বাঙালির শ্রীরাম আর মোদিজির রাম-রসায়ন কিন্তু এক নয়

শ্রীরামচন্দ্রকে সামনে রেখে রামনবমীর দিন ব্যাপক হারে দাঙ্গা বাধানোর যে পরিকল্পনা কুভেন্দু- কুকান্ত-শোভিত বঙ্গ-বিজেপির ছিল, সেটা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। হতাশ বঙ্গ-বিজেপির রঙ্গমঞ্চ। কেন এই ব্যর্থতা? কেন রামনামেও বাঙালিকে তরঙ্গায়িত করা গেল না, তা বিশ্লেষণ করে দেখলেন সাংসদ জহর সরকার

Must read

মোদিজি হয়তো এটা দেখে খানিকটা বিস্মিতই হয়েছেন যে, জানুয়ারি মাসে রামমন্দির নির্মাণকে কেন্দ্র করেই হোক, কিংবা এই এপ্রিলে রামনবমীকে ঘিরেই হোক, বাঙালিকে তেমনভাবে উৎসাহিত হতে দেখা গেল না। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে এসব নিয়ে যেমন উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের ছবি তদ্বিপরীত। বঙ্গ-বিজেপি চেষ্টার খামতি রাখেনি। খোলা তলোয়ার প্রদর্শন থেকে শুরু করে আগ্রাসী শোভাযাত্রা, বাদ ছিল না কিছুই। তবু যেন সাধারণ বাঙালি তাতে ভীত কিংবা মুগ্ধ হল না। আসলে চৈত্র ও বৈশাখে বাঙালি নানা উৎসব পালন করে থাকে। এই উৎসবগুলোর সব ক’টাই কেবল হিন্দুত্বের পরিধিতে আবদ্ধ নয় এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই বঙ্গে উদযাপিত হয়ে আসছে।
বাংলার নিজস্ব দুর্গাপুজো তো আছেই। তার সঙ্গে আছে অন্নপূর্ণা পুজো। দেবী অন্নপূর্ণাও মা দুর্গারই আর একটা রূপ। রবিশস্য তোলার মরশুমে অনুষ্ঠিত হয় বাসন্তী পূজা, এই বাংলাতেই। গ্রীষ্ম-বর্ষার পাঁচটি মাস শস্যের সরবরাহ যাতে নিরবচ্ছিন্ন থাকে, সেই প্রার্থনায় পূজিতা হন অন্নদাত্রী দেবী অন্নপূর্ণা। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রান্তে অন্নদাত্রী দেবীর পূজা হয় শীতে, বঙ্গে সেখানে তিনি বসন্তে পূজা পান। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে এই সময়ে নীল ষষ্ঠী বা অশোক ষষ্ঠী ব্রত পালন করা হয়। লক্ষণীয়, উত্তর ও পশ্চিম ভারতে যখন রামনবমী পালন করা হয়, বাংলায় সেসময় রাম নন, বাসন্তী বা অন্নপূর্ণা পূজিতা হন। একইভাবে শারদীয় অকালবোধনে বাংলায় পুজো পান দেবী দুর্গা, তাঁর পূজক রাম নন। এই দুর্গাপূজা বা বাসন্তী পূজার সময় উত্তর ও পশ্চিম ভারতে পালিত হয় নবরাত্রি, সেসময় ব্রত পালনকারীরা নিরামিষ খাবার খান। বাংলায় দুর্গোৎসব বা বাসন্তী পূজার সময় নিরামিষই খেতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
এটা স্পষ্ট যে বাঙালিরা সবসময়ই দেশের বাকি অংশের থেকে আলাদা আর এজন্যই বোধহয় উনিশ শতকের বাংলা আধুনিক ভারতের অগ্রদূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, ভেঙেছিল জাতপাত, পুরাতন প্রথা আর প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার প্রাচীর। এজন্যই বাংলার ধর্ম-সংস্কৃতি দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় পৃথক। এটা বোধ করি খুব ভালভাবে বোঝা যায় শিব-সংক্রান্ত ভাবনা-চিন্তায়। অধিকাংশ ভারতীয়ের কাছে শিব হলেন চঞ্চলচিত্ত এক রাজার মতো। তিনি শাসন করেন কৈলাস থেকে। বাঙালি কবির ভাবনায় শিব সেখানে চিরবস্ত্র পরিহিত এক কৃষকমাত্র যিনি দুর্গা বা পার্বতীর রাগের মুখে পড়ে বকুনি খান, তিরস্কৃত হন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এসময় বাংলার নানা জায়গায় বিভিন্ন কৌমগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মানুষ শিব-পার্বতী সেজে সারা চৈত্র মাস ভিক্ষা চাইতে চাইতে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়, বাংলায় পালিত হয় তার নিজস্ব গাজন উৎসব যেখানে আত্মনির্যাতন তুঙ্গে পৌঁছায়।
