শুরুতেই একটি খবর।
মহালয়ার ভোরে। পিতৃপক্ষ অবসানের দিনটিতে।
বিশে ডাকাতের নয়, ‘বিশ্বগুরু’র কৃতিত্বের সংবাদ।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (Hunger Index) শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের চেয়েও নিচে অবস্থান ভারতের! দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে একমাত্র তালিবান শাসিত আফগানিস্তান রয়েছে ভারতের নিচে। ২০২১ সালের তুলনায় তালিকায় আরও নিচে নেমে গিয়েছে নয়াদিল্লি। গতবারের ১০১ নম্বর অবস্থান থেকে নেমে ভারত এখন ১২১টি দেশের মধ্যে ১০৭ নম্বরে। ভারতের স্কোর ২৯.১। এদেশের ক্ষুধার মাত্রাকে ‘গুরুতর’ ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়েছে। ওই সূচক আরও বলছে, শিশুদের অপুষ্টির হার এ দেশে ১৮.৭ শতাংশ, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। শিশুদের ওজনের সাপেক্ষে উচ্চতার অনুপাতের ভিত্তিতে এই হিসাব কষা হয়েছে। তাতে ভারতে চরম অপুষ্টির ছবিটিই প্রকট হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টটিতে জানানো হয়েছে। রিপোর্ট মোতাবেক, এ দেশে পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার ৩.১ শতাংশ। যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর খাবার জোটে না ১৬.৬ শতাংশ মানুষের। সেই সঙ্গে এ-ও বলা হয়েছে যে, ১৫ থেকে ২৪ বছরের মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতায় ভোগেন ৫৮.১ শতাংশ। ২০২২ সালে এই সূচকেই ১২১টি দেশের মধ্যে ভারত ছিল ১০৭ নম্বরে। এবার আরও চার ধাপ নিচে নামা ভারতকে টেক্কা দিয়েছে প্রতিবেশী পাকিস্তান (১০২), বাংলাদেশ (৮১), নেপাল (৬৯) এবং শ্রীলঙ্কা (৬০)।
আরও পড়ুন-বস্ত্রবিতরণ দিয়ে শুরু অভিষেকের একগুচ্ছ কর্মসূচি
এবং রিপোর্ট প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিয়ালের দল হুক্কা হুয়া রবে বেরিয়ে পড়েছে। আসল ছবিটা প্রকাশ পাওয়া মাত্র সেটাকে মিথ্যার কালিতে মাখানোর চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে।
এই সূচক প্রকাশিত হওয়ার পরেই তাকে ‘পদ্ধতিগতভাবে ত্রুটিযুক্ত’ এবং ‘দুরভিসন্ধিমূলক’ বলে খারিজ করে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকারের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক। ঢপবাজ সরকারের ‘পোষণ ট্র্যাকার’ বলছে, এ দেশে শিশুদের অপুষ্টির হার একটানা ৭.২ শতাংশের নিচে রয়েছে।
সত্যি কথাটা সাফ সাফ বলে ফেলাই ভাল।
আরও পড়ুন-ভবানীপুর ৭৫পল্লী সবেকিয়ানা দুর্গাপুজোর ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করলেন মুখ্যমন্ত্রী
নতুন ভারত গড়ার ডাক দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু এমন লজ্জার পরিসংখ্যান আসলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, সেসব অলীক স্বপ্ন। বা নেহাতই ভ্রান্ত প্রতিশ্রুতি! মোদি শাসিত ভারত খিদের আগুনে জ্বলছে। সরকার যতই এদেশের অগ্রগতির কথা বলুক, আসলে তা নয়। বাস্তবে বেঁচে থাকার সামান্য দিকগুলি থেকেও বঞ্চিত এদেশের বহু মানুষ।
বাংলাদেশ রয়েছে ৭৫ নম্বর-এ। মায়ানমার ৭৮-এ। পাকিস্তান ৮৮। আর এসব দেশের মতোই ভারতও খিদে ও অপুষ্টির নিরিখে গুরুতর বিভাগেই রয়েছে। রিপোর্ট বলছে, এদেশের ১৪ শতাংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার। বিশ্বগুরুর কী অসামান্য কৃতিত্ব!
