বিশ্ববিদ্যালয় ও আচার্য রাজ্যপাল সম্পর্কিত বিষয়ে সম্প্রতি ‘জাগোবাংলা’ দৈনিকে আমি তিনটি প্রবন্ধ লিখেছি। তবুও একই বিষয়ে আরও একবার কলম ধরতে হল। চলতি মাসের তিন তারিখে (৩.৯.২৩) রাজভবন থেকে একটি নির্দেশিকা প্রকাশিত হয়েছে। নির্দেশিকাটি দেখবার সুযোগ হয়নি। বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, উক্ত নির্দেশের মূল কথা হল— (১) বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যর ক্ষমতা সর্বোচ্চ। নিবন্ধকার (Registrar) এবং অন্যান্য আধিকারিকরা উপাচার্যের অধীনে ও নির্দেশে কাজ করবেন। (২) রাজ্য সরকারের উচ্চশিক্ষা বিভাগের নির্দেশ মানতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বাধ্য নয়। প্রথমটি নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। নির্দেশের দ্বিতীয় অংশের সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির মিল আছে, মনে হয় না।
আরও পড়ুন-ছোটদের শারদ উপহার
বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পরিচালিত হয় সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় আইন (যেটি রাজ্য আইনসভা প্রণয়ন করেছে), স্ট্যাটিউট (Statute) অর্ডিন্যান্স (Ordinance) এবং বিধির (Rules) দ্বারা। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলির শিক্ষা সংক্রান্ত কাজে রাজ্য সরকার কোনও নির্দেশ দেয় না বা হস্তক্ষেপ করে না। যেমন, পাঠ্যক্রম তৈরি করা, পরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষক নিয়োগ করা, প্রশ্নকর্তা ঠিক করা—এই সমস্ত কাজ করে বোর্ড অব স্টাডিজ (Board of Studies)। প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা বোর্ড রয়েছে। প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন জমা দেওয়ার পর মডারেশন বোর্ডের (Moderation Board) সদস্যরা প্রশ্নগুলি ক্ষতিয়ে দেখে, পাঠ্যক্রমের বাইরে প্রশ্ন হয়েছে কিনা, বেশি কঠিন প্রশ্ন হল কিনা ইত্যাদি। বিষয়ভিত্তিক স্বতন্ত্র Moderation Board আছে। এখানে সরকারের ভূমিকা কোথায়?
আরও পড়ুন-দেবশিল্পী
সরকার শুধু দেখে, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় পরীক্ষা যখন চলে, হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী যখন পরীক্ষা দেয়, যাতে ঠিকভাবে পরীক্ষা প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়। আইনশৃঙ্খলা বজায় থাকে। পরিবহণ ব্যবস্থা ব্যাহত না হয়। এই ক্ষেত্রে মহকুমা শাসক ও জেলা শাসকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। রাজ্য সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারেরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। রেল পরিবহণ ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ব্যাপক সংখ্যক পরীক্ষার্থী ট্রেনে করে পরীক্ষা দিতে আসে। এ ছাড়া কলেজগুলিতে ঠিকভাবে পড়াশোনা হচ্ছে কিনা, সেটি তত্ত্বাবধান করা, কলেজের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয় রক্ষা করা, এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সম্পাদন করেন ‘কলেজসমূহের পরিদর্শক’ (Inspector of Colleges)। তিনি উপাচার্যের নিয়ন্ত্রণাধীন, রাজ্য সরকারের নন। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয় আইনে আচার্যের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। উপাচার্য নিয়োগে আচার্যের একটা ভূমিকা রয়েছে। উপাচার্য নিয়োগের জন্য যে অনুসন্ধান কমিটি (Search Committee) গঠিত হয়, সেই কমিটির প্রধান থাকেন আচার্য-মনোনীত প্রতিনিধি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সংস্থা কোর্টে (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বলা হয় সিনেট) এবং Executive Concil-এ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট বলা হয়) আচার্যের মনোনীত প্রতিনিধি থাকেন।
আরও পড়ুন-রিয়েল মাদ্রিদে মুখ্যমন্ত্রী-সৌরভ, খতিয়ে দেখলেন আধুনিকীকরণ ও পরিকাঠামো উন্নয়ন