সাম্প্রতিক অতীত দেখা গিয়েছে নরেন্দ্র মোদি প্রশ্ন তুলেছেন, কেন তেজস্বী যাদব রামনবমী পালনের মরশুমে আমিষ ভক্ষণ করেছেন। উত্তর ভারতের হিন্দি বলয় এবং পশ্চিম ভারতের গুজরাত ও তার আশেপাশের এলাকায় ভোটদাতাদের প্রভাবিত করার লক্ষ্যেই মোদিজির এই ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন, সন্দেহ নেই। এটাও বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেন দেশের এই অঞ্চলেই এই রামনবমীর সময়ে রেকর্ড সংখ্যক ১৯টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। ১৯৭৯-এ জামশেদপুর থেকে শুরু করে ২০২৩-এ ভালগাঁও, নালন্দা, সোনিপাত-এ এরকম সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত বছর হাওড়াও এরকম সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সাক্ষী থেকেছে। আর এরকম ঘটনা ঘটাবার জন্যই নির্বাচনের আগে মোদিজিদের মেরুকরণ দরকার হয়ে পড়ে।
তবে মোদিজি বুঝতে পারছেন না এসব করে তিনি দেশটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। উনি যদি ভালমতো খোঁজখবর করতেন কিংবা একটু পড়াশোনা করতেন, তাহলেই জানতে পারতেন, ভারত সরকারের সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের প্রায় ৬৫ থেকে ৭৫ শতাংশ মানুষ রোজ কিংবা প্রায়ই আমিষ ভক্ষণ করে থাকেন। ২০১১-’১২-তে ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভের ৬৮তম প্রতিবেদন, ২০১৫-১৬-র জাতীয় পরিবার সমীক্ষা-৪ এবং ২০১৯-২০-র ওই একই সমীক্ষার ৫ প্রতিবেদন, ২০১৪-র ওই সিডি-একত্রও উপাত্ত, রেজিস্টার জেনারেল অব ইন্ডিয়া ২০১৮-র তথ্য, ইন্ডিয়া-স্পেন্ড-এর ২০১৮-র তথ্য ইত্যাদি ওই পরিসংখ্যানটিকেই সমর্থন করেছে। প্রসঙ্গত, এসব তথ্য প্রকাশ্যে আনার জন্য জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিরেক্টরকে চাকরি খোয়াতে হয়েছে। রামকে বারবার তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে মোদি বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি হিন্দি বলয় ও তদ্-সন্নিহিত এলাকায় আদৌ স্বস্তিতে নেই। পূর্বভারত, দাক্ষিণাত্য, গোয়া, কাশ্মীর, পাঞ্জাব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে কখনও সেভাবে বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে বসন্তে রামনবমী কিংবা শারদীয় নবরাত্রি পালিত হয় না। তাঁরা যেটা করেন সেটা হল নিজেদের মতো করে নয়টি রাত্রী উদযাপন পাণ্ডবানি গান-বাজনা, খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি এই উদযাপনের অঙ্গ, সেখানে রামচন্দ্র সদা অনুল্লেখিত। উত্তর কিংবা পশ্চিম ভারতের মতো এই সময়ে ওইসব অঞ্চলে নিরামিষ খাওয়ার প্রচলনও নেই।
পরিশেষে একটা কথা মোদিজি ও তাঁর ভক্তকুলকে মনে করিয়ে দেওয়া অবশ্যক, বাংলা কোনও দিন শ্রীরামচন্দ্রের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল নয়, বাংলা সবধর্ম, সকল দেবদেবীর প্রতিই শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু তা বলে ধর্মোন্মাদদের হুঙ্কার কিংবা তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বা ভাষাগত দাপট শুনতে বা সহ্য করতেও বাংলা অভ্যস্ত নয়।

Latest article