চাঁদমুখী ক্রিস্টিনা

পৃথিবী থেকে নয়, একদম চাঁদের সামনে থেকে চাঁদকে দেখবেন তিনি। আগামী বছর নভেম্বর মাসে তিনজন পুরুষ মহাকাশচারীর সঙ্গে প্রথম মহিলা হিসাবে চন্দ্রাভিযানের সফরসঙ্গী হবেন তিনি। তিনি হচ্ছেন ক্রিস্টিনা হ্যামক কোচ। তাঁকে নিয়েই লিখলেন কাকলি পাল বিশ্বাস

Must read

চাঁদের দেশে পাড়ি
এখনও পর্যন্ত চাঁদের কক্ষপথে অথবা চাঁদের পৃষ্ঠে শুধুমাত্র পুরুষ মহাকাশচারীরাই তাঁদের আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। কিন্তু এখন সেই আধিপত্যে ভাগ বসাতে এসে গেছেন ক্রিস্টিনা কোচ (Christina Hammock Koch)। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে তিনজন পুরুষ মহাকাশচারীর সঙ্গে চন্দ্রাভিযানে শামিল হচ্ছেন তিনি। এই চন্দ্রাভিযানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন তিনি।

কে এই ক্রিস্টিনা
১৯৭৯ সালের ২৯ জানুয়ারি মিশিগানের গ্র্যান্ড র‍্যাপিডসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ক্রিস্টিনা (Christina Hammock Koch)। নর্থ ক্যারোলাইনার জ্যাকসনভিলেতে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই ক্রিস্টিনার স্বপ্ন ছিল মহাকাশচারী হওয়ার। ১৯৯৭ সালে নর্থ ক্যারোলিনা স্কুল অফ সায়েন্স অ্যান্ড ম্যাথমেটিক্স থেকে স্নাতক হন ক্রিস্টিনা। এরপরে নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও পদার্থবিদ্যায় স্নাতক পাশ করেন তিনি। পরবর্তীকালে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর করেন তিনি। ২০০১ সালে নাসা অ্যাকাডেমি প্রোগ্রামে যোগ দেন ক্রিস্টিনা।

নাসায় যোগ দেওয়ার আগে
নাসায় যোগ দেওয়ার আগে মহাকাশ প্রযুক্তি এবং সরঞ্জাম তৈরির কাজে নিযুক্ত ছিলেন ক্রিস্টিনা। আমেরিকার যে আন্টাকর্টিকা অভিযান হয়েছিল সেই অভিযানেও অংশ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। পুরো এক বছর তিনি আমেরিকার গবেষণা কেন্দ্র পামার স্টেশন যেটা আন্টাকর্টিকায় অবস্থিত সেখানে কাটিয়েছিলেন। এরপরে তিনি জন্স হকিংস ইউনিভার্সিটির অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স ল্যাবরেটরির মহাকাশ গবেষণা বিভাগে যোগ দেন। এরপর আরও একবার তিনি আন্টাকর্টিকায় ফিরে যান। এরপর ২০০১ সালে নাসা অ্যাকাডেমি প্রোগ্রামে যোগ দেন এবং সেখানে তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কর্মরত ছিলেন।

নাসায় নিযুক্ত ক্রিস্টিনা
২০১৩ সাল। শুরু হয় নাসার ২১তম মহাকাশ অভিযান ক্লাস। সেই ক্লাসের আটজন সদস্যের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ক্রিস্টিনা। ২০১৫ সালে তাঁদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়। এরপরে ২০১৯ সালে প্রথমবার ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে যাওয়ার সুযোগ পান ক্রিস্টিনা। তাঁকে প্রথম সয়ুজ এম এস টুয়েলভ (MS-12) মহাকাশযানে বাইকোনুর কসমোড্রোন থেকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল। নাসার মত অনুযায়ী ৫৯ ৬০ এবং ৬১ অভিযানের জন্য আইএফএস-এ ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করা, এবং জীববিজ্ঞান পৃথিবীবিজ্ঞান, মানব-গবেষণা, ভৌতবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নয়নে অনেক অনেক পরীক্ষার অবদান রেখেছেন ক্রিস্টিনা এবং তাঁর ক্রুমেটরা।

