বরণীয়-স্মরণীয় রচনাসম্ভার

প্রায় একুশ বছর ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ সম্পাদনা করেছেন ঠাকুরবাড়ির বধূ হেমলতা দেবী। সমসাময়িক উল্লেখযোগ্য কবি-লেখকরা প্রায় সকলেই লিখেছেন। প্রচার ছিল কম, ফলে বহু লেখাই থেকে গেছে আড়ালে। সম্প্রতি স্মরণীয় লেখাগুলো এক খণ্ডে একত্রিত হয়েছে। পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়। প্রকাশিত হয়েছে ‘বঙ্গলক্ষ্মী নির্বাচিত রচনা সংগ্রহ’। মূল্যবান সংকলনটির উপর আলোকপাত করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্ত। লোকরঞ্জক ছড়া ও সংগীতের মাধ্যমে তিনি এই আন্দোলনকে জনমুখী করেছিলেন। জাগিয়ে তুলেছিলেন স্বদেশানুরাগ। তাঁর স্ত্রী সরোজনলিনী দেবীও সমাজ-উন্নয়নমূলক নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে সরোজনলিনী প্রয়াত হন। তাঁর স্মরণে গুরুসদয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘সরোজনলিনী দত্ত নারীমঙ্গল সমিতি’। এই সমিতি নারী, শিশু, সমাজ ও দেশের উন্নতির জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছে। সমিতির মুখপত্র ছিল ‘বঙ্গলক্ষ্মী’। সমিতি-সংবাদ নিয়মিত ছাপা হলেও সেটা ছিল নির্ভেজাল সাহিত্য পত্রিকা। সমকালের নামী কবি-লেখকদের সাহিত্যসম্ভারে ‘বঙ্গলক্ষ্মী’র প্রতিটি সংখ্যা হয়ে উঠেছিল অপরিহার্য।

আরও পড়ুন-নারীশক্তি আর লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের জয়-জয়কার

পত্রিকার সূচনাকালে সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন কুমুদিনী বসু। তিনি স্কুল-কলেজে পড়েছেন। বড় হয়েছেন সাহিত্যের আবহাওয়ায়। লিখেছেন কয়েকটি বই। সেইসময় ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ পত্রিকার জন্য কলম ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর আশিসবাণী। কুমুদিনী মাত্র দেড় বছর পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছেন।
এটা স্পষ্ট, ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ সেই অর্থে ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা নয়। তবু নিবিড়ভাবে ছিল ছিল ঠাকুরবাড়ির যোগ। কারণ পরবর্তী সময়ে ঠাকুরবাড়ির বধূ হেমলতা দেবী একটানা প্রায় একুশ বছর পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছেন। সাফল্যের সঙ্গে এতদিন ধরে একটি পত্রিকার সম্পাদনা তিনি ছাড়া ঠাকুরবাড়ির আর কেউ করেননি। হেমলতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্রবধূ, দ্বিপেন্দ্রনাথের স্ত্রী। রাজা রামমোহন রায়ের বংশের মেয়ে। ষোল বছর বয়সে দ্বিপেন্দ্রনাথের স্ত্রী হিসেবে ঠাকুরবাড়িতে আসেন। তিনি ছিলেন স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী। দ্বিপেন্দ্রনাথের প্রথম স্ত্রী সুশীলা ছিলেন সকলের খুব প্রিয়। তাঁর অকালমৃত্যু ঠাকুরবাড়িতে এক শূন্যতা তৈরি করে। হেমলতার পক্ষে কাজটা কঠিন ছিল। কিন্তু নিজস্ব ভঙ্গিতে তিনিও সকলের মনে জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলেন। জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়িতে এসেই তিনি সুশীলা আর দ্বিপেন্দ্রের দুই সন্তানের মা হয়ে উঠেছিলেন। নিজের কোনো সন্তান ছিল না। তবু তিনি ছিলেন সকলের বড়োমা। পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্নেহ। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ইংরেজি শেখাতেন। পড়াতেন স্কটের উপন্যাস, কিটসের কবিতা।

আরও পড়ুন-বিদেশে গিয়ে বিপাকে দু’ভাই আবেদন মুখ্যমন্ত্রীর দরবারে

ঠাকুরবাড়ির বধূমাতার সম্পাদনায় প্রকাশিত, তাই ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ পত্রিকায় পরিবারের লেখকদের লেখা বহু সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তো বটেই, পাশাপাশি লিখেছেন দ্বিজেন্দ্রনাথ, ক্ষিতীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, সরলা, ইন্দিরা, ব্রতীন্দ্রনাথ, অমিতা ঠাকুর এবং আরও কেউ কেউ। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে ‘বঙ্গলক্ষ্মী’র প্রত্যক্ষ যোগাযোগের ফলে পত্রিকাটি বাড়তি সমীহ আদায় করেছিল। গুরুসদয়ের প্রভাব সমাজজীবনে, এমনকী লেখকমহলেও কম ছিল না, তিনি নিজেও লিখতেন। তাই ভাল লেখা পেতে কোনো কালেই অসুবিধা হয়নি। সমসাময়িক উল্লেখযোগ্য কবি-লেখকরা প্রায় সকলেই লিখেছেন।
সূচনাপর্বে ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ সেইভাবে নিজস্বতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারেনি। হেমলতার কালে ‘বঙ্গলক্ষ্মী’র পাতায় পাতায় সোনার ফসল ভরে উঠেছিল।

