শতবর্ষের গণ্ডি পেরিয়ে যে গান আজও মানুষকে মুগ্ধ করে রেখেছে সেই গান হল অতুলপ্রসাদী গান। বিখ্যাত এই সংগীতশিল্পী৷ এ নিয়ে লিখেছেন ড. কৃষ্ণা রায়
মাত্র তেষট্টি বছরের জীবন। জটিল আইনি-পেশা অথবা ভাঙা-দাম্পত্যের দায়ভার নিয়েও মানুষটি ছিলেন বৈরাগী সাধক, সার্থক এক সুর-সন্ন্যাসী। তিনি অতুলপ্রসাদ সেন। জন্মেছিলেন দেড়শো বছর আগে, ১৮৭১ সালের ২০ অক্টোবর, ব্রিটিশ-শাসিত পূর্ব বাংলার ঢাকায়। বাঙালি তাঁকে মনে রেখেছে এক বিচিত্র ঘরানার সংগীত সৃষ্টির জন্য, ‘অতুলপ্রসাদী-গান’। শতবর্ষের গণ্ডি পেরিয়ে সে গান আজও মানুষকে মুগ্ধ করে রেখেছে।
ব্রাহ্ম-পরিবারে আজন্ম লালিত অতুলপ্রসাদের জীবনে গান এসেছিল সহজ–স্বাভাবিকতায়। বাবা রামপ্রসাদ সেন ছিলেন পেশায় চিকিৎসক, নেশায় গান-পাগল। কৈশোরে পিতৃবিয়োগের পর নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছিলেন মাতামহ বিখ্যাত গীতিকার ও সংগীতজ্ঞ কালীনারায়ণ গুপ্তের। তাই গান অতুলপ্রসাদের জীবনে চিরসঙ্গী ছিল। যৌবনে মামাদের প্রশ্রয়ে এবং সৎ-বাবা বিশিষ্ট আইনজীবী দুর্গামোহন দাশের বদান্যতায় ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়তে গেলেন। মনের গভীরে তখন প্রবল অভিমান, তাঁর স্নেহময়ী মা অন্যের ঘরণী। বিদেশে মন বড় বেশি উচাটন হয় ফেলে আসা স্বদেশের জন্য। ভেনিসে বিশেষ ধরনের নৌকা, গন্ডোলার চালকের মুখের গান শুনেই চটপট সুরটি মনে ধরে রাখলেন, তৈরি হল, দেশীয় ভাষায় এক কালজয়ী গান, ‘উঠোগো ভারতলক্ষ্মী’।
আরও পড়ুন-পুজোয় মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ, করোনা সংক্রমণের গ্রাফ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী
কলকাতায় ফিরে বিলেত-ফেরত ব্যারিস্টার আইনি-পেশায় বিশেষ সুবিধা করতে পারলেন না। ইতিমধ্যে জীবনে প্রেম এসেছে সমাজ-নিষিদ্ধ সম্পর্কের পথ ধরে। অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নিজের মামাতো বোন সুন্দরী, সুগায়িকা হেমকুসুমকে বিয়ে করেছিলেন। পরস্পরের প্রতি অফুরান প্রেম থাকা সত্ত্বেও বিবাহিত জীবন কিন্তু সুখের হয়নি। বারে বারে সেতু বাঁধতে দু’জনেই অধীর হলেও, শেষ পর্যন্ত সম্পর্কের সুতো ছিঁড়েই গিয়েছিল। একদিকে পুত্রবধূর প্রতি মায়ের তীব্র বিরাগ, অন্যদিকে অভিমানী একরোখা পুত্রবধূর শাশুড়ির প্রতি সীমাহীন ঘৃণা আর অসহনীয়তায় অতুল-হেমকুসুমের সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেছে। স্বভাবে শান্ত, লাজুক অতুলপ্রসাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি এই দুই যুযুধান মানুষের মধ্যে সমঝোতা গড়ে তুলতে। যন্ত্রণা- দীর্ণ অতুলপ্রসাদের গানে তাই বারবার উঠে এসেছে বিরহ-জনিত আর্তির কথা।
প্রায় তিন দশক লখনউ থাকার সুবাদে উত্তরপ্রদেশের হিন্দুস্থানী গান, যেমন ঠুংরি, গজল, দাদরা, লাউনি, কাজরি ঘরানার গান বাংলাতে আমদানি করেছেন অতুলপ্রসাদ। এর ফলে গানগুলির চলন কখনও চটুল (কে তুমি বসি নদী কুলে একেলা, বঁধু ধরো ধরো মালা পরো গলে) কখনও অসম্ভব করুণ এবং মধুর (পাগলা মনটারে তুই বাঁধ, কত গান তো হল গাওয়া), কখনও বিরহে আর্ত (নিদ নাহি আঁখি পাতে, ওগো নিঠুর দরদী), আবার কখনও ঈশ্বর-প্রেমে আমূল নিবেদিত (হরি হে তুমি আমার সকল হবে কবে!)
