অণুজীবের বিরুদ্ধে লড়াই অর্থাৎ ভাইরাস মুক্তির একমাত্র চাবিকাঠি হল টিকাকরণ। যার পথপ্রদর্শক বাংলাই। লিখছেন রাতুল দত্ত
ছোট একটা অ্যাম্পুল। আর তার মধ্যেই রয়েছে একটি অণুজীবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অস্ত্র। নাম তার টিকা। একটি মারণ ভাইরাসের দৌলতে মাঝেমধ্যেই কোনও দেশ, মহাদেশ কিংবা গোটা পৃথিবীই থাকে থরহরিকম্প অবস্থায়। সেটা স্প্যানিশ ফ্লু হোক কিংবা জলবসন্ত-গুটিবসন্ত কিংবা ইবোলা ভাইরাসের আক্রমণ কিংবা হালফিলের করোনা ভাইরাস। আর এই ভাইরাস থেকে মুক্তির চাবিকাঠি একমাত্র টিকা। বলা যায়, বাংলা প্রবাদের সূত্র ধরেই, বিষে বিষে বিষক্ষয়।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রকে কড়া তোপ বিজেপি সাংসদের
কিন্তু যতবার নানা রোগের মারণাস্ত্র হিসেবে বিভিন্ন টিকা বাজারে আসতে চেয়েছে, ততবার দেখা দিয়েছে সভ্যতার সংকট। একদিকে স্বেচ্ছাসেবক পেতে সমস্যা, অন্যদিকে কট্টর ধর্মীয় নির্দেশের বেড়াজাল ভেঙে মানুষকে বেরিয়ে আসতে দেওয়া থেকে বাধা দেওয়া। প্রতিটি রোগের প্রতিটি টিকাই এভাবে বিভিন্ন দেশে নিজের পথ করে নিয়েছে। ব্যতিক্রম নয় ভারতও। কারণ ১৮০২ সালে ভারতে যখন প্রথম কোনও টিকাকরণ (গুটিবসন্তের জন্য) শুরু হল, তখনও একদিকে যেমন প্রবল বাধা-বিপত্তি, অন্যদিকে ইতিহাসের পাতার একদম ওপরের সারিতে জায়গা করে নিল বাংলা (অবিভক্ত বাংলা প্রদেশ)। আসলে ব্রিটিশদের মূল ঘাঁটি যেহেতু ছিল কলকাতায়, তাই ভারতের অন্য প্রান্তে সেদিন প্রথম টকাকরণ শুরু হলেও দ্রুত বাংলায় কীভাবে গুটিবসন্তের টিকা দেওয়া যায়, সেবিষয়ে তাঁরাও যথেষ্ট উদ্যোগী হয়েছিলেন।
আসলে জলবসন্ত, গুটিবসন্ত হল মূলত উপমহাদেশের রোগ। বিশেষত ভারত-সহ আফ্রিকা এবং সেদিনের ইজিপ্টে এই বসন্ত রোগে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটত। একসময় তো ভারতের নামই হয়ে গিয়েছিল, প্লেগ ভূমি, কারণ প্লেগের জীবাণু এতটাই বেড়ে গিয়েছিল। সেসময় ইউরোপের চিকিৎসকরা মনে করতেন, মূলত ভারত থেকেই এই রোগ ছড়াচ্ছে। ৪৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে যুকেডেভিস এবং ৯০০ খ্রিস্টাব্দে আবুবকারও বলেছিলেন কোনওভাবে অবশ্যই বসন্তরোগের গতি রোধ করা সম্ভব এবং যেহেতু ভারত থেকেই এই রোগ ছড়াচ্ছে, ভারতকেই এর পথ রোধ করতে হবে। অন্যদিকে ১৫৪৫ সালেই গোয়াতে ৮ হাজার শিশুর মৃত্যু হল।
পৃথিবীর প্রথম টিকাকরণের আবিষ্কার ও প্রয়োগ শুরু করলেন এডওয়ার্ড জেনার, ১৭৯৪ সালে এবং ৪ বছর পরে ১৭৯৮ সালে তিনি তাঁর গবেষণাপত্রে বিস্তারিত লিখলেন, কীভাবে বসন্ত রোগে আক্রান্ত গরুর দেহ থেকে রক্তরস সংগ্রহ করে মানুষের দেহে প্রয়োগ করছেন এবং ফলে তাঁদের দেহে ধীরে ধীরে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ক্ষমতা গড়ে উঠছে। বিস্তারিত তথ্য প্রথম প্রকাশিত হল, ‘An inquiry into the causes and effects of the variolae vaccinae’-লেখাতে। শুরু হল ইউরোপে, বিশেষ করে ব্রিটেনে, বসন্ত প্রতিরোধী টিকাকরণ।
১৮০২ সাল। টিকা রওনা হল ভারতের উদ্দেশে। তখনকার দিনে ছিল না কোনও অ্যাম্পুল বা শিশির ভাবনা। টিকা ঠান্ডা রাখার চিন্তা মাথায় আসেনি, কারণ রেফ্রিজারেটর আবিষ্কার হয়নি। তখন টিকা বহন করে নিয়ে আসত টিকাপ্রাপক নিজে। অর্থাৎ যাঁকে টিকা দেওয়া হল, তাঁকে জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হত অন্য দেশে। সেখানে তাঁর শরীরের গুটি থেকে রক্তরস সংগ্রহ করে অন্যের শরীরে প্রয়োগ করা হত। তাঁর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হলে আবার তাঁকে জাহাজে করে নিয়ে আসা হত অন্যত্র।
আরও পড়ুন-ঘুরপথে জ্বালানি শুল্ক, রেলভাড়া বাড়িয়ে টিকা নিয়ে এরপর কীসের বড়াই?
