সমাজ সংস্কার, নারী শিক্ষা বিস্তার এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভারতীয় নারীদের অন্যতম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছেন ডঃ মুথু লক্ষ্মী রেড্ডি। তাঁর অবদান নারী শিক্ষা বিস্তার বিশেষত চিকিৎসা ক্ষেত্রে নারী সমাজের অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত করে দিয়ে যায়।
আরও পড়ুন-হ্যাটট্রিকের পর এই প্রথম উত্তরবঙ্গ সফর, বাংলাই মডেল : মুখ্যমন্ত্রী
বাবা ছিলেন সে সময়ের চেন্নাইয়ের মহারাজা’স কলেজের অধ্যক্ষ। মা দেবদাসী। বাবা দেবদাসী প্রথার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য সমাজ থেকে একঘরে হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যেমন দমে যাননি। তেমনই চেয়েছিলেন মেয়েকে এমন শিক্ষিত করে তুলতে যাতে সমাজে সম্মান পায়। মেয়েরও প্রবল বাসনা, প্রবল অনুরাগ পড়াশোনার প্রতি। শিক্ষকরা যারপরনাই স্নেহ করতেন। কিন্তু সেখানেও বাধা। সেই মেয়েকে পড়াশোনা করতে-করতেই বয়ঃসন্ধির সময়ে পড়া ছাড়তে হয়েছিল। অগত্যা বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা। কিন্তু যে মেয়ের মনের মধ্যে সব বাধা জয় করবার স্বপ্ন তাকে কে আটকাবে। এই মেয়েই তো পরবর্তী কালে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত পাড়ি দিয়েছিলেন। সেই সময়, যখন মেয়েদের ঘরের বাইরে বেরোনো ছিল কঠিন থেকে কঠিনতর।
যে কলেজে ভর্তি হলেন সেই কলেজে একমাত্র মহিলা ছাত্রী মুথুলক্ষ্মী। কিন্তু কিছুতেই দমবার পাত্রী নন। সেই সঙ্গে বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন শিক্ষার প্রতি সহায়তা। ১৯০৭ সালে ভর্তি হলেন মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজে। ১৯১২ সালে সফল ডাক্তারি কন্যা। ভারতবর্ষের প্রথম দিককার ডাক্তারদের মধ্যে অন্যতম। এটা সেই সময় যখন মেয়েরো ঘরের মধ্যে আটকে। সেখানে মুথুলক্ষ্মী এক নতুন আলোকবর্তিকা।
মাদ্রাজ সরকারি হাসপাতালের মাতৃত্ব ও চক্ষু বিভাগের প্রথম মহিলা হাউস সার্জন হয়ে যোগ দিলেন। তারপর আর থেমে থাকা নয়। সান্নিধ্যে এলেন অ্যানি বেশান্ত-এর। সঙ্গে পেলেন মহাত্মা গান্ধীকে। মুথুলক্ষ্মীর ভাবনায় এল ব্যাপক পরিবর্তন। চারিদিকে অসহায় নারীর হতভাগ্য অবস্থা দেখে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নারী ও শিশু উন্নয়নের লক্ষ্যে। মহিলাদের মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ভাবনা শুরু তখন থেকেই। দরিদ্র মহিলা ও শিশুদের শিক্ষিত করে তোলার বাসনায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। ১৯১৭ সালে উইমেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। দরিদ্র মহিলা ও শিশুদের সেবা করার উদ্দেশ্যেই ১৯৩০ সালে মাদ্রাজে গঠন করেছিলেন ‘আভাই’ বাংলায় যা অভয় হোম। যেখানে দরিদ্রদের নিখরচায় শিক্ষা, পোশাক ও খাদ্য দেওয়া হত। যা আজও বর্তমান। কস্তুরবা হসপিটাল গড়ে তোলার পেছনে ছিল তাঁর অনন্য শক্তি ও উদ্যম।
