দেশে এখন এমন একটি সরকার যার প্রতিটি পদক্ষেপের পিছনে দেশের দশের স্বার্থের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অভিসন্ধি। বিএসএফ-এর খবরদারির সীমারেখা বাড়ানোর পেছনেও ওই একই অঙ্ক। সত্য উদ্ঘাটনে সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়
সম্প্রতি বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) অ্যাক্টে একটা বড়সড় সংশোধন করা হয়েছে। এই সংশোধনের ফলে বি এস এফ-এর খবরদারির এলাকা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও পাঞ্জাবের যে আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে তার থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা বিএসএফ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। এর আগে ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত অঞ্চল বিএসএফ-এর কর্তৃত্বাধীন ছিল। সেই খবরদারির সীমারেখা এক ধাক্কায় ৩৫ কিলোমিটার বাড়িয়ে দেওয়া হল।
আরও পড়ুন-মান্না দের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য
এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড সরাসরি বিএসএফ-এর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। এর বেশির ভাগটাই উত্তরবঙ্গের। ওই অঞ্চলে স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই বিএসএফ ধরপাকড় করতে পারবে, জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করতে পারবে, খানাতল্লাশি চালাতে পারবে। যেসব এলাকা বিএসএফ-এর খবরদারির অধীনে চলে যাবে, সেগুলোর মধ্যে শিলিগুড়িও আছে। শিলিগুড়ি রাজ্যের দ্বিতীয় প্রধান গুরুত্বপূর্ণ শহর। নেপাল ও ভুটানের প্রবেশদ্বার। এরকম একটা শহরকে রাজ্যের প্রশাসনিক ক্ষমতার থেকে টেনে বের করে এনে সরাসরি দিল্লির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হাতে আনার ছক এই সংশোধিত বিধিতে স্পষ্ট।
মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর আন্তর্জাতিক সীমানার দৈর্ঘ্য অন্যান্য রাজ্যগুলির চেয়ে অনেক বেশি, প্রায় ২,২১৬.৭ কিলোমিটার। এবার বিএসএফ-এর আইনে এই পরিবর্তন আনলে দার্জিলিঙের কার্শিয়াং থেকে শুরু করে সুন্দরবন পর্যন্ত একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল রাজ্য প্রশাসনের হাত থেকে কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ খবরদারির অধীনে চলে যাবে। পশ্চিমবঙ্গের ২৩টি জেলার মধ্যে ১০টির সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানা বর্তমান। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, দার্জিলিং, মালদা, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ, এই আটিটি জেলার বেশির ভাগটাই বিএসএফ-এর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। চলে যাবে উত্তর ২৪ পরগণার দুই- তৃতীয়াংশ, রাজ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে না দক্ষিণ ২৪ পরগণার প্রায় এক-তৃতীয়াংশও। এই জেলা সদরগুলোর বেশ কয়েকটাতে বিএসএফ-এর ‘শাসন’ জারি হবে সেক্ষেত্রে। রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে ২১টি এই জেলাগুলিতে অবস্থিত বলেই কী এই নয়া সংশোধনীর দরকার হয়ে পড়ল ঠিক ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে? যদি এই খবরদারির ক্ষেত্র বাড়ানোটা জাতীয় স্বার্থে হত, তাহলে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করে সেকাজ করা যেত। ভারত তো আর এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র নয়, ভারত হল রাজ্যগুলির ইউনিয়ন। তাই সংশ্লিষ্ট রাজ্যসমূহের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের পরামর্শ – পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে এরকম একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যুক্তিসঙ্গত ছিল। তা না করে কেন একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া হল? এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এবং এর উত্তরেই অগোপন হচ্ছে এক কুৎসিত চক্রান্ত।
আরও পড়ুন-মান্না দের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য