টিকা যে ভারতে আনতে হবে, সে বিষয়ে প্রথম বার্তা গেল ভিয়েনা শহরে, ডাঃ জেনার সাহেবের কাছে। তিনি অভয় দিলেন, এই ৬০০০ কিলোমিটার পথ, গুটিবসন্তের জন্য সংগৃহীত রক্তরস পাড়ি দিলেও তা নষ্ট হবে না। ফলে প্রথম ভিয়েনা থেকে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল স্মলপক্সের টিকা। ভিয়েনা থেকে টিকা পৌঁছল আজকের তুরস্কের ইস্তানবুল, সেদিনের কনস্ট্যানটিনোপল শহরে, সেখান থেকে ২১০০ কিলোমিটার স্থলপথ পেরিয়ে ইরাকের বাগদাদ। সেখানে টিকাপ্রাপকদের ৫০০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে নিয়ে আসা হল ইরাকেরই বুশেরা শহরে। সেখান থেকে ৩৪০০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ভারতের টিকা প্রথম এল মুম্বই শহরে।
১৮০২ সালের ১৪ জুন দিনটি ভারতের টিকা ইতিহাসে স্মরণীয়। কারণ ওইদিন, অ্যানা ডাস্টল নামে ৩ বছরের এক শিশুকে স্মলপক্সের টিকা দিলেন ডাঃ স্কট। সেখান থেকে জাহাজ পথে মাদ্রাজ। সেখানে জন ক্রেসওয়েল নামে ১৩ বছরের এক অস্ট্রেলিয়ান কিশোরকে প্রথম বসন্তের টিকা দিয়ে তাকেই আবার জাহাজে করে নিয়ে আসা হল বাংলায়, সেবছরের অক্টোবরে। এই প্রথম ভারতের বুকে প্রথম টিকাকরণে নজির সৃষ্টি করতে চলল বাংলা।
জাহাজের নাম ছিল হান্টার, আর ডাঃ এন্দারসন ক্লসওয়েল নামে ১৩ বছরের এক কিশোরকে টিকা দিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছিল কলকাতায়। মাঝে, জাহাজেই, প্রথমে এক মহিলা আর তাঁর থেকে গুটি নিয়ে দুই বালককে ওই জাহাজেই টিকা দেওয়া হল। এরপর কলকাতায় পৌঁছল জাহাজ। এর পরদিন থেকেই একদিকে দমদম হাসপাতাল আর একদিকে ধর্মতলার একটি হাসপাতাল থেকে সপ্তাহে ২ দিন, বিনামূল্যে টিকাকরণ শুরু হয়ে গেল। সেই সময় ১৮০৫ সালে ফ্রান্সিস বুকানন একটি সমীক্ষায় দেখিয়েছিলেন, অবিভক্ত ভারতে, প্রায় ১০০০ টিকাদার ছিলেন, যাঁরা কলকাতার আশপাশেই থাকতেন এবং টিকা দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করতেন।
অবশ্যই নজির, কারণ, সেদিন মুম্বইয়ে ভারতের প্রথম টিকা দেওয়া হলেও ওই একজনের বেশি আদৌ ক’জন আর টিকা নিতে আগ্রহী হয়েছিলেন, তার তথ্য পাওয়া যায় না। সেদিনের মাদ্রাজ শহরেও এর তেমন প্রভাব পড়েনি। মুম্বই শহর থেকে সেদিন পুণে, হায়দরাবাদ, সুরাট শহরেও স্মলপক্সের রক্তরস পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু আদৌ টিকা দেওয়া হয়েছিল কি না সন্দেহ আছে। অন্যদিকে বাংলায় প্রথম টিকা পৌঁছনোর পর প্রায় ১১ হাজার জনকে গুটিবসন্তের প্রথম টিকাকরণ করা হয়েছিল, এই বাংলার বুকেই। সেদিক থেকে সেদিন ভারতের প্রথম টিকাকরণ অভিযানে বাংলার নাম অবশ্যই অগ্রণী হিসেবে লেখা থাকবে।
আরও পড়ুন-পুলিশের কাছে রাতে যাবেন না! প্রশ্নে যোগীরাজ্যে নারী সুরক্ষা
