিংহাসনে বসে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই ভরত থেকেই নাকি ভারত নামের উৎপত্তি। শ্রীরামের রাজ্য ‘ভারত’ নাম অর্জন করেছিল শুধু একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। ভারত (Bharat vs India) হল সেই ভূমি যেখানে সিংহাসনের জন্য ভ্রাতৃঘাতী বিরোধ হয় না।
এখনানেই শেষ নয়। হিন্দুত্ববাদী গুজব অতি ভয়ানক। সেই গুজব অনুসারে ‘ভা’-এর অর্থ ‘আলো’ আর ‘রত’-এর অর্থ ‘প্রার্থনা’। তাই ‘ভারত’-এর অর্থ আলোর জন্য প্রার্থনা। ‘আরও আলো আরও আলো, এই নয়নে, প্রভু, ঢালো’— রবীন্দ্র সংগীতের এই বাণী মূর্ত হয়েছে ‘ভারত’ নামে। প্রচারগুরুদের আর এক অংশের দাবি, ‘ভাব’, ‘রাগ’ আর ‘তাল’-এর আদ্য অক্ষরের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে ‘ভারত’ নামটি। উল্লেখ্য, নাট্যশাস্ত্রের আদি গুরু ছিলেন ‘ভরত’। ‘ভারত’ নামটি ‘ভরত’-এর সঙ্গে যুক্ত।
বিষ্ণুপুরাণ বলছে— ‘‘উত্তরং যদ্ সমুদ্রস্য হিমাদ্রিশ্চ দক্ষিণম। বর্ষং তদ্ ভারত নামঃ ভারতী যত্র সন্ততি।।”
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা প্রথম লিপিবদ্ধ হয় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে। মহাকাব্য মহাভারতে সেই যুদ্ধবৃত্তান্ত বর্ণিত। সেখানেই বলা আছে দুষ্ম্যন্ত-শকুন্তলার পুত্র ভরতের কথা। দুষ্ম্যন্ত চন্দ্রবংশীয় রাজা। শকুন্তলার পিতা কৌশিক ছিলেন সূর্যবংশীয়। ভরত তাই চন্দ্র ও সূর্য, উভয় বংশীয় উত্তরাধিকারের সমন্বয় বিন্দু। এহেন ভরত যে রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করলেন সেটি ভারত বংশ নামে প্রসিদ্ধি অর্জন করল আর তাঁর শাসনাধীন ভূমি পরিচারিত হল ভারতবর্ষ নামে।
অর্থাৎ ‘ভারত’ নামে ‘ভরত’-যোগ আছে, এটা পৌরাণিক সত্য। রামায়ণ এবং মহাভারত, উভয় মহাকাব্যেই ভরত চরিত্র বর্তমান। মহাভারতের ভরতের সঙ্গে ভারতের যোগের কথা আগে শোনা যায়নি। এখন রামরাজ্যের সূত্রে হোয়াটসঅ্যাপে ভেসে বেড়াচ্ছে, তবে, মহাভারতীয় ভরতের সঙ্গে ভারতের যোগের কথা বহুকাল ধরে প্রত্যয়িত একটি বিষয়।
ইন্ডিয়া নামটির উদ্ভব হল মূলত মেগাস্থেনিসের সূত্রে। আজ থেকে প্রায় ২,৩০০ বছর আগে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভায় উপস্থিত হলেন গ্রিক পর্যটক মেগাস্থেনিস। তিনি তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখলেন যে-দেশটি তিনি পর্যটন করছেন, সেটির নাম ইন্ডিয়া (Bharat vs India), যে-নদীর জলধারায় দেশটি পুষ্ট, সেটার নাম ইন্ডাস, গ্রিকরা সিন্ধকে ইন্দ এবং সিন্ধু নদকে ইন্ডাস উচ্চারণে অভিহিত করত। অর্থাৎ, ইন্ডিয়া নামটি এল পুরাণ নয়, ইতিহাসের সূত্র ধরে।
মেহাস্থেনিস তাঁর পর্যটন বৃত্তান্ত ‘ইন্ডিকা’ রচনার প্রায় দুশো বছর পর আনুমানিক খ্রিস্ট-পূর্ব ১০০ অব্দে, ওড়িশার হাতিগুম্ফায় জৈন রাজা খারবেলের প্রস্তরলিপি বা গুহালিপিতে ‘ভারতবর্ষ’ নামটি ইতিহাসের অনুমোদন পেল। সেই গুহালিপিতে ‘ভারতবর্ষ’ বলতে খারবেল বুঝিয়েছেন মগধ অর্থাৎ অধুনা বিহারের পশ্চিমে গাঙ্গেয় উপত্যকাটিকে।
আরও পড়ুন-রেজিস্ট্রারদের সঙ্গে আজ ব্রাত্যর বৈঠক, যাবেন না বলছে রাজভবন!