আরও পড়ুন-মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি, তাতেও এগিয়ে বাংলা
নানা বাধা-বিপত্তিকে ডিঙিয়েই ব্রিটিশ ভারতে প্রথম মহিলা বিধায়ক হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন মুথুলক্ষ্মী। তাঁর প্রথম হওয়ার তালিকায় রয়েছে আরও অনেক। ১৯৩৭ সালে মাদ্রাজ কর্পোরেশনের প্রথম বয়স্কা নারী। ১৯৫৪ সালে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা বোর্ডের প্রথম মহিলা চেয়ারম্যান। আইন পরিষদের প্রথম মহিলা উপরাষ্ট্রপতি। তাঁর লেখা বই মাই এক্সপেরিয়েন্স অ্যাজ আ লেজিসলেটর আইন পরিষদে যা স্বীকৃত হয়েছিল।
সমাজে বহুবিবাহ বিরোধী বিল এনেছিলেন। সেই সঙ্গে পতিতালয় ও নারী ও শিশুদের পাচার বিল তৈরি করিয়েছিলেন। সেই বিল পাস হয়েছিল ১৯৩০ সালে। শুধু কি তাই মুসলিম মেয়েদের জন্য পৃথক হস্টেল স্থাপন করেছিলেন এবং হরিজন বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য বৃত্তিপ্রদান করেছিলেন। এবং সেইসময় সরকারকে পুরুষদের বিয়ের বয়স ২১ করারও পরামর্শ দিয়েছিলেন। উইমেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে মুথুলক্ষ্মী ক্যান্সার রোগীদের জন্য বিশেষ ত্রাণ তহবিল গঠন করেন। অল এশিয়ান উইমেনের চেয়ারম্যান হন। সারা জীবন নারী ও শিশু সম্পর্কিত অসংখ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর তাঁর সারাজীবনের এইসব কৃত্বিত্বের জন্যই ভারত সরকার ১৯৫৬ সালে তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’-এ ভূষিত করে।
তামিলনাড়ু সরকার এই মহতী নারীর সম্মানেই প্রতি বছর ৩০ জুলাই দিনটিকে ‘হসপিটাল ডে’ হিসেবে পালন করে চলেছে।
মুথুলক্ষ্মীর কিছু বিরল কৃতিত্ব :
১. মুথুলক্ষ্মী ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি মোট পুরুষদের কলেজ, মহারাজাস কলেজে ভর্তি হন।
২. মুথুলক্ষ্মী ১৯০৯ সালে মেডিক্যাল কলেজে প্রথম এবং একমাত্র মহিলা প্রার্থী ছিলেন।
৩. মুথুলক্ষ্মী ছিলেন সরকারি মাতৃত্ব ও চক্ষু হাসপাতালের প্রথম মহিলা হাউস সার্জন।
৪. মুথুলক্ষ্মী ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা বিধায়ক।
৪. মুথুলক্ষ্মী ১৯৩৭ সালে মাদ্রাজ কর্পোরেশনের প্রথম প্রবীণ মহিলা হন।
৪. মুথুলক্ষ্মী ১৯৫৪ সালে রাজ্য সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা বোর্ডের প্রথম মহিলা চেয়ারপার্সন ছিলেন।
৪. মুথুলক্ষ্মী ছিলেন আইন পরিষদের প্রথম মহিলা উপ-সভাপতি।
আজকের পৃথিবীতে এই চন্দ্রযানের দিনে নারীর জয়জয়কার। আমাদের এই চন্দ্রযানের পেছনেও রয়েছে দুই মহান নারীর কৃতিত্ব। আর আজ থেকে একশো বছরেরও বেশি সময়ের আগে সমাজ সংস্কারক, নারীবাদী এমনই এক নারী মুথুলক্ষ্মী দৃষ্টান্ত হয়েছিলেন অনেক কিছুতেই প্রথম নারী হিসেবে। তাঁর জন্ম মাদ্রাজের পুড়ুকাত্তাইয়ে ৩০ জুলাই ১৮৮৬। মৃত্যু ২২ জুলাই ১৯৬৮। ৮১ বছরের এক বর্ণময় জীবন, আজও
আমাদের পাথেয়।