নাগাদের মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্দোলন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে একটি মামলায় ২৭ নভেম্বর, ১৯৯৭তে শীর্ষ আদালত রায়দানকালে স্পষ্ট জানিয়েছিলে যে, রাজ্যের নাগরিক স্বার্থে সশস্ত্র কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানোর অর্থ কোনোভাবেই এটা নয় যে কেন্দ্রের সশস্ত্র বাহিনী রাজ্যের প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকল্প হিসেবে কাজ করার অধিকার অর্জন করবে। বরং তা রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করে চলবে। এটাই প্রত্যাশিত ও আইনসম্মত। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে বিএসএফ আইনের নয়া সংশোধনীতে রাজ্য পুলিশের বিকল্প হিসেবে কেন্দ্রের বাহিনী নামানোর ব্যবস্থা হয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করে চলার কোনও ব্যবস্থা এখানে নেই। এটা সরাসরি দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কুঠারাঘাত। উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যে একাধিক রায়ে যুক্ত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সংবিধানের মূল কাঠামো হিসেবে ঘোষণা করেছে। সুতরাং, কেদ্রের এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপন্থী।
নয়া কানুন চালু হলে জলপাইগুড়ির উত্তরাংশের কিয়দংশ ছাড়া বাকি ভূখণ্ড বিএসএফ-এর খবরদারির অধীনে চলে যাবে। দক্ষিণ দিনাজপুরের রাধিকাপুর থেকে ক্ষীরাবাড়ি, জেলার প্রায় পুরোটাই বিএসএফ-এর তত্ত্বাবধানে থাকবে। দক্ষিণ দিনাজপুরের উত্তরে বৈকুন্ঠপুর সীমান্ত থেকে দক্ষিণে বেরালি সীমান্ত, ওদিকে পশ্চিমে গোকর্ণ থেকে পূর্বে হিলি পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল চলে যাবে বিএসএফ-এর খবরদারির এলাকায়। রাজ্য প্রশাসনের আওতায় থাকবে উত্তরপূর্বের এক ফালি ভূখণ্ড। উত্তর ও দক্ষিণ মালদার পুরোটাই গ্রাস করবে বিএসএফ। অর্থাৎ, উত্তরবঙ্গের যে অঞ্চল নিয়ে পৃথক রাজ্য তৈরির দাবি তুলেছিল বিজেপি, এখন কলকে না পেয়ে এভাবে তারই সলতে পাকানোর চেষ্টায় তারা। চক্রান্ত দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।
নয়া বিধি কার্যকর করতে পারলে মুর্শিদাবাদের উত্তরাংশের বেশির ভাগটাই এবং দক্ষিণের অর্ধেক কব্জা করতে পারবে বিএসএফ। বহরমপুর শহরটাই চলে যাবে তাদের খপ্পরে। নদিয়ার বল্লভপাড়া থেকে হৃদয়পুর, আবার গেদে থেকে নবদ্বীপ কেন্দ্রীয় বাহিনীর শাসনাধীন হবে, চলে যাবে জেলা সদর কৃষ্ণনগরটাও। রাজ্যের দ্বিতীয় জনবহুল জেলা উত্তর ২৪ পরগণা। সংশোধনী চালু করতে পারলে সেখানকার হাবরা, আশোকনগর, বসিরহাটে রাজ করবে কেন্দ্রের বাহিনী।
আরও পড়ুন-টিকা নিয়েও জুমলা!
এসবের ফলে ওই এলাকাগুলোতে ড্রাগ পাচার, গোরু পাচার আর জাল নোটের অভিযোগে যাকে তাকে মিথ্যে মামলায় জড়াতে সুবিধা হবে কেন্দ্রের। প্রসঙ্গত মাদক পাচারের ক্ষেত্রে পশিম্বঙ্গের অবস্থান সবচেয়ে নিচে (সুত্রঃ ডি আর আই রিপোর্ট, ২০১৯-২০)। আর গোরু পাচারের উৎসমুখ হচ্ছে উত্তর প্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, এমনকি গুজরাট। সেই উৎসমুখ বন্ধ করার কোনও প্রয়াস সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলো নেয়নি। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে – ইডি, সিবিআই-এর পর বিএসএফ রাজ্যের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের আরও একটা এজেন্সি হিসেবে নামবে।
গত পাঁচ বছরে বিএসএফ-এর বিরুদ্ধে অন্তত ২৪০টি অত্যাচার, ৬০টি খুন আর ৮টি নিখোঁজ মামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগ দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৩৩টি অভিযোগের নির্যাতিতের নিকট আত্মীয়কে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। স্থানীয় পুলিশকে না জানিয়েই বহুবার গুলি চালিয়েছে বিএসএফ। চোরাকারবারিদের ধরেও তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেয়নি তারা। এমনকি ধৃত ব্যক্তিকে নৃশংস ভাবে মেরে তাঁর শব সীমান্তের ওপারে ছুঁড়ে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এবার সীমানা বাড়লে এসব ঘটনাও গুণোত্তর প্রগতিতে বাড়বে।
সীমান্ত রক্ষার কাজে ব্যবহার করার কথা ছিল যে বাহিনীর তাকে রাজ্য প্রশাসনের কাজে নাক গলাতে দেওয়া চলবে না কিছুতেই।