‘হেট স্পিচ’ বা ‘ঘৃণার ভাষণ’। নয়া সাংসদ ভবনের প্রথম অধিবেশনে যেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সকলকে (Modi Government) নিয়ে চলার বার্তা দিলেন, সেখানেই দক্ষিণ দিল্লির মতো অভিজাত এলাকার বিজেপি সাংসদ রমেশ বিধুরী, লোকসভায় তাঁর সহ-সাংসদ দানিশ আলি সম্পর্কে ছাপার অযোগ্য ভাষায় এমন কিছু শব্দ প্রয়োগ করলেন, যা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের সংসদে শুনে অবাক হতে হয়৷ আরও একবার ভিডিওটা চালিয়ে শুনতে হয়, যা শুনছি ঠিক শুনছি তো? সহ-সাংসদ দানিশ আলি সম্পর্কে তাঁর ধর্ম তুলে যে-যে কথা রমেশ বিধুরী বললেন, তা যেকোনও সুস্থ গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। আরও অবাক করার মতো বিষয়, বিধুরী যখন সংসদে দাঁড়িয়ে এহেন অশ্লীল মন্তব্য করে যাচ্ছেন, তখন পিছনে বসে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ছেন দুই প্রবীণ সাংসদ তথা প্রাক্তন মন্ত্রী ডাঃ হর্ষবর্ধন এবং রবিশঙ্কর প্রসাদ৷ দুই প্রবীণ সাংসদ একবারও রমেশ বিধুরীকে থামালেন না! উলটে মজা নিলেন!
অনেকেই ভেবেছিলেন, বিধুরীর এহেন বক্তব্যের পরে হয়তো তাঁকে বহিষ্কার করা হবে সংসদ থেকে। নিদেনপক্ষে সাসপেন্ড হবেন। সেসবের কিছুই অবশ্য হয়নি। সম্ভাবনা ছিল, ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’- এর স্লোগান দেওয়া দল হয়তো তাকে শো-কজ করবে। বর্ষীয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের বিধুরীর বিরুদ্ধে কড়া মন্তব্য শুনে মনে হয়েছিল বড়সড় শাস্তির মুখে নিশ্চয়ই এবার পড়তে চলেছেন বিধুরী। কিন্তু, কোথায় শাস্তি? উলটে এই ‘ঘৃণার ভাষণে’র হপ্তাখানেকের মধ্যেই পুরস্কৃত হলেন রমেশ বিধুরী। রাজস্থানের বিধানসভা নির্বাচনে একটি জেলার দায়িত্ব তাকে অর্পণ করল ভারতীয় জনতা পার্টি! স্বাভাবিক। এই প্রথম সম্ভবত কোনও সাংসদ সংসদের ভিতরে দাঁড়িয়ে এরকম কুৎসিত শব্দবন্ধ ব্যবহার করলেন। রমেশ বিধুরী’র ধন্যবাদ প্রাপ্য, যে শব্দগুলো এতদিন শুধু সামাজিক মাধ্যম বা পাড়ার ঠেকে বিজেপি নেতারা (Modi Government) ব্যবহার করতেন, সেই শব্দগুলিকে তিনি সংসদের ভিতর নগ্ন-বেআব্রু করে দিয়েছেন। এই ঘৃণা সম্ভাষণের সংস্কৃতি যে নব্যগৈরিক ভারতের ‘নিউ নর্ম্যাল’ সেই সত্যটাকে সংসদে দাঁড়িয়ে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন রমেশ বিধুরী। একটি রাজনৈতিক সমীক্ষক দলের তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২০১৪ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের দ্বারা ঘৃণার ভাষণ বেড়েছে ১,১৩০%! যার মধ্যে ৮১ শতাংশই এসেছে কোনও না কোনও বিজেপি নেতা-নেত্রীর মুখ থেকে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ২০২২ সালের ইউপি’র বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রকাশ্যে বলেছিলেন, এই নির্বাচন ৮০ বনাম ২০-এর নির্বাচন! গত বছরই ‘হিন্দু রক্ষা সমিতি’ নামের একটি সংগঠনের নেতা প্রভানন্দ হরিদ্বারে একটি ধর্ম-সংসদের আয়োজন করেন। যেখানে মঞ্চ থেকে প্রকাশ্যে মুসলিমদের খুন করার নিদান দেন বক্তারা! না সেই প্রভানন্দ গ্রেফতার হননি। উলটে প্রভানন্দের সঙ্গে মাননীয় যোগী আদিত্যনাথের ঘনিষ্ঠতার খবর সামনে এসেছে। এর আগে বেঙ্গালুরুর দক্ষিণের সাংসদ তথা বিজেপির সর্বভারতীয় যুব নেতা প্রকাশ্যে ‘ঘৃণার ভাষণ’ দেন। তাঁর সেই বক্তব্য ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমে। স্বাভাবিকভাবে এর পরেই তেজস্বীর দায়িত্ব বাড়ে দলে। একইভাবে, দিল্লির নির্বাচনের সময়, ‘দেশ কি গদ্দারো কো গোলি মারো শালো কো’ বলা অনুরাগ ঠাকুর একবছরের মধ্যে প্রতিমন্ত্রী থেকে ক্যাবিনেট মন্ত্রীতে উন্নীত হন!
