ষড়ৈশ্চর্যশালিনী মা দুর্গা আসছেন ঘরের মেয়ে উমা হয়ে। আকাশে বাতাসে তাই খুশির আমেজ। ধুম লেগেছে মর্ত্যবাসীর বিকিকিনিতে। ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই চাইছে সেরা পণ্য বিক্রি করতে আর কিনতে। বর্ষা এখনও যায়নি, এরই মধ্যে শরৎ এসেছে, উমাও আসবে ভাবছে সবাই। পাড়ার মোড়, শহরের গলি, রাজপথ পুজোর বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকেছে। উপলক্ষ সেই উমার আগমন। চার দেওয়ালের মধ্যে বসেও টিভিতে, রেডিওতে মন ছুঁয়ে যাওয়া সব পুজোর বিজ্ঞাপন, যা স্পর্শ করে বাঙালির আবেগকে। কাশ, শিউলি আর শরৎ রোদের সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশনের পর্দায় পুজো নিয়ে নিত্যনতুন বিজ্ঞাপনও জানান দিয়ে যায়— উৎসবে মেতে ওঠো, সময় এসে গেছে।
আরও পড়ুন-শারদোৎসব ও অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য বন্ধুতা
বদলে যাওয়া সময় ও সংস্কৃতির সঙ্গে বদলেছে পুজোর আবেগ ও বাঙালির উন্মাদনা। টেলিভিশনের পর্দায় পুজো নিয়ে নিত্য নতুন বিজ্ঞাপনও জানিয়ে দেয় যে, উৎসবে মেতে ওঠার সময় এসে গিয়েছে। অনেকে মনে করেন, এটা নেহাত মার্কেটিংয়ের সমীকরণ। তবে আবেগপ্রবণ বাঙালির কাছে পুজোকে ঘিরেই এই সমস্ত কিছু চাওয়া-পাওয়া এবং সমস্ত নস্টালজিয়া।
দাদার বন্ধু সুজয়দা— কী কিউট না!
জিয়ানস্টাল বাঙালির মধ্যে যে পুজোর উন্মাদনা, তা বাঙালি ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। সুজয়দা আর পুচকির সমীকরণ বাঙালির বিজ্ঞাপন জগৎকে নতুন করে তুলে ধরে। সুজয়দা যখন পুচকিকে জিজ্ঞাসা করে, কোনও হেল্প লাগবে? পুচকি সেই শারদ আবেগ নিয়ে তাকিয়ে থাকে সুজয়দার দিকে। আর এই আবেগ ভালবাসায় পরিণত হয় যখন পুচকির দাদা নীরবে সুজয়দার সঙ্গে পুচকিকে ঠাকুর দেখে আসতে বলে। বিজ্ঞাপনের রংবাহারি দুনিয়ায় বাঙালির এই আবেগ আপামর ক্রেতার মনে শারদ-ঢাক বাজিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন-পুজোয় মাতুন প্যাকেজ ট্যুরে
তোমার বুকেও ঢাকের বাদ্যি বাজে
বাঙালির পুজো তো নতুন পোশাক ছাড়া ভাবাই যায় না। সেই পোশাকের সবচেয়ে বেশি যত্ন আর আদর অষ্টমীর অঞ্জলির এবং প্যান্ডেল হপিংয়ের পোশাক নির্বাচন করায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পোশাকের রং মেলানো, প্রিয় মানুষের সঙ্গে। আর রং মিললেই বুকে বাজতে থাকে ঢাকের বাদ্যি। বিজ্ঞাপনের এই ঢাকের বাদ্যি সব ক্রেতার বুকে বাজানোর জন্যই পুজোর অঞ্জলি থেকে প্যান্ডেল হপিং পর্যন্ত পোশাকের ডালি সাজায় অনেক বহুজাতিক সংস্থা। প্রতি উৎসবে মনের সাজে সাজিয়ে তোলে।
আরও পড়ুন-মূল্যবৃদ্ধি আর বেকারত্বের সমস্যা মিটে গেল বুঝি?
বড়দিনের গিফট সান্তাক্লজ দেয়, আর পুজোর গিফট?