সারা জীবনে মাত্র ২০৮টি গান তিনি লিখেছেন। সমসাময়িক অন্য আরও তিন সংগীতজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আর রজনীকান্ত সেনের তুলনায় সংখ্যাটি নেহাত কম। নিজের গানের সংরক্ষণের ব্যাপারে খুব ঢিলেঢালা ছিলেন। বাড়িতে নিয়মিত গানের আসর বসত। সেখানে আত্মবিস্মৃত অতুলপ্রসাদ নিজেই মজলিসের লোকদের প্রশ্ন করতেন, “আমার গান কিছু জানো? একটা শোনাও তো।” একবার রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে গানের আসরে অতুলপ্রসাদ রচিত গান ‘কাঙাল বলিয়া করিও না হেলা’ শুনে উপস্থিত শ্রোতারা রবীন্দ্র-গান বলে ভুল করে সে গানের অজস্র প্রশংসা করছেন দেখে বিড়ম্বিত রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং স্নেহভাজন অতুলপ্রসাদকে উপদেশ দিলেন, এবার তোমার গানগুলি গ্রন্থিত করো। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল-প্রাইজ পেলে মুগ্ধ অতুলপ্রসাদ লিখলেন, ‘মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা’। এ ঘটনার আটচল্লিশ বছর পরে এই বিশেষ গানটি আশ্রয় হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের যোদ্ধাদের। বাস্তবিক, পরাধীন ভারতের এই গীতিকবির অনেক গানই ছিল স্বদেশ চেতনার। হও ধর মেতে বীর, উঠো গো ভারতলক্ষ্মী, বলো বলো সবে শতবীণা বেণু রবে, এ তালিকায় বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গত শতকে ১৯১৬ সাল থেকে তাঁর কাছে গান শিখতে আসতেন কিশোর পাহাড়ি সান্যাল, স্মৃতিতে ধরে রাখতেন তাঁর সুর। পরবর্তীতে সেই পাহাড়ি সান্যাল হয়ে উঠেছিলেন বাংলা চলচিত্র জগতের অন্যতম স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। বেহাগ, সিন্ধু, কাফি, পিলু, ভৈরবী ছিল তাঁর প্রিয় রাগ। এই সব হিন্দুস্থানি রাগ-রাগিণীকে আশ্রয় করে লিখেছেন অজস্র গান। উত্তরভারতীয় সংগীতের ঘরানা ছাড়াও তাঁর গানে এসেছে বাংলার নিজস্ব সংগীত-শৈলী, যেমন কীর্তন এবং বাউল অঙ্গের স্পর্শ। আবার বিলেতে থাকার সময় ম্যাডাম প্যাটের গান, ‘Home –sweet Home’ শুনে রচনা করেছেন ‘প্রবাসী চলরে দেশে চল’ এর মতো গান।
আরও পড়ুন-ভারতের প্রথম টিকাকরণে পথ দেখিয়েছিল বাংলাই
লখনউয়ের ব্যস্ত ব্যারিস্টার সাহেব মিঃ এ পি সেন জীবদ্দশায় ছিলেন শহরের বড় প্রিয় মানুষ। বেঁচে থাকতেই ব্যাঙ্কস রোডে পাঁচ রাস্তার সংযোগস্থলে তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তাটির নাম তাঁর নামানুসারে রাখা হয় এ পি সেন রোড। পেশার জগতে ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয় এবং সম্মাননীয়। গুরুতর মামলায় তাঁর চাহিদা ছিল অনিবার্য। আউধ বার-অ্যাসোসিয়েশনের তিনি প্রেসিডেন্ট, আবার লখনউয়ের পুরসভার ভাইস প্রেসিডেন্ট। দান-ধ্যান, আর্তের সেবায়, বাংলা ভাষার ধারাবাহিক-চর্চায় তাঁকে ছাড়া