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরের শিক্ষক নিয়োগের জন্য গঠিত বিষয়-ভিত্তিক বাছাই কমিটিতে (Selection Committee) আচার্যের মনোনীত বিশেষ প্রতিনিধি থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতির (Career Advancement Scheme) জন্য গঠিত বিষয়-ভিত্তিক কমিটিতেও আচার্যের প্রতিনিধি থাকেন। রাজ্য সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অধ্যাপকদের শূন্যপদ পূরণ করার জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না, অথবা পদোন্নতির কাজ আরম্ভ করা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ আচার্যের প্রতিনিধি পাওয়া যাচ্ছে না। এই সমস্যা শুরু হয়েছে মাননীয় প্রাক্তন রাজ্যপাল ধনখড় সাহেবের সময় থেকে। বর্তমান মাননীয় আচার্য রাজ্যপাল দায়িত্বভার গ্রহণের পর সামান্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দু-একটি বিষয়ে পদোন্নতি সংক্রান্ত কমিটিতে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন। তারপর বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন-সূর্যের কাছাকাছি আরও একধাপ
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সংক্রান্ত কাজে বা দৈনন্দিন প্রশাসনে রাজভবন বা বিকাশভবন (শিক্ষা বিভাগ) কেউই হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় স্ব-শাসিত সংস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বশাসন নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর যোগ্য সন্তান ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তীব্র লড়াই করেছিলেন ও সফল হয়েছিলেন। শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক মতবাদ, কার্যাবলি নিয়ে মতভেদের অবকাশ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু শিক্ষাজগতে এই প্রবল ব্যক্তিত্বশালী ও বিরল প্রতিভাবান শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা প্রশাসক বাঙালি ভদ্রলোককে শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখতেই হবে। যিনি ছাত্রস্বার্থে কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে ঢুকতে দেননি।
আরও পড়ুন-অনন্তনাগে গুলির লড়াই, বারামুলায় নতুন সংঘর্ষে নিকেশ ২ জঙ্গি
এখন অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম, পরীক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষানীতি প্রভৃতির মধ্যে সমন্বয় রাখবার জন্য বামফ্রন্ট আমলেই উচ্চশিক্ষা সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজ্য বিধানসভা আইন প্রণয়ন করেছিল। এই সংসদ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা তাঁদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে ঐক্যমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয় এবং রাজ্য সরকারকে জানায়। রাজ্য সরকারের উচ্চশিক্ষা বিভাগ সেই সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে জানিয়ে দেয়? বিশ্ববিদ্যালয় কি এই সিদ্ধান্ত মানবে না? এটা হতে পারে? যেমন, উচ্চশিক্ষা সংসদের পরামর্শের ভিত্তিতে রাজ্য সরকারের নির্দেশ অনুসারে স্নাতকস্তরে বর্তমান শিক্ষাবর্ষ থেকে ৪ বছরের পাঠ্যক্রম প্রবর্তিত হয়েছে। কোনও বিশ্ববিদ্যালয় কি এই সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করতে পেরেছে?
আরও পড়ুন-রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতি সংক্রান্ত নীতি তৈরিতে চন্দ্রিমার নেতৃত্বে ১০ সদস্যের কমিটি
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির যাবতীয় আর্থিক দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। অধ্যাপক ও শিক্ষাকর্মী বন্ধুদের বেতন দেবার পুরো দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। এ-ছাড়া নানা ধরনের অনুদান আছে— Maintenance Grant, Development (উন্নয়নমূলক) Grant ইত্যাদি। এই সমস্ত অনুদান ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অচল হয়ে পড়বে। সরকার টাকা দেবে, অথচ হিসাব চাইবে না? দেখবে না সরকার প্রদত্ত অর্থ ঠিকমতো খরচ হচ্ছে কিনা? এই সম্পর্কে সরকারি নির্দেশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মানতে বাধ্য। অন্যথায় সরকার নয়, রাজভবন যাবতীয় খরচ বহনের দায়িত্ব নিক। সম্প্রতি মাননীয় উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধকদের (Registrar) বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠক ডেকেছিলেন। বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধকরা যোগদান করেননি, কারণ উপাচার্যরা অনুমতি দেননি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রপ্ত উপাচার্য লিখছেন, মাননীয় আচার্য তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধক উচ্চশিক্ষামন্ত্রীর ডাকা বৈঠকে যোগদান না করেন। সবশেষে উল্লেখ করি, ২০১৯-এর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংক্রান্ত ১৫ নম্বর ধারা অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনও বিষয়ে তদন্ত করবার অধিকার রাজ্য সরকারের রয়েছে। তাই রাজভবনের এই নির্দেশ অনভিপ্রেত এবং বেআইনি।