সৌদি-কন্যা তিনি
‘রায়ানাহ বার্নাউই সৌদি-কন্যা। এই মুহূর্তে গোটা বিশ্ব জানে তাঁর কথা। কয়েকমাস আগে সংবাদমাধ্যমে উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘সৌদি-সহ এ-অঞ্চলের প্রথম নারী-নভোচারী হতে পারাটা আমার জন্য খুবই সম্মানের বিষয়, খুবই আনন্দের। এই মিশনের অংশ হতে পেরে আমি খুবই খুশি।’’ কে এই রায়ানাহ বার্নাউই (Rayyanah Barnawi)? কী তাঁর পরিচয়? কেন এত উচ্ছ্বাস? তাঁর বক্তব্যে সেটা কিছুটা স্পষ্ট হলেও পুরোটা হয়নি। কিন্তু নারীর মহাকাশ যাত্রা তো আজ আর নতুন ঘটনা নয় তাহলে!
আসলে ইতিহাস গড়ে ফেলেছেন রায়নাহ। কারণ তিনিই হলেন সৌদি আরবের প্রথম মহাকাশচারী নারী যিনি গবেষণার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে। চলতি বছরের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার দক্ষিণপ্রান্তে স্থিত কেপ ক্যানাভেরালের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের দিকে পাড়ি দিয়েছিল মিশন অ্যাক্সিওম-২ এবং সেই মিশনের সদস্য রায়ানাহ। এই মিশনটির আয়োজক হল মার্কিন মুলুকেরই বেসরকারি মহাকাশ সংস্থা অ্যাক্সিওম স্পেস। তবে সৌদি আরব থেকে তিনি একা নন। রায়ানাহ ছাড়াও ছিলেন সৌদি আরবেরই আরও এক নভোচারী আলি আল ক্কারনি। ক্কারনি সৌদির দ্বিতীয় পুরুষ যিনি মহাকাশে গেলেন। তাই সৌদি আরবের ইতিহাসে এই ঘটনা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। আরও এক অদ্ভুত বিষয় হল অ্যাক্সিওম-২ মিশনের পরিচালনার দায়িত্বেও রয়েছেন আরও এক নারী যাঁর নাম পেগি হুইটসন। তাই বলা যেতে পারে আজ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল— সর্বত্র নারীরই জয়জয়কার।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে চর্চিত বার্নাউই
তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে চর্চিত শুধুই বার্নাউই (Rayyanah Barnawi)। কারণ স্পেস-এক্সের ফ্যালকন নাইন রকেটে চড়ে বার্নাউই মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছনোর মুহূর্ত থেকেই প্রথম সৌদি আরবের মহিলা মুসলিম মহাকাশচারী হয়ে ইতিহাস তৈরি করে ফেলেছেন তিনি। তবে তিনি কিন্তু মহাকাশে যাওয়া বিশ্বের প্রথম মুসলিম নারীর কৃতিত্বটি পাননি তাঁর কারণ হল আনুশেহ আনসারি। ইরানি-আমেরিকান এই মহাকাশচারী হলেন বিশ্বের প্রথম মহাকাশে যাওয়া মুসলিম নারী। দশ বছর আগে মহাকাশ পর্যটক হয়ে শিরোনামে এসছিলেন আনসারি। যা-ই হোক সৌদি আরবের জন্য এটি এক অনবদ্য সাফল্যের সূচক তো বটেই গোটা দেশের নিরিখেও।
রায়ানাহর সফর সঙ্গীরা
২০১৮ সালে সৌদি আরব সৌদি স্পেস কমিশন প্রতিষ্ঠা করে। এর আগে সৌদির একজন নভোচারীই মহাকাশ অভিযানে গিয়েছিলেন। তাঁর নাম প্রিন্স সুলতান বিন সালমান বিন আবদুল আজিজ। সেটা ছিল ১৯৮৫ সাল। সেই সৌদি স্পেস কমিশনই এই মিশনটির পরিচালনায় রয়েছে। প্রসঙ্গত, সৌদির কোনও নভোচারী বা মহাকাশচারী এই প্রথম স্পেস স্টেশনের কক্ষপথ পরীক্ষাগারে গেলেন। যে দু’জন গেলেন তাঁদেরই একজন হলেন রায়ানাহ বার্নাউই। তিনি ছাড়া অপরজন নভোচারী হলেন আলি আল-ক্কারনি। তিনি দ্বিতীয় সৌদি পুরুষ হিসেবে এই মিশনে গেলেন। ৩১ বছরের এই মহাকাশচারী রয়্যাল সৌদি এয়ারফোর্সের একজন ক্যাপ্টেন। কিং ফয়সাল এয়ার অ্যাকাডেমি থেকে অ্যারোনোটিক্যাল সায়েন্সে স্নাতক। তিনি মিশন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এঁরা ছাড়া অ্যাক্সিওম মিশন ২-এর সঙ্গে রয়েছেন অপর দুই সদস্য পেগি হুইটসন এবং জন শফনার।
নারী-নভোচারী হিসেবে পেগির সুনাম কম নয়। মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার একজন প্রাক্তন মহাকাশচারী। নাসা চিফ অ্যাস্ট্রোনট হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। পেশায় গবেষক এই নিয়ে চতুর্থবার আইএসএসে গেলেন। মার্কিন নভোচারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় মহাকাশে কাটানোর রেকর্ডটি তাঁর এবং একজন নারী হিসেবেও। পেগি ছিলেন মিশন কমান্ডারের দায়িত্বে। আর শফনার পেশায় ব্যবসায়ী। তিনি পাইলট হিসেবে কাজ করছেন মাত্র ১৭ বছর বয়স থেকে। এখন পর্যন্ত সাড়ে ৮ হাজার ঘণ্টারও বেশি সময় কাটিয়েছেন আকাশে। সম্পন্ন করেছেন ৩ হাজার স্কাইডাইভ এবং বেজ জাম্প। ছোটবেলাতেই তিনি নবীন নভোচারীদের জন্য ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন।
কক্ষপথে পৌঁছে রায়ানাহ বলেন, ‘‘হ্যালো! আমি মহাকাশ থেকে বলছি। ক্যাপসুলে বসে পৃথিবী দেখার অনুভূতি অতুলনীয়।’’
আরও পড়ুন- চাঁদমুখী ক্রিস্টিনা
মহাকাশে তাঁদের গবেষণা
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে এই চারজন প্রায় ৮ দিন থেকে কুড়িটি পরীক্ষা চালিয়েছেন যার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল ওজনহীন পরিস্থিতিতে স্টেম সেল কীভাবে কাজ করে, তা পর্যবেক্ষণ করা। এখানে জেনে রাখা জরুরি যে আইএসএসের (ISS) পরিবেশ আসলে পুরো ওজনহীন নয়। একে বলা হয় মাইক্রোগ্র্যাভিটি। অর্থাৎ, আইএসএসের ভেতরে মহাকর্ষের প্রভাব এত কম অনুভূত হয় যে মনে হয় ওজনহীন পরিবেশ। এ পরিবেশেই তাঁরা এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। এ ছাড়াও এই চারজনের দলটি করেছেন আরও গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা। যেমন মহাকাশে থাকা অবস্থায় মানব-স্বাস্থ্যের ওপর প্রতিক্রিয়া ও ‘ক্লাউড সিডিং টেকনোলজি’র মতো বিভিন্ন জটিল বিষয় নিয়েও সেখানে তাঁরা গবেষণা করেছেন।
ফ্যালকন ৯ রকেটের মাথায় বসানো স্পেসএক্সের ড্রাগন নভোযানে করে অ্যাক্সিওম মিশন-২-এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে গেলেন সৌদি আরবের কোনও নারী। তাই প্রথম নারী নভোচারী হিসেবে বার্নাউই (Rayyanah Barnawi) সমগ্র সৌদি-নারীদের কাছে হয়ে উঠেছেন অনুকরণীয়।
বিদুষী নভোচারী
অত্যন্ত বিদুষী এই নভোচারী রায়ানাহ বার্নাউই। তাঁর জন্ম ১৯৮৮ সালে সৌদি আরবের জেদ্দাতে। ৩৩ বছর বয়সি রায়ানাহ পেশায় একজন বায়োমেডিক্যাল গবেষক। বার্নাউই নিউজিল্যান্ডের ওটাগো ইউনিভার্সিটি থেকে জেনেটিকস, রিপ্রোডাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিষয়টি নিয়ে স্নাতক হয়েছেন। এরপর তিনি রিয়াদের আলফাইসাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সে স্নাতকোত্তর পাঠ সমাপ্ত করেন। তার প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্যানসার স্টেম সেল নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি এখানে এটি নিয়ে গবেষণারত। রায়ানাহ অ্যাক্সিওম মিশন ২-এর নভোচারী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার সময় সৌদি আরবের কিং ফয়সাল স্পেশালিস্ট হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে কর্মরত ছিলেন।
বার্নাউই এই অভিযানে যাওয়ার পর
আইএসএসে থাকাকালীনই তাঁদের সমস্ত অভিজ্ঞতা শিশুদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘‘মহাকাশে নিজ অঞ্চল থেকে যাওয়া নভোচারীদের দেখার পর শিশুদের প্রতিক্রিয়া দেখাটা আমার জন্য বেশ রোমাঞ্চকর হবে।’’
সফল প্রত্যাবর্তন
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ১০ দিন বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পর নভোচারীরা গত ৩১ মে সফলভাবে আবার ফিরে আসেন ফ্লোরিডাতে। তাদের স্পেসক্রাফট স্পেসএক্সের ক্রু ড্রাগন ক্যাপসুল ফ্লোরিডার মেক্সিকো উপসাগরের উপকূলীয় শহর পানামা সিটিতে অবতরণ করে। মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে ফিরতে তাঁদের সময় লেগেছিল প্রায় ১২ ঘণ্টা অর্থাৎ অর্ধেক দিন।
ড্রাগন ক্যাপসুলের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ‘থাম্পস আপ’ দেখিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন সফল বার্নাউই (Rayyanah Barnawi)। সেখানে উপস্থিত অন্যদের সহায়তায় ক্যাপসুল থেকে একে একে নেমে আসেন চার নভোচারী। এরপর তাঁরা হেলিকপ্টারে আরোহণ করেন। উড়োজাহাজে করে তাঁদের কেপ কানাভেরালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাঁরা তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হন।
মহাকাশ মিশনে সৌদি আরবের কোনও নারীর যুক্ত হওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা যা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে কারণ তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশটিতে নারী-অধিকার বা নারীদের অবস্থান উল্লেখনীয় ছিল না। মাত্র কয়েকবছর আগে সৌদি আরবের মেয়েরা পেয়েছে গাড়ি চালানোর অধিকার।