মানুষের চলত না। বাড়িতে সান্ধ্য সংগীত-আসরে উপস্থিত হয়েছেন সারা দেশের কত সংগীত গুণী। গুণের সমঝদারিতে তিনি সদা ব্যস্ত। ওস্তাদ সানাইবাদক হোক অথবা পথের ভিখারিণী সুগায়িকা, কেউই তাঁর সমাদর থেকে বঞ্চিত হয়নি। নিজে উৎসাহ করে উপস্থিত হতেন লখনউয়ের ‘মুশায়েরা’ তথা কবি-সম্মেলনে। প্রবাসে বাংলা-ভাষা চর্চার অগ্রপথিক হিসেবে আপামর বাঙালির তাঁকে স্মরণে না রাখলেই নয়। রাজনীতির বিষয়েও ছিলেন যথেষ্ট সচেতন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে গোখলে ছিলেন তাঁর অন্যতম আদর্শ। প্রথম জীবনে কংগ্রেস সমর্থক হলেও পরে হয়ে ওঠেন উদারপন্থী।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রকে কড়া তোপ বিজেপি সাংসদের
মৃত্যুর কিছুদিন আগে স্বাস্থ্যোদ্ধারের আশায় পুরীতে গিয়েছিলেন। সেখানে দেখা হয় গান্ধীজির সঙ্গে। শোনালেন মহাত্মাজির পছন্দের গান, ‘কে আবার বাজায় বাঁশি’, হিন্দি তর্জমা সমেত। আশৈশব ব্রাহ্ম ভাবধারায় লালিত অতুলপ্রসাদের জীবনে ঈশ্বর ছিলেন এক পরম আশ্রয়। ব্যক্তিগত দুঃখ–বেদনা ভুলতে চেয়েছেন সেই পরম আরাধ্যের জন্য নিবেদনের ডালি সাজিয়ে। রবীন্দ্রনাথের গানের মতোই তাঁর গানের বাণীতে প্রিয়-বিরহের দুঃখ ব্যক্তিগত অনুভব থেকে পৌঁছে গেছে আর গভীর ব্যাপ্ত ঈশ্বর আরাধনায়। মনে করা যাক একটি গানের কথা, ‘আমারে ভেঙে ভেঙে করো হে তোমার তরী’, নিবেদনের আকুতিতে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন যে ঈশ্বরের কাছে, তিনি সেকালে প্রচলিত ব্রহ্মসংগীতের নিত্য-নিরঞ্জন নিখিলতারণ নয়, বাংলার প্রাচীন কীর্তন-বৈষ্ণব-গীতির ‘শ্রী হরি’। এখানেই তাঁর অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের যাপন-চিত্র। ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদনেও ভোলেননি মাতামহের কাছে বাল্যে শেখা কীর্তন তথা বৈষ্ণব-ভক্তিগীতি। হিন্দু- মুসলমান, ধনী-দরিদ্র সকলকে তিনি ভালবাসার বাঁধনে বাঁধতে চেয়েছিলেন।
রবীন্দ্র যুগে বাস করেও সংগীতপ্রিয় বাঙালি তাঁর গানের মধ্য দিয়ে পেয়েছিল ঠুংরি, গজলের প্রথম স্বাদ। আর তাঁর নেতৃত্বে এবং প্রেরণায় প্রবাসের বাঙালি পেয়েছিল মাতৃভাষা চর্চা করার দীক্ষা, ‘উত্তরার’ মতো বাংলা ভাষায় পত্রিকা প্রকাশের সাহস।
জীবদ্দশায় শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিত আইনজ্ঞ অথবা সংগীতজ্ঞ ছিলেন না। ছিলেন সকলের বন্ধু জন-সেবক। সেই বন্ধুতার কথা তাঁর মৃত্যুর পর স্মরণ করেছিলেন অগ্রজ কবি রবীন্দ্রনাথ—‘ বন্ধু তুমি বন্ধুতার/ অজস্র অমৃতে পূর্ণপাত্র/ এনেছিলে মর্ত্য ধরণীতে।’
সার্ধশতবর্ষে সেই সুর-সন্ন্যাসী বাঙালি-মনীষাকে কি ভুলে থাকা যায়?
তথ্যসূত্র :
অতুলপ্রসাদ : মানসী মুখোপাধ্যায়
অতুলপ্রসাদ : সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী (সম্পাদিত)