তবে, বিরোধিতাও যে হয়নি তা নয়। আর সেটা এসেছিল কলকাতার সাহেব পাড়া নয়, নেটিভ টাউন থেকে। দেশীয় টিকাদারদের সাহায্যে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে মানুষের ভীতি দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করা হতে থাকল। এরপর এল সেই দিন, যেদিন বাংলার এক টিকাদার নিজে তাঁর ছেলেকে নিয়ে এলেন শিবিরে, টিকা দিতে। ১ মার্চ, ১৮০৫। লেখা হল বাংলার টিকার এক নতুন ইতিহাস। বাংলার টিকাদার ব্রজ পাল, তাঁর ছেলে ঠাকুরদাসকে নিয়ে এলেন, ধর্মতলার হাসপাতালে, প্রথমে গো-বীজ আর তারপর দেশজ টিকা দেওয়াতে। উল্লসিত ডাঃ জন সুলব্রেড নিজে তাঁদের টিকাকরণ করলেন। এরপর, রামলক্ষ্মণ নামে আর এক টিকাদারও একটি ছোট মেয়েকে টিকা দিলেন। এইবার ক্রমে টিকার ওপর বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করল বাংলার তথা দেশের মানুষের। এগিয়ে এলেন কলকাতার ২৫ জন টিকাদার। একটি সম্মিলিত বিবৃতিপত্রে সকলে সই করে আবেদন করলেন, আপনারা নির্ভয়ে টিকা দিন। কলকাতার ব্রিটিশ নাগরিক, ব্রিটেনবাসী সকলে মিলে, টিকার আবিষ্কর্তা ডাঃ জেনারকে সম্মান জানিয়ে বাংলার টিকাকরণের জন্য প্রায় ৩০ হাজার পাউন্ড অর্থ পাঠালেন। সেদিন বাংলার যে ২৫ জন সেই বিবৃতিপত্রে সই করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন, ডাক্তার রাধাচরণ, ডাক্তার রামকিশোর, শ্রীধর মুখার্জি, ব্রজগোপাল, কৃষ্ণমোহন, মদনমোহন, রামকান্ত, রামমোহন চক্রবর্তী, রামজয় মিশ্র প্রমুখ।
সেসময় বাংলায় কীভাবে টিকার কাজ হয়েছিল এবং টিকার পর রোগীদের আদৌ কী কী উপসর্গ দেখা গেল, তা নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট লিখে রেখে গেছেন ডাঃ জন সুলব্রেড। তাঁর বাবা চাকরি নিলেন, একজন সার্জন হিসেবে। এলেন ভারতে, বাংলায়। সেদিনের ক্যালকাটা নেটিভ হসপিটাল, যা আজকের মেয়ো হসপিটাল নামে পরিচিত, সেই হাসপাতালের প্রথম সার্জন এবং প্রথম সুপার হিসেবে দায়িত্ব নিলেন ডাঃ জন। বাংলায় প্রথম টিকাকরণের ২ বছর পর, ১৮০৫ সালে, ডাঃ সুলব্রেড, ৫ পাতার চিঠি লিখলেন, পৃথিবীতে টিকার জনক বলে পরিচিত, এডওয়ার্ড জেনারকে। চিঠিতে একদিকে যেমন তিনি টিকাকরণের সাফল্যের কথা তুলে ধরলেন, তেমনি অন্যদিকে গোঁড়া ব্রাহ্মণরা কীভাবে বাধা দিচ্ছে, সেটাও উল্লেখ করলেন। পরবর্তীকালে ১৮০৭ সালে, তাঁকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুপারিশে, বাংলায় টিকাকরণের তাঁর সাফল্যের কথা মাথায় রেখে, তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের ‘সুপারিনটেনডেন্ট জেনারেল অফ ভ্যাকসিন’ অর্থাৎ ভারতের টিকাকরণের সার্বিক দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। তিনি বিবাহও করেছিলেন কলকাতাতেই, লুসি বলে এক ইংরেজ মহিলাকে। জন সুলব্রেডের লেখা একটিই রিপোর্ট রয়েছে, বাংলার টিকাকরণ নিয়ে (Report on the Progress of Vaccine Inoculation in Bengal), যাতে স্পষ্ট, সেসময় টিকা নিয়ে দেশকে পথ দেখাতে এগিয়ে এসেছিল বাংলাই।