মহাকাশচারীর কর্মজীবন
২০১৩ সালে ক্রিস্টিনা (Christina Hammock Koch) নাসাতে মহাকাশচারী গ্রুপ ২১-এর অংশ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর এটাই তাঁকে ভবিষ্যতে মহাকাশ মিশনের উপলব্ধ করে তোলে। তাঁর এই মহাকাশচারী হওয়ার জন্য যে যে প্রশিক্ষণ হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত ব্রিফিং, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন সিস্টেমে নিবিড় নির্দেশনা, স্পেসওয়ার্ক, রোবটিক্স, শারীরবৃত্তীয় প্রশিক্ষণ, টি-৩৮ ফ্লাইট প্রশিক্ষণ এবং জল ও মরুভূমিতে বেঁচে থাকার প্রশিক্ষণ।
২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মার্চ অভিযান ৫৯,৬০ ও ৬১-এর একজন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যাত্রা করেন ক্রিস্টিনা। তিনি এবং জেসিকা মেয়ার প্রথম মহিলা ছিলেন যাঁরা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের বাইরে অবস্থিত একটি ডাউন পাওয়ার কন্ট্রোল ইউনিট প্রতিস্থাপন করার জন্য ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ অক্টোবর একটি সর্ব মহিলা স্পেসওয়াকে অংশ নেন। ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল বাণিজ্যিক ক্রু ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের সঙ্গে পুনরায় নিয়োগ হওয়ার কারণে ক্রিস্টিনা এই মিশনটি দু’ হাজার কুড়ির ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। তিনি ৩২৮ দিন স্পেসে থাকার পরে ২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীতে ফিরে আসেন। হিসাব অনুযায়ী ক্রিস্টিনা যে-সময় ধরে মহাশূন্যে ভেসে ছিলেন সে-সময়ের মধ্যে ৫২৪৮ বার পৃথিবীর নিজের প্রদক্ষিণ এবং পৃথিবী থেকে চাঁদে ২৯১ বার যাতায়াত হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই ক্রিস্টিনা মহাকাশের স্বপ্ন দেখতেন। ৩২৮ দিন স্পেসে থাকার দরুন সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তাঁর।
তবে তিনি শুধুমাত্র মহাকাশচারী হিসাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করেননি। আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন তথা ISS-এ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজও তাঁকে করতে হয়েছে। তিনি সারাই করেছেন খারাপ হয়ে যাওয়া পাওয়ার কন্ট্রোল ইউনিট আর এর কারণে তাঁকে সাত ঘণ্টা মহাকাশ স্টেশনের বাইরে কাটাতে হয়েছিল। আর এই সময় তাঁর সঙ্গী ছিলেন জেসিকা মেয়ার। এই জেসিকা মেয়ার এবং ক্রিস্টিনা কোচই ছিলেন প্রথম জুটি যাঁরা কোনও পুরুষসঙ্গী ছাড়াই আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে সময় কাটিয়ে ছিলেন। তাঁরা দু’জনেই ছিলেন আত্মনির্ভরশীল। আর এটা ছিল তাঁদের অন্যতম অভিজ্ঞতা। তিনি ৪২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট স্পেস ওয়াক করেছিলেন। এরপর পৃথিবীতে ফিরে আসার পর নাসার অফিসেই কাজ করেছিলেন তিনি এবং এখনও করছেন। আর এ-বারই তিনি শামিল হতে চলেছেন চন্দ্রাভিযানে। আর এরপরেই তাঁর মুকুটে নতুন পালক জুড়ে যাবে।

আরও পড়ুন- তীব্র ভূমিকম্প মরোক্কোয়, মৃত ২৯৬, ক্ষতিগ্রস্ত বহু বাড়ি

ব্যক্তিগত জীবন
ক্রিস্টিনা কোচ-এর স্বামীর নাম রবার্ট কোচ। ক্রিস্টিনা তাঁর স্বামীর সঙ্গে টেকটাসে থাকেন। ক্রিস্টিনা ভালবাসেন রক ক্লাইম্বিং করতে, প্যারা গ্লাইডিং করতে, ব্যাকপ্যাকিং করতে। এছাড়াও তিনি যোগব্যায়াম, কমিউনিটি সার্ভিস, ফটোগ্রাফি, সার্ফিং ঘুরে বেড়াতে অর্থাৎ ভ্রমণ করতে ভালবাসেন। এ-ছাড়াও তিনি বাইকিং করতে খুব ভালবাসেন।

পুরস্কার এবং সম্মাননা
ক্রিস্টিনা অনেক অ্যাওয়ার্ডই পেয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নাসা গ্রুপ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, মহাকাশচারী স্কলার, অ্যাস্ট্রোনট স্কলারশিপ ফাউন্ডেশন। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তাঁকে নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডক্টর অফ সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছিল।
এছাড়াও বহু পুরস্কার এবং সম্মাননায় তিনি ভূষিত হয়েছিলেন।

চন্দ্রাভিযানে শামিল হবেন তিনি
প্রথম মহিলা মহাকাশচারী হিসেবে চাঁদ পাড়ি জমানো যতটা রোমাঞ্চকর ঠিক ততটাই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এই ঝুঁকিপূর্ণ রোমাঞ্চকর অভিযানটিতে সুযোগ পেয়ে প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত ক্রিস্টিনা। এরকম একটি সুবর্ণসুযোগ পেয়ে তিনি সম্মানিত বোধ করছেন। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রকেটে চেপে তাঁরা চাঁদে পাড়ি জমাচ্ছেন। আগামী দিনে মহাকাশ বিজ্ঞানকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় নাসা। আর সেই কারণে তাঁদের আগামী পদক্ষেপ আটেমিস টু (Artemis 2) অভিযান। দশ দিনব্যাপী এই অভিযানের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ক্রিস্টিনা কোচকে। তাঁর সঙ্গে এই অভিযানে আরও তিনজন আছেন। তাঁরা হলেন ভিক্টর গ্লোভার, গ্রেগরি রিড ওআইজম্যান এবং কানাডার জেরেমি হানসেন।
ক্রিস্টিনা-সহ এই তিনজন মহাকাশচারী চাঁদের বুকে পা রাখবেন না। তবে তাঁরা চারজন চাঁদেরই চারপাশে ঘুরে বেড়াবেন। খুব কাছ থেকে চাঁদকে প্রত্যক্ষ করবেন। স্পেস স্টেশন থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিগত পরীক্ষা তাঁরা করবেন। আর এই পরীক্ষাগুলো আগামিদিনে চন্দ্রাভিযানের পথ আরও সুগম করবে বলে আশা রাখছে নাসা। ২০২৪ সালের নভেম্বরের রওনা দেওয়ার কথা ক্রিস্টিনাদের। এই অভিযান শেষ করে তাঁরা আবার ফিরে আসবেন পৃথিবীর বুকে।

Latest article