চলন্ত ট্রেনের কামরায়
ছুটছে ট্রেন। ডিহিরি জংশন লাইনের উপর দিয়ে। তখন জায়গাটা ছিল বিহারে। বর্তমান ঝাড়খণ্ডে। পেরিয়ে চলছে শহর, পেরিয়ে চলছে গ্রাম। হঠাৎ প্রসববেদনা উঠল ট্রেনের যাত্রী সুবর্ণলতা দেবীর। শালবন ঘেরা গুজন্ডি স্টেশনের কাছে পৌঁছতেই চলন্ত ট্রেনের কামরায় তিনি জন্ম দিলেন এক ফুটফুটে কন্যাসন্তানের। দিনটি ছিল ১৯২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। পৃথিবীর আলো দেখামাত্র সুতীব্র চিৎকারে কেঁদে উঠল প্রি-ম্যাচিওর বেবিটি। নাকি গেয়ে উঠল! কারণ কন্যাটি পরবর্তী সময়ে সুচিত্রা মিত্র নামের অধিকারিণী হবেন এবং গানের জন্য চিরস্থায়ী আসন পাবেন অগণিত শ্রোতার মনে। যদিও বাবা প্রথমে নাম রেখেছিলেন নন্দিনী। ‘রক্তকরবী’র নন্দিনীকে মনে রেখে।
আরও পড়ুন-সংবিধান বিরোধী বিলের প্রতিবাদে সরব তৃণমূল
চাক্ষুষ করার সুযোগ পাননি
গুজন্ডি স্টেশনের কাছে জন্ম। তাই আপনজনেরা ডাকতেন ‘গজু’বলে। বাবা ছিলেন বিশিষ্ট লেখক-অনুবাদক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়। কবি কৃত্তিবাস ওঝার উত্তরপুরুষ। পৈতৃক বসত ছিল উত্তর কলকাতার হাতিবাগান অঞ্চলে। সুচিত্রা পড়াশোনা করেছেন কলকাতার বেথুন কলেজিয়েট স্কুলে। স্কুল শুরুর আগে প্রার্থনাসঙ্গীত হিসেবে গাইতে হত রবীন্দ্রনাথের গান। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল সৌরীন্দ্রমোহনের। সেই আবহেই সুচিত্রারও বেড়ে ওঠা। সুর ছিল গলায়। ছোটবেলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার হাতেখড়ি পঙ্কজ মল্লিকের কাছে। তার পরে সঙ্গীতভবনের বৃত্তি পেয়ে শান্তিনিকেতনে যান। তখন তিনি সতেরো। তবে রবীন্দ্রনাথকে চাক্ষুষ করার সুযোগ পাননি সুচিত্রা। তিনি শান্তিনিকেতনে পা দেওয়ার অল্পদিন আগেই প্রয়াণ ঘটে কবির। রবীন্দ্রনাথকে না দেখার আক্ষেপ তাঁকে সারাজীবন কুরে কুরে খেয়েছে। সঙ্গীতভবনে চার বছর ডিপ্লোমা কোর্স করেন ছিপছিপে, বুদ্ধিমতী, সপ্রতিভ, চঞ্চল সুচিত্রা। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ইন্দিরাদেবী চৌধুরানি, শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে। ১৯৪৫ সালে ফিরে এসে কলকাতার স্কটিশ চার্চ-এ শুরু করেন কলেজে বিএ পড়া। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাশ করেন গ্র্যাজুয়েট হওয়ার ১৫ বছর বাদে। ১৯৬২ সালে।
আরও পড়ুন-শনিবার সকালে লাইনচ্যুত কল্যাণী সীমান্ত-মাঝেরহাট লোকাল
শান্তিনিকেতনের শিক্ষা
জীবনের মন্ত্র ছিল একলার। একলা লড়াইয়ের। অপরকে আনন্দ দেবার জন্য গান গাইতেন না। তিনি জানতেন, নিজে আনন্দ পেলে নিশ্চিত অপরকে তা আনন্দ দেবে। রবীন্দ্রনাথের দুঃখের গান তাঁকে অভিভূত ও আকর্ষণ করত বেশি। কারণ সে দুঃখ তো দুঃখ নয়, এক আশ্চর্য উত্তরণ। রবীন্দ্রনাথের দুঃখের গান তাঁকে জীবন চিনতে শেখাত, মনকে সুদৃঢ় করে তুলত। জীবনে এসেছে বহু ঝড়ঝাপটা। থেকেছেন অবিচল। নিজের পথ থেকে সরেননি কখনও। বরং বেঁচেছেন নিজের মতো। নিজের শর্তে। আসলে প্রকৃতি, উন্মুক্ততা, রুচি, সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ— সব কিছু নিয়ে শান্তিনিকেতনের জীবন গভীর ছাপ ফেলেছিল তাঁর মননে, জীবনে। চিরদিন সেই স্মৃতি সযত্নে লালন করেছেন। সঙ্গীতভাবনায় শান্তিনিকেতনের শিক্ষা, বিশেষত শান্তিদেব ঘোষের উদাত্ত, প্রাণবন্ত গায়নশৈলী সুচিত্রাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। সেখানেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের আর এক দিকপাল, আশ্রম-কন্যা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বেরও সূচনা। যা তাঁরা লালন করেছিলেন আজন্ম। গানের পাশাপাশি শান্তিনিকেতনে তিনি নানা বাদ্যযন্ত্র শিখেছেন। যেমন সেতার, এসরাজ, তবলা। দুই বছর নিয়েছেন নাচের তালিম। ধ্রুপদী সঙ্গীত শিখেছেন ভি ভি ওয়াঝেলকরের কাছে।
আরও পড়ুন-ইডির ভারপ্রাপ্ত অধিকর্তা হিসেবে রাহুল নবীনকে নিয়োগ করল কেন্দ্র
পরস্পরের বন্ধু
অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন ধ্রুব মিত্র। তাঁর সঙ্গে সুচিত্রা পরিচিত হন বড় দিদি সুজাতাদেবীর মাধ্যমে। কিছুদিন চুটিয়ে প্রেম। তারপর বিয়ে। তাঁদের বিবাহিত জীবন টিকেছিল সাত-আট বছর। যদিও ব্যক্তিগত জীবনে সুচিত্রা এবং ধ্রুবর যোগাযোগের সুতো কোনওদিন ছিন্ন হয়নি। ছিলেন পরস্পরের বন্ধু। কুণাল তাঁদের একমাত্র সন্তান। সুচিত্রা দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কর্মজীবন শুরু হয় প্রভাষক হিসাবে। তারপর পদোন্নতি পেয়ে রিডার হয়েছেন, অধ্যাপক হয়েছেন এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগের প্রধান হিসেবেও কাজ করেছেন৷ তাঁর প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত বিদ্যালয় ‘রবিতীর্থ’ জন্ম দিয়েছে বহু কৃতী সঙ্গীতশিল্পীর।
আরও পড়ুন-মাদ্রিদে প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে ঘরোয়া মেজাজে মুখ্যমন্ত্রী
গান প্রাণ পেত
সুচিত্রা মিত্রর গায়কি ছিল স্বতন্ত্র। কণ্ঠ মাধুর্যের সঙ্গে ছিল এক ধরনের দৃঢ়তা। রবীন্দ্রসঙ্গীতে তাঁর উচ্চারণ, স্বরক্ষেপণ আদর্শ হয়ে উঠেছিল। তাঁর কণ্ঠে গান প্রাণ পেত। রবীন্দ্রসঙ্গীতের তুলনারহিত প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছিলেন তিনি। অগণিত শ্রোতার কাছে। পাশাপাশি গেয়েছেন অতুলপ্রসাদের গান, ব্রহ্মসঙ্গীত, আধুনিক বাংলা গান এবং হিন্দি ভজন। ১৯৪৫ সালে একুশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম গানের রেকর্ড বের হয়। সেটা ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড। দ্বিতীয় রেকর্ডটি তাঁর বাবার লেখা গান। এরপর তাঁর সাড়ে চারশোরও বেশি রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বের হয়েছে। বেশ কিছু চলচ্চিত্রেও গান গেয়েছেন। ভালবাসতেন উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করতে। ছবি আঁকা এবং ছড়া লেখার প্রতিও ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। পাশাপাশি অভিনয়ও করেছেন। নাটকে, চলচ্চিত্রে। বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সুচিত্রার অনুরোধে হেমন্ত বেশ কিছু গীতিনাট্যে অংশগ্রহণও করেছেন। অনেকের অনুরোধ সত্ত্বেও প্রথমে হেমন্ত কৃষ্ণকলি গানটি রেকর্ড করতে চাননি ‘সুচিত্রার গান’ বলে। পরে অবশ্য হেমন্ত রেকর্ড করেছিলেন আর উদ্বোধন-অনুষ্ঠানে সেই গান শুনে সুচিত্রার সে কী কান্না!
আরও পড়ুন-বাংলায় ইস্পাত কারখানা করেছি আপনারাও লগ্নি করুন : সৌরভ
অসংখ্য মানুষের মনে
১৯৭৩ সালে পদ্মশ্রী সম্মান পান। ১৯৮৬ সালে পান সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার। এ ছাড়াও পেয়েছেন দেশিকোত্তম, আলাউদ্দিন পুরস্কার। সাম্মানিক ডি-লিট পেয়েছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ২০১১-র ৩ জানুয়ারি সুচিত্রা মিত্র চলে যান না-ফেরার দেশে। ৮৬ বছর বয়সে।
রবীন্দ্রনাথের গানকে গীতবিতানের বাইরে এনে ব্যক্তির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন সুচিত্রা মিত্র। যতদিন ছিলেন আনন্দের সঙ্গে পথ চলেছেন। পথ-চাওয়াতেই ছিল তাঁর আনন্দ। আজও তিনি রয়েছেন অসংখ্য মানুষের মনে।
আরও পড়ুন-কুলদীপের না খেলার সুযোগ নিল বাংলাদেশ, শাস্ত্রী বললেন
মায়ের মতো
রবিতীর্থে সুচিত্রা মিত্রের কাছে তালিম নিয়েছেন সঙ্গীতশিল্পী অনিতা পাল। তিনি ডুব দিলেন স্মৃতিচারণায়, ‘‘১৯৭৯-র ৯ মার্চ। তখন আমার ১৫ বছর বয়স। সন্ধেবেলায় সুচিত্রাদির সুইনহো স্ট্রিটের বাড়িতে প্রথম যাই। তিনি আমার গান শোনেন। সেদিন থেকেই আমি তাঁর ছাত্রী। প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে যাওয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত আকুলতা থাকত। যেন উড়ে উড়ে যেতাম। ধীরে ধীরে বড় হয়েছি। সুচিত্রাদির পরিচালনায় ‘তাসের দেশ’ নৃত্যনাট্যে অংশ নিয়েছি দিল্লিতে। তারপর থেকে সুচিত্রাদির প্রায় প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানেই আমার থাকার সৌভাগ্য ঘটেছে। গেছি বিভিন্ন জায়গায়। অর্জন করেছি নানারকম অভিজ্ঞতা। মোহরদি— কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুচিত্রাদির গভীর বন্ধুত্ব ছিল। রবীন্দ্রসদনে দুই কিংবদন্তি শিল্পীর অনুষ্ঠানের সাক্ষী থেকেছি। মোহরদি গাইলেন ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’, বিরতির পর সুচিত্রাদি ধরলেন ‘আবার এসেছে আষাঢ়’। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ। এঁদের মধ্যে অপূর্ব বন্ধুত্ব ছিল, সেটা আমরা নিজের চোখে দেখেছি। সুচিত্রাদি শান্তিনিকেতনে গেলে মোহরদির জন্য কিছু না কিছু নিয়ে যেতেন।
আরও পড়ুন-মাদ্রিদে তুমুল উৎসাহ, শিল্প সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে ব্যাট ধরবেন সৌরভ
হৃদ্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল
সুচিত্রা মিত্রের অকৃপণ স্নেহ পেয়েছেন সঙ্গীতশিল্পী দেবারতি সোম। তিনি বলেন, ‘‘আমি সুচিত্রাদির সরাসরি ছাত্রী নই। মায়া সেন, প্রফুল্লকুমার দাস, সুভাষ চৌধুরীর কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছি। যখন আটের দশকে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতে ভর্তি হই, সে-সময়টা সুচিত্রাদি ছিলেন। কিন্তু তাঁর ক্লাস করার সৌভাগ্য হয়নি। একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্য হবে, তখন বিভাগীয় প্রধান সুচিত্রাদি, মায়াদির কথায় আমাকে শ্যামা গাইবার জন্য নির্বাচিত করেন। খুব উৎসাহও দেন। অনুষ্ঠান খুব ভাল হওয়ায় সুচিত্রাদির সঙ্গে একটা হৃদ্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সুচিত্রাদি অবসর নেন, তারপরেও তাঁর সঙ্গে ভালই যোগাযোগ ছিল। তাঁর বিশেষ স্নেহ লাভ করেছিলাম। অনেক কথাই আজ মনে পড়ছে।”