আরও পড়ুন-বাংলার শিক্ষাবিদদের অপমান করলেন আচার্য, তোপ ব্রাত্যর

সেই সময়কালে ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু অসামান্য লেখা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকলন ‘বঙ্গলক্ষ্মী নির্বাচিত রচনা সংগ্রহ’ সম্পাদনা করেছেন পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। এ যেন এক অসাধ্যসাধন। কারণ, ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ মূলত ছিল একটি সংগঠনের মুখপত্র। ফলে পত্রিকাটি কখনওই প্রচার সংখ্যায় ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’ বা ‘বিচিত্রা’র সমগোত্রীয় হয়ে উঠতে পারেনি। প্রচার সংখ্যা যথেষ্ট কম ছিল। বহু স্মরণীয় লেখাই থেকে গেছে আড়ালে। সংকলন-সম্পাদক জানিয়েছেন, ‘‘খুবই দুর্লভ-দুষ্প্রাপ্য এই ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ পত্রিকা। হাতে গোনা কয়েকটি প্রাচীন লাইব্রেরিতে বিচ্ছিন্নভাবে দু-চার বছরের আছে। কোথাও পুরো সংগ্রহ নেই। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন লাইব্রেরিতে অনুসন্ধানের পর জীর্ণ বাঁধানো খণ্ডগুলি নেড়েচেড়ে দেখার, পড়ার সুযোগ হয়েছে। পত্রিকা-পৃষ্ঠায় অনাদরে পড়ে থাকা বিপুল সংখ্যক স্মরণীয় রচনা বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে। মনে হয়েছে এই স্বর্ণসম্ভার বৃহত্তর পাঠকের হাতে পৌঁছে দেওয়া জরুরি।”
পুরোনো সাময়িকপত্র নিয়ে সম্পাদক মহাশয় অনুসন্ধিৎসু। আগেও এই ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। বহু পুরোনো ও হারানো পত্রিকা ও দুর্লভ গ্রন্থ পুনরুদ্ধার করে সম্পাদনা করেছেন। হারানো সম্পদ উদ্ধারের পাশাপাশি সাময়িকপত্র ও শিশুসাহিত্যের ইতিহাসও রচনা করেছেন।

আরও পড়ুন-দেশ-বিদেশের বিমানবন্দর

৩৬৬ পৃষ্ঠর ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ নির্বাচিত রচনা সংগ্রহে মুদ্রিত হয়েছে জলধর সেন, দীনেশচন্দ্র সেন, হেমলতা দেবী, সরোজনাথ ঘোষ, সুনয়নী দেবী, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, এস ওয়াজেদ আলী, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল, সজনীকান্ত দাস, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় প্রমুখের গল্প। পত্রিকায় এক লেখকের একাধিক মনে রাখার মতো রচনা প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থিত করা হয়েছে স্মরণীয় লেখাটি। এক-একটি গল্প এক এক-রকমের।
আছে কয়েকটি মূল্যবান প্রবন্ধ। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিপিনচন্দ্র পাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুখলতা রাও, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের লেখা।
কবিতা বিভাগটিও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। সেই সময়ের কে লেখেননি? আছেন প্রসন্নময়ী দেবী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, কামিনী রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, মোহিতলাল মজুমদার, কালিদাস রায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, নজরুল ইসলাম, প্রমথনাথ বিশী, সুনির্মল বসু, রাধারাণী দেবী, জসীমউদ্দীন, অন্নদাশঙ্কর রায়, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

আরও পড়ুন-কিন্নরের বিয়ে

এছাড়াও আছে সরলা দেবী চৌধুরানী, গুরুসদয় দত্ত, সরোজনলিনী দত্ত, সুধাকান্ত রায় চৌধুরীর স্মৃতিকথা এবং বন্দে আলী মিঁয়া, হাসিরাসি দেবীর নাটক। এককথায় বরণীয়-স্মরণীয় রচনাসম্ভার। পত্রিকার কোন সংখ্যায় প্রকাশিত, প্রতিটি লেখার সঙ্গে আছে সেই উল্লেখ।
অবহেলায় হারিয়ে যায়নি মণিমুক্ত। আমাদের অহংকার, আমাদের ঐতিহ্য পরম যত্নে গ্রন্থিত করেছেন সম্পাদক। এক খণ্ডে একত্রিত করেছেন অসামান্য লেখাগুলো। অনেক কাজের পাশাপাশি এই কাজটির জন্য বাংলা সাহিত্য তাঁকে মনে রাখবে। প্রচ্ছদশিল্পী সুব্রত মাজী। দীপ প্রকাশন প্রকাশিত সংকলনটির দাম ৫৫০ টাকা।

Latest article