সুখেন্দু শেখর রায়: ১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই। ১৪ টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ-সহ ক্রমশ কয়লাখনি, চিনিকল, চটকল ও অন্যান্য শিল্প ‘জনগণের সম্পত্তি’-তে রূপান্তরিত হল। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের ফলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পেল। মুষ্টিমেয় শিল্পপতিরা এই শিল্পক্ষেত্রগুলি নিজেদের মুনাফা লুটতে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। এবারে অর্থনীতির মূল পরিসরে মুক্ত হাওয়া বইতে শুরু করল। শুধু ব্যাঙ্কের কথাই আলোচনা করা যাক। জাতীয়করণের মূল লক্ষ্য ছিল, দেশের সর্বত্র নতুন নতুন শাখা খুলে জনগণের মধ্যে ব্যাঙ্কিং অভ্যাস গড়ে তোলা। যত শাখা বাড়বে, ততই আমানত বাড়বে। সেই আমানত ক্ষুদ্র শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে ঋণদান, বিভিন্ন ব্যবসায় লগ্নি করে দেশের অর্থনীতিকে উন্নীত করা ছিল এই উদ্যোগের মূল কথা। সেইসময় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মোট শাখা ছিল ৮২৬১ টি। মাত্র ৩১ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০০০ সালে শাখার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫,৫২১ টি। অর্থাৎ ৮ গুণ বেড়ে যায়। যুব সম্প্রদায়ের অনেকেই ব্যাঙ্কে ও অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় চাকরি পান।
এতাবৎ রুগ্ন ক্ষুদ্র শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে ঋণদানের মাধ্যমে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটে। কিন্তু একশ্রেণির অসাধু রাজনীতিক, ব্যাঙ্কের কর্মকর্তা, বড় বাবসায়ী ও শিল্পপতিদের যোগসাজশে অনাদায়ী ঋণ ও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির পরিমাণ ও সংখ্যা লাফিয়ে বাড়তে থাকে। যেমন, ১৯৯৫ সালে ২১টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে ‘নন পারফরমিং অ্যাসেট’(এন.পি.এ.) যা ছিল ৩৮,৩৮৫ কোটি টাকা, তা ২০১১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৭১,০৪৭ কোটি টাকায়। নরেন্দ্র মোদির মাত্র প্রথম তিন বছরের রাজত্বে অর্থাৎ ২০১৭ সালে এন.পি.এ পৌঁছয় সাড়ে দশ লাখ কোটি টাকায়। মোদি সকারের আমলেই ‘কিং ফিশার’-এর মালিক বিজয় মালিয়া এবং হীরে ব্যবসায়ী বলে কথিত মেহুল চোকসি ও নীরব মোদির মতো যথাক্রমে ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ ও প্রতারকরা কয়েক লক্ষ কোটি ‘জনগণের আমানত’ ব্যাঙ্ক থেকে একরকম লুঠ করে বিদেশে চম্পট দেয়। অবশ্য এই পলাতকরা ভারত ছাড়ার আগে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করতে কিংবা ছবি তুলতে ভুল করেননি। দেশজুড়ে হইচই শুরু হওয়ায় লোক দেখানো সামান্য আইনি পদক্ষেপ করা হল। কিন্তু ততক্ষণ ডজন-ডজন ব্যাগভর্তি মণি-মক্তো, হীরে-জহরত নিয়ে পলাতকরা নিরাপদে আশ্রয়ে পৌঁছে গেছে।
ইতিমধ্যে নোটবন্দি ঘোষণার ফলে রাতারাতি অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। শিল্পোৎপাদন থমকে দাঁড়ায়। তড়িঘড়ি ‘তেলা মাথায় তেল’ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। শিল্পপতিদের ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণের মোটা টাকা মকুব করা শুরু হয়। অন্যদিকে ঋণশোধ না করতে পেরে কৃষক পরিবারে শুরু হয় আত্মহত্যার হিড়িক। তা হলই বা। শিল্পপতি বন্ধুদের তো বাঁচাতে হবেই। সংসদে দেউলিয়া কোম্পানিগুলির সঙ্গে মীমাংসার (?) ‘বন্দোবস্ত’ হল। ব্যাঙ্কের লক্ষকোটি টাকা অর্থাৎ জনগণের আমানতে শিল্পপতি বন্ধুদের ‘লুঠ’ এবার আইনসিদ্ধ হল। এখন আবার চরম পরিণতির দিকে এগিয়ে চলছে দেশের ব্যাঙ্ক, বিমা, খনি, ইস্পাত, তেল, রেল, ট্রেন, বিমান, বিমানবন্দর, পোর্ট, জাহাজশিল্প, এমনকী প্রতিরক্ষা দফতরের অধীন ‘অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি’ সমূহ। মোদি-সরকার নীতি আয়োগের পরামর্শে সমস্ত সরকারি সংস্থা ধাপে ধাপে বিক্রি করে দেবে। অর্থসচিব সম্প্রতি বলেছেন, ‘‘ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণ হবেই। তার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে।’’ যেমন, আইডিবিআই নিলামে উঠেছে। কলকাতায় সদর দফতর ছিল, এমন তিনটি ব্যাঙ্কের মধ্যে ইউ.বি.আই এবং এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক অন্য ব্যাঙ্কে বিলীন হয়ে গেছে। ইউকোর গলাতেও মৃত্যুর পরোয়ানা ঝুলছে। এসবিআই-এর দু’-একটি ব্যাঙ্ক হয়তো আপাতত বেঁচে থাকবে। ৪০টি রেল স্টেশনের বেসরকারীকরণ ছাড়াও ১০৯টি রুটে ১৫১ টি প্রাইভেট ট্রেন চলবে। ১৬ টি গুরুত্বপূর্ণ রেলের জমি নিলামে উঠতে চলেছে। তাঁর মধ্যে হাওড়ার সল্টগোলার জমিও আছে। মুম্বই-সহ ৬ টি বিমানবন্দর গেছে আদানির হাতে। যেমন, তিনি কব্জা করেছেন রাঁচির দু’-দুটো বিশাল কয়লাখনি। পোর্ট ট্রাস্ট আইনের অবলুপ্তি ঘটিয়ে নতুন আইন প্রণীত হয়েছে। তৈরি হয়েছে নতুন এক কর্তৃপক্ষ বা ‘অথরিটি’, যারা ইচ্ছেমতো পোর্টের জমি বিক্রি করবে। কোনও রাজ্য সরকার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কোনও নিয়ন্ত্রণ গ্রাহ্য হবে না। সবাই জানেন, আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি সরকারি জমি রয়েছে রেল, বন্দর, বিমানবন্দর, প্রতিরক্ষা ও সংরক্ষিত অরণ্যে। এ সবকিছুই চলে যাবে বেওসায়ী আর ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট বা শিল্পপতি-স্যাঙাতদের কব্জায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। যদি মোদি-শাহদের ‘বিক্রেতা সরকার’ বিনা বাধায় এইভাবে ‘বিক্রি আর কাটমানি’-র নীতি কার্যকরী করতেই থাকে। বিক্রির লম্বা তালিকায় দেখা যাচ্ছে প্রতিরক্ষা দফতরের ‘অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড’-এর অধীন ৪১টি অস্ত্র কারখানা (যার মধ্যে বাংলার ৪ টি কারখানাও আছে) অচিরেই ‘কর্পোরেশন’-এ পরিণত হচ্ছে। অস্ত্র কারখানার সঙ্গে যুক্ত ৮০ হাজার কর্মচারী লাগাতার আন্দোলন ঘোষণা করেছেন। সরকারও তড়িঘড়ি বিল নিয়ে এসেছে সংসদের চলতি অধিবেশনে। শান্তিপূর্ণ ধর্মঘটের অধিকারও কেড়ে নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন: কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিশ দিলেন মহুয়া
সম্পূর্ণভাবে বিক্রি করা হবে, এমন ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মধ্যে রয়েছে এয়ার ইন্ডিয়া, ভারত পেট্রোলিয়াম, নীলাচল ইস্পাত এবং অবশ্যই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের তৈরি দেশের প্রথম স্বদেশি ওষুধ ও রাসায়নিক কারখানা ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’। এটি লাভজনক সংস্থা। তাহলে বিক্রি হবে কেন? কারণ, মুম্বইয়ের প্রভাদেবী, উত্তরপ্রদেশের কানপুরে, বাংলার সোদপুর, কাঁকুড়গাছি অঞ্চলে এই সংস্থার বিশাল জমি রয়েছে, যার এখন বাজারদর দু’ হাজার কোটি টাকা। এই জমি বিক্রি করে কোষাগারে টাকা আনবে মোদির সরকার। সঙ্গে মিলবে কাটমানিও। এ সবকিছু দেখার পরে দেশের মানুষ আর চুপ করে থাকবেন না। পেট্রোপণ্যের দাম এখন সারাবিশ্বের মধ্যে ভারতে সবচেয়ে বেশি। ফলে সমস্ত জিনিসের দর সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সংসার চালানোই দায়। তাই নতুন স্লোগান শোনা যাচ্ছে- হর হর মোদি/ ঘর ঘর বরবাদি।