আরও পড়ুন-বস্ত্রবিতরণ দিয়ে শুরু অভিষেকের একগুচ্ছ কর্মসূচি
এদেশে পাঁচ বছরের কমবয়সি বাচ্চাদের মধ্যে ৩৭ শতাংশের ওজন স্বাভাবিকের থেকে কম। অপুষ্টিতে শিশুমৃত্যুর হার ৩.৭ শতাংশ। ভারতের দুই প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও শ্রীলঙ্কা অবশ্য তুলনামূলক ভাল জায়গায় রয়েছে। শ্রীলঙ্কা তালিকায় ৬৪-তে। নেপাল ৭৩। এখানেই শেষ নয়। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশুদের মধ্যে মৃত্যুর হার ৩.১ শতাংশ। অন্যদিকে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতার প্রবণতা ৫৮.১ শতাংশ। গব্বে (?) ছাতি এক্কেবারে ৫৬ ইঞ্চি তো!
মোদি বাহিনীর তরফে বলা হচ্ছে, এই সূচক গণনার জন্য ব্যবহৃত চারটি বিষয়ের মধ্যে তিনটিই শিশুদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত। কাজেই এতে সামগ্রিক কোনও দেশের জনগণের ক্ষুধার প্রকৃত অবস্থাটা ধরা পড়ে না। সেটা মেনে নিলেও এটা অনস্বীকার্য যে মোদি জমানায় ধুঁকছে ভারতের শৈশব।
বিষয়টি একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
আরও পড়ুন-ভবানীপুর ৭৫পল্লী সবেকিয়ানা দুর্গাপুজোর ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করলেন মুখ্যমন্ত্রী
এদেশে লোকসংখ্যা প্রায় ১৪০ কোটি। স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও জনসংখ্যার ৭১ শতাংশের পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব ঘোচেনি, যার জেরে অসুখে মৃত্যু হচ্ছে বছরে ১০ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষের। এ তথ্য ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ এবং ‘ডাউন টু আর্থ’ পত্রিকার। সরকারি তথ্যই বলছে, বেকারি বৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় কমার ক্ষেত্রে আগের সব রেকর্ড ভেঙে গিয়েছে মোদি আমলে। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে নেই, জানাচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। এসবের মধ্যেই জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের দুটি বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদন জানিয়ে দিল, এই ২০২৩ সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫টি দেশের মধ্যে আরও চার ধাপ নেমে ভারতের স্থান হয়েছে ১১১। ভারতের ১৮.৭ শতাংশ বাচ্চা অপুষ্টির শিকার। লজ্জার সঙ্গে বলা যায়, এক্ষেত্রে শীর্ষ স্থানটি দখল করে ‘গোল্ড মেডেল’ পেয়েছে মোদির ভারত।
আরও পড়ুন-মহালয়ার রাতে শ্রীভূমিতে জনসমুদ্র, কড়া নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশ
রাষ্ট্রসংঘের ঘোষিত লক্ষ্য হল, ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবী ক্ষুধাহীন হবে। চলতি শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বের তাবড় নেতারা বসে এই শপথ নিয়েছিলেন। এই লক্ষ্যে ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’ বা বিশ্ব ক্ষুধা সূচক প্রকাশ করে চলেছে ওই দুই সংস্থা। সূচক নির্ধারণে চারটি মাপকাঠি বিবেচনা করা হয়। সেগুলি হল; ১) জনগণের কত শতাংশের প্রয়োজনের তুলনায় কম পুষ্টি বা ক্যালোরির ব্যবস্থা হচ্ছে, ২) পাঁচ বছর পর্যন্ত কত শতাংশ শিশুর ওজন নির্দিষ্ট উচ্চতার তুলনায় কম, ৩) পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুদের কত শতাংশের উচ্চতা নির্দিষ্ট বয়সের তুলনায় কম, ৪) শিশুমৃত্যুর হার। দেখা যাচ্ছে, মোদি জমানার শুরুর বছর ২০১৪ সালে এই সূচকে ভারