অকুস্থল নূহ। জুলাই মাসের শেষে এখানকার বড়কালি চকে গেরুয়াপক্ষের উদ্যোগে আয়োজিত জলাভিষেক যাত্রায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়েছিল। রাজস্থানের জোড়া খুন জুনেদ-নাসির হত্যা। সেই হত্যা মামলার অভিযোগকারী ইসমাইল। ব্যক্তি পরিচয়ে নাসিরের তুতো ভাই। তাঁর বিরুদ্ধে নূহের দাঙ্গায় জড়িত থাকার মামলা রুজু করেছে হরিয়ানার পুলিশ।
আরও পড়ুন-২০০০ টাকার নোট বাতিল কেন্দ্রের প্রশাসনিক ব্যর্থতা
নূহর এসপি নরেন্দ্র বিজারনিয়া সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ইসমাইল জাতিদাঙ্গায় জড়িত ছিল, এই মর্মে একটি অভিযোগ তাঁরা পেয়েছেন, আর তারই ভিত্তিতে এই পুলিশি পদক্ষেপ। ২৫ বছর বয়সি নাসির আর ৩৫ বছর বয়সি জুনেদ, দু’জনেই রাজস্থানের ভরতপুর জেলার ঘটমিকা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। স্বঘোষিত গোরক্ষকদের হাতে তাঁদের মৃত্যু হয়। এবছরই ফেব্রুয়ারি মাসে হরিয়ানায় ভিওয়ানি জেলায় একটি পোড়া গাড়ি থেকে তাঁদের দু’জনের দগ্ধ শরীর উদ্ধার হয়। ওই হত্যা মামলায় পাঁচজন অভিযুক্তের অন্যতম বজরং দলের সদস্য মনু মানেসর। মূলত তাঁকে কেন্দ্র করেই নূহের দাঙ্গা সংঘটিত হয়। নূহর দাহ্গায় দোকানপত্রে অগ্নিসংযোগ, ছ’টি মোটর সাইকেল পোড়ানো থেকে শুরু করে পুলিশের ওপর লোহার রড ও লাঠি নিয়ে আক্রমণ-সহ বিবিধ অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। সেই দাঙ্গা সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইসমাইল কোনও সমন পাননি, পুলিশের তরফে কেউ তাঁকে ডেকে পাঠায়নি। কিন্তু গোরক্ষকদের হাতে জোড়া খুনের মামলায় যাতে তিনি জবানবন্দি দিতে না পারেন, সেটা নিশ্চিত করতেই উঠেপড়ে লেগেছে হরিয়ানা পুলিশ। তাই নূহের দাঙ্গায় তাঁকে জড়ানো হয়েছে। এমনটাই বলছেন সবাই।
আরও পড়ুন-১৫০ বছর ধরে চলছে সেই একই নিয়ম ও রীতি
অকুস্থল নয়া সংসদ ভবন। বহুজন পার্টির সাংসদ দানিশ আলি। তাঁর ধর্মপরিচয়কে ইঙ্গিত করে ঘৃণাপূর্ণ বিদ্বেষমূলক মন্তব্য রমেশ বিধুরির। রমেশ বিধুরি বিজেপির সাংসদ। সংসদে দাঁড়িয়েই তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ দানেশ আলির বিরুদ্ধে অকথা কুকথার বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। সংসদে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণের পর সংসদের বাইরে রাস্তায় পিটিয়ে মারার হুমকি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ। বিধুরির ‘কাটুয়া’, ‘মোল্লা উগ্রবাদী’, ‘আতঙ্কবাদী’ ইত্যাদি নোংরা মন্তব্যগুলো নাকি দানিশের প্ররোচনায় মেজাজ হারানোর ফলশ্রুতি। রমেশ বিধুরির ওইরকম ‘ভার্বাল কিলিং’ নিয়ে পদক্ষেপের কোনও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না বিজেপির তরফে। এই হল মোদি শাসিত বর্তমান ভারতের চালচিত্র।
আরও পড়ুন-১৫০ বছর ধরে চলছে সেই একই নিয়ম ও রীতি