পারসিকদের উচ্চারণে এই ভূমি সিন্ধু নদের জলে পুষ্ট হওয়ার কারণে ‘হিন্দ’ বলে পরিচিত হল। আর সেই ‘হিন্দ’ যখন চিনা ভাষায় লিখিত হল, তখন সেটির নাম দাঁড়াল ‘তিয়ানঝু’ (‘সিন্ধু’র সঙ্গে ধ্বনিসাযুজ্য বজায় রেখে)।
এই নাম-নামা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট।
পুরাণ থেকে আগত ‘ভারত’ নামটি গ্রহণ করা হবে না-কি বিদেশিদের দেওয়া নাম ‘ইন্ডিয়া’ নামটি গ্রাহ্য হবে তা নিয়ে সংবিধান পরিষদ বা গণপরিষদে বিস্তর বাক্বিতণ্ডা হয়েছে। এমনকী এইচ ভি কামাথ ‘India, that is Bharat, shall be a union of states’— এই শব্দবন্ধের পরিবর্তে ‘Bharat, or in the English language, India shall be a union of states’ লেখার দাবি তুললে, সেই দাবি গণপরিষদে খারিজ হয়ে যায়।
অর্থাৎ, স্পষ্টতই, প্রভূত যুক্তি-তর্কের পর, আলাপ-আলোচনার পর ‘ভারত’ ও ‘ইন্ডিয়া’ দুটো নামই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
আমাদের নাম আমরা কেউ ঠিক করিনি। বাবা, মা, দাদু, দিদিমার দেওয়া নাম আমরা বহন করছি আমাদের পরিচিতি-চিহ্ন হিসেবে।
সুতরাং অন্যের দেওয়া নাম দেশের নাম হিসেবে মেনে নিতে আমাদের কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়।
আমাদের শুধু দু-তিনটি জিজ্ঞাসা।
বিগত আট দশকে পারস্য, বার্মা, কম্বোডিয়া, সিলোন, রোডেশিয়া প্রভৃতি দেশ নিজেদের নাম বদলেছে। কিন্তু এই দেশগুলোর বেশির ভাগেই ক্ষমতায় ছিল রাজতন্ত্র অথবা সামরিক শাসন। প্রথম জিজ্ঞাসা, দেশের নাম বদলাতে চাওয়া মোদি সরকার কোন শ্রেণিভুক্ত? রাজতন্ত্র না সামরিক শাসন?
দ্বিতীয় জিজ্ঞাসা, ইন্ডিয়ার বদলে স্রেফ ভারত নামটিকে বেছে নিলে সিবিআই কিংবা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার নাম বদলে সিবিবি আর আরবিবি হয়ে যাবে?
তৃতীয় জিজ্ঞাসা, দেশের নাম বদলালে কি মুদ্রাস্ফীতি কমে যাবে? দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে? বেকারত্ব কমবে? যদি এগুলোর উত্তর ‘না’ হয়, তবে এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এত হইচই করে লাভ কী?
লাভ তো আসলে একটাই। দেশের মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে ভোটের বাজারে সরকারের ক্ষয়িষ্ণু জনপ্রিয়তার প্রভাব পড়তে না-দেওয়া। হ্যাঁ! শুধু এটার জন্যই এতকিছু।