পুজোর গিফট কে পাঠায়, তা তো বাঙালির কাছে হাইলি সাস্পিসিয়াস। কারণ বড়দিনের গিফট সান্তা ক্লজ পাঠালেও পুজোর গিফট কিন্তু সান্তা ক্লজ পাঠায় না। যে-ই পাঠাক, বিজ্ঞাপনী এই গিফটে বাবা অবাক হয়ে যান। মায়ের প্রাণখোলা হাসি, ভাইয়ের উপচে পড়া আনন্দ— সবই নতুন পোশাক কেনার। তবে অনলাইনে এই শপিংয়ের বিজ্ঞাপন একমুঠো আনন্দ নিয়ে আসে বাঙালির ঘরে, যা বাঙালিকে উৎসবে উপহার দেয় আর উপহারে উৎসবকে মনে করায়।
রেজার টু ব্লেজার, সবই তো বাবার দেখছি
বাঙালির পুজো মানেই পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির পরতে পরতে থাকে পুজোর গন্ধ, উৎসবের আমেজ। আর বাঙালির দুর্গাপুজোর সেরা দিন মনে হয় অষ্টমী— বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্স ডে। ছোট বড় মাঝারি, সব বয়সের বাঙালি প্রেমিক হয়ে ওঠে। তাই বিজ্ঞাপনে প্রবাসী মায়ের রেডি করা পাঞ্জাবি ছেলে অষ্টমীর পুজোয় পরে গেলেও ছেলে উপার্জনের প্রথম পয়সায় কিনে আনে অষ্টমীর অঞ্জলির পাঞ্জাবি। বিজ্ঞাপনের এই নস্টালজিয়া বাঙালি আর পাবে কোথায়!
আরও পড়ুন-ভাল শুরু করেও পারলাম না : বাবর
এবার জমবে মজা
বনেদি বাড়ির পুজোতে এখন জৌলুস অনেক কমেছে। কিন্তু বনেদিয়ানার রেশটা রয়ে গেছে। নতুন প্রজন্ম কিছুতেই এই পুজো বন্ধ হতে দেবে না। বনেদিয়ানায় ঘেরা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে বিজ্ঞাপনের জগৎ তৈরি করেছে বাঙালি। নতুন প্রজন্ম যতই আধুনিক হোক না কেন, দুর্গাপুজোর উন্মাদনা বাঙালির জিনে আজও একইরকম। বিজ্ঞাপন তা তুলে ধরে।
সপ্তমীতে প্রথম প্রেম, প্রথম দেখা
পুজোর দিনগুলোতে মজা আর আনন্দের অন্যতম আকর্ষণ পুজোর প্রেম। প্রেমে পড়া বা প্রেম জমে ওঠার পক্ষে দুর্গাপুজোর মরশুম যেন ভরা প্রেমের মরশুম। আর এটাই বাঙালির চিরন্তন বিশ্বাস। নয়ের দশক থেকে এই সময় বিজ্ঞাপনী প্রেম বাঙালিকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
প্রাণঢালা এই উৎসব বারবার
একটা বনেদি বাড়ি মানেই ঠাকুরদালান। আর সেই ঠাকুর দালানেই উঠে আসে গোটা পরিবার। সারাবছরের গেট টুগেদার ওই ঠাকুর দালানকে ঘিরেই। এটাই বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর চেনা ছবি। আর এই ছবিকেই তুলে ধরেছে। বাঙালির পুজো বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনে জনপ্রিয় গায়ক-গায়িকার সঙ্গে দেখা গিয়েছে বাচিক শিল্পী ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বিজ্ঞাপনের এই গান বাঙালির পুজো আবেগকে উসকে দিয়েছে।
আরও পড়ুন-মূল্যবৃদ্ধি আর বেকারত্বের সমস্যা মিটে গেল বুঝি?
আশ্বিনের শারদ প্রাতে
পুজো আসছে। এই বিষয়ের মধ্যে বাঙালির যে উন্মাদনা থাকে, তা অন্যরা বুঝতে পারে না। পুজোর চেয়ে অনেক বেশি দামি পুজো আসার অপেক্ষা। আর সেই অপেক্ষাকেই কাজে লাগিয়েছে বাঙালির নিত্যদিনের চায়ের সঙ্গী এক বিস্কুট কোম্পানি।
বাবা, ঠাম্মা কেন আমাদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাচ্ছে না?
বাঙালির পুজো আছে, আমেজ আছে, আর আছে একান্নবর্তী পরিবার। ঠাম্মা যখন হাঁটতে পারে না, তখন ছোট্ট নাতির কাছ থেকে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঠাকুরের গল্প শুনতে চায়। কিন্তু এই বিজ্ঞাপনে ঠাকুর দেখতে বেরোনোর আগে ব্যস্ততা আর সেই সঙ্গে শেষ মুহূর্তে সব গুছিয়ে নেওয়া, পুজোর দিনে নিজেকে আরও একটু সুন্দর করে তোলার চেষ্টা রয়েছে। নাতিও ঠাম্মাকে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যেতে চায়। নাতি নাছোড়বান্দা। তাই বাড়িতে বসে বড় স্ক্রিনে ঠাকুর দেখার ব্যবস্থা করে বাবা। এই বিজ্ঞাপন দেখে অনেক বাঙালির চোখে আবেগের জল চিকচিক করবে।
আরও পড়ুন-হামাসের বিধ্বংসী পরিকল্পনার আগাম আঁচ পেতে ব্যর্থ মোসাদ
মা আসছে ঘরে ঘরে
বিজ্ঞাপনে শুধু নয়, এ তো বাঙালির চেনা ছবি। প্রবাসীরা ঘরে ফেরে। যেসব বাবা-মা বাড়িতে অপেক্ষা করেন, তাঁরা ভাবতে থাকেন, তাঁদের ঘরের মেয়ে উমা যদি তাঁদের সঙ্গে ঘরে থাকত, তা হলে এবারের পুজো আরও সার্থক হয়ে উঠত। আচমকা যদি মেয়ের ফোন আসে, যে পুজোয় বাবা-মায়ের সঙ্গে একসঙ্গে কাটাবে, তাহলে তো খুশির শেষ থাকে না। বাঙালির এই অনুভূতিকে বিজ্ঞাপনে কাজে লাগিয়েছে একটি বহুজাতিক শপিং সংস্থা।
বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত ক্লান্তি ওই জলে ধুয়ে চলে যায়
ছেলে সেরা ভাস্করের পুরস্কার পেয়েছে। বাবা কুমারটুলির পটুয়া। ছেলের প্রশ্ন— বাবা আমরা এত কষ্ট করে মূর্তিগুলো তৈরি করি। চারদিন পর সেগুলো বিসর্জন হয়। তোমার কষ্ট লাগে না? এখানে কেন পড়ে আছ বাবা? তুমি তো বড় শিল্পী হতে পারতে। উত্তরে বাবা বাঙালির আবেগকে চোখের জলের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। বলেন— ওই চারদিন হাজার হাজার মানুষ মূর্তিগুলোর সামনে মাথা নত করে, শ্রদ্ধা জানায়। ওটাই আমার পুরস্কার। বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত ক্লান্তি ওই জলে ধুয়ে চলে যায়।
আরও পড়ুন-মোদি জমানায় ভুয়ো বিজ্ঞানের রমরমা
কেন, যে সাজাল, সে সাজবে না?
রুকু তো অবাক। সমস্ত দেবতাদের সাজিয়ে তোলেন বিশ্বকর্মা। আর রুকুর বাড়ির বনেদি প্রতিমাকে রাত জেগে সাজান পিসিদিদা। সরল মনে রুকু জানতে চায়, তুমিই কি বিশ্বকর্মা পিসিদিদা? আর পরদিন যখন ঝলমলে সাজে মা দুর্গা, তখন পিসিদিদার জন্য বিজ্ঞাপনে দুটো সোনার বালা নিয়ে আসে রুকু। পিসিদিদা প্রশ্ন করে, আবার এসব কেন! বাঙালির সব ভালবাসা এক করে রুকুর মা উত্তর দেয়— কেন, যে সাজাল, সে সাজবে না?
বাঙালিকে সাজাতে আর বাংলার ঠাকুর দালান বারোয়ারি ঝলমলে উৎসবমুখর করে তুলতে বিজ্ঞাপনের অভাব নেই। কিছু ছুঁয়ে যায় হৃদয়। আর কিছু নস্টালজিক করে তোলে দুই প্রজন্মকে। কিন্তু পুজোর বিজ্ঞাপন থাকে আপন মনে, আপন ঢঙে। বাঙালির পুজোও থাকবে, পুজোর বিজ্ঞাপনও থাকবে। শুধু ওই তলানিটুকু অবলম্বন করে বাঙালি আবেগ, ভালবাসা আর আনন্দের পশরা সাজাবে। হয়ে উঠবে সর্বজনীন। ইউনেস্কো থেকে বাংলার গ্রামে গ্রামে পৌঁছে যাবে প্রতিটা ঠাকুর দালানের গল্প আর দুর্গাপুজো উৎসব হয়ে ওঠার কথকতা।