প্রাচীনকালে ও মধ্যযুগে রাজা-রাজড়ারা রাজ্যের সমৃদ্ধি এবং নিজেদের শাসনকালের গৌরব প্রকাশের জন্য নিত্য নতুন স্থাপত্য নির্মাণ করতেন। সেইসব কীর্তি দেশবিদেশ থেকে পর্যটকদের আকর্ষণ করে আনত। রাজ্যের সাংস্কৃতিক গৌরবের অভিজ্ঞান হয়ে যুগান্তরেও বিরাজ করেও সেইসব স্থাপত্য। ব্রিটিশরাও নেটিভদের থেকে উন্নততর সংস্কৃতির অধিকারী এটা বোঝানোর জন্য তারা নানা জায়গায় নানা বাড়িঘর তৈরি করেছে। ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিকে এরকম প্রাসাদ পরিকল্পনা অধিকমাত্রায় হয়েছে। লুটয়েনের দিল্লি তারই ফসল। সেখানেই পার্লামেন্ট হাউসকে, ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ হাউসকে, সাম্রাজ্যবাদের আসল হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন ভগৎ সিং। প্রচারপত্র বিলি করেছিলেন। কম মাত্রার বোমা ছুঁড়েছিলেন। তারপর তাঁর আত্মসমর্পণ।
আরও পড়ুন-আজ আসছে পাকিস্তান, ভারত-পাক ম্যাচের দিকে তাকিয়ে বাবর
১৫ অগাস্ট, ১৯৪৭-এ নেহরু যখন মধ্যরাত্রে দিচ্ছিলেন তাঁর বিখ্যাত ভাষণ ‘Tryst with destiny’, তখনও ঔপনিবেশিক শাসনের স্মারক এই ভবন ছিল গণপরিষদ বা সংবিধান প্রণেতাদের সভাগৃহ। ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০-এ যখন সেই সংবিধান গৃহীত হল, তখন ওই ভবনটাই নতুন আত্মপ্রকাশ করা ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের প্রথম সংসদ বা আইনসভা হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করল। গত ১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর সেই সংসদ ভবনটাকেই যেন খাটো করে দেখানো হল সংসদের বিশেষ অধিবেশনে, নয়া সংসদ ভবনে। সেখানে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্মারক ব্রিটিশদের দেওয়া সেঙ্গল অধিষ্ঠিত হল। সেই অধিষ্ঠানে যেন ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের তাবৎ নিজস্বতা অসম্মানিত হল। এবং সেই অসম্মান মোদি শাসিত বর্তমান ভারতের চালচিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
এবং সেই অসম্মানের ঘণীভবন প্রত্যক্ষগোচর হল সংসদের ভিতরকার আলোচনায় ও বিতস্তায়।
নয়া সংসদ ভবনে মহিলা সংরক্ষণ বিল পেশ করা হল। সবাই সাদরে সেটিকে স্বাগত জানাল। কিন্তু বিলটা কেবল অধ্যাদেশ হয়েই রয়ে গেল, কবে কার্যকর হবে সেটার অনির্দেশ্য অবস্থার কোনও বদল হল না।
আরও পড়ুন-বিধানসভাই শপথের আদর্শ জায়গা, বোসকে পাল্টা চিঠি অধ্যক্ষের
নয়া সংসদ ভবনের স্থাপত্য, চাকচিক্য, জমকালো ভাব, সবকিছু যেন যে সংগ্রামের পরিণতিতে এই সংসদীয় গণতন্ত্র ভারত অর্জন করেছে সেটাকে নস্যাৎ করার একটা সুনির্দিষ্ট অভিপ্রায়। রাস্তা ও শহরের নব নামকরণ উৎসবে যাঁরা উপেক্ষিত তাঁদের প্রতি উপেক্ষাই অনিবার্য হয়ে রয়ে গেল এই সংসদের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে।
নয়া সংসদ ভবনে যখন বিরোধীপক্ষের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত সাংসদ তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের সৌজন্যে কুৎসিত বিশেষণে ভূষিত হন, তখন অনুভূত হয়, নয়া সংসদ ভবন আদতে শাসক শিবিরের ঘৃণা চাষের খেত।
মিশরীয় সভ্যতার পিরামিড আর মমির কথা বলতে গিয়ে ইতিহাসবিদরা বলেন, সেগুলো অর্থব্যয়ের দুর্দান্ত দৃষ্টান্ত হতে পারে, কিন্তু সেগুলোর নির্মাণে মিশরের নৈতিক পরম্পরার কোনও উন্নতি সম্ভবায়িত হয়নি।
আরও পড়ুন-লক্ষ্য বিজিবিএস, সফরের লগ্নিচুক্তি রূপায়ণে কাজ শুরু
চারিদিকের পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এই জমানা অব্যাহত থাকলে, আগামীতে বিপুল অর্থব্যয়ে নির্মিত এই সংসদ ভবনটির সম্পর্কেও আমাদের একই কথা বলতে, লিখতে ও শুনতে হবে।
একুশ শতকের স্থাপত্যেও মধ্যযুগীয় অন্ধকার চাপা পড়ছে না। এটা ভাবনার এবং দুঃখের কথা।