আরও পড়ুন-আদানি নয় দেশের সবচেয়ে ধনীর তকমা পেলেন আম্বানি
শুধু গো-রক্ষার নামেই ২০১৬ থেকে ২০২০-এর মধ্যে ৫০-এর ওপর ভারতীয় ‘লিঞ্চ’ হয়েছেন! সন্দীপ আচার্য বা প্রেমকৃষ্ণ বংশীর মতো কিছু গায়ক আছেন। যাঁদের গানের মাধ্যমে প্রকাশ্যে মুসলিমদের খুনের হুমকি দেওয়া হয় রোজ। গানের মধ্যেই মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণ করার কথা বলা হচ্ছে। পশ্চিমি মিডিয়া এই বিশেষ সংগীতের নামকরণ করেছে, ‘হিন্দুত্ব পপ’। বিজেপি আরএসএস এটা বারবার ভুলিয়ে দিতে চায় যে এদেশে বসবাসকারী মুসলিমদের পূর্ব পুরুষরা ভারতবর্ষকেই নিজেদের দেশ বলে থেকে গিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে বিকল্প থাকলেও তাঁরা এই দেশ ছেড়ে যাননি। কারণ এই দেশটিকেই তাঁরা নিজেদের দেশ ভেবে এসেছেন। এহ বাহ্য যে, এই উত্তরপ্রদেশেরই গঙ্গাতীরের এক বাড়িতে ছুটে আসত সারা বিশ্বের সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ তামাম পশ্চিমি গণমাধ্যম আসত তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে। যার সানাইয়ের সুর আজও বাজে প্রতিটি হিন্দু বাড়ির শুভ অনুষ্ঠানে, সেই বিসমিল্লাহ্ খাঁর উত্তরপ্রদেশই আরেকটি নতুন ঘরানার উদ্ভব ঘটিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের নয়ডায় সুরেশ চাভাঙ্কে নামের একজন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রাক্তনী একটি আস্ত টেলিভিশন চ্যানেল চালান। যে সংবাদমাধ্যমে সকাল থেকে রাত অবধি মুসলিমদের বিরুদ্ধে নানা রকম খবর দেখানো হয়। যার বেশিরভাগই মিথ্যা এবং ‘ফেক’। ঘৃণার সম্ভাষণ চলে গোটা দিন ধরে। উত্তেজিত করা হয় দর্শকদের। এই সংবাদমাধ্যমটির বিরুদ্ধে ‘ঘৃণার ভাষণ’ ছড়ানোর অভিযোগে আদালতেও বহু মামলা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও সরকারের বিজ্ঞাপন পায় এই সংবাদমাধ্যমটি। এবং বহাল তবিয়তে সম্প্রচারিত হয়ে চলেছে। (মনে রাখা দরকার ভারতের বর্তমান তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীর নাম অনুরাগ ঠাকুর। যিনি নিজেই ঘৃণার ভাষণ দিয়ে বিখ্যাত হয়ে ছিলেন)। শুধু সুরেশ চাভাঙ্কে কেন? ভারতের (Modi Government) মূলধারার প্রত্যেকটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম এবং সেই সংবাদমাধ্যমগুলির সঞ্চালকরাও প্রকাশ্যে সান্ধ্য বির্তকগুলিতে ঘৃণার উদ্গীরণ করে চলেছেন। জলন্ত লাভার মতো ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। যে কোনও ঘটনার মধ্যে সাম্প্রদায়িক রঙ চড়িয়ে পরিবেশন করা হচ্ছে দর্শকদের কাছে। যেদিন ডিজে সমন্বিত ‘হিন্দুত্ব পপ’ ছিল না সেদিন কিন্তু বারাণসীর গঙ্গার ঘাটে একমনে পাগলা সানাইয়ে রাগ ভৈরবী রেওয়াজ করতেন মা সরস্বতীর এক মানসপুত্র। বিসমিল্লাহ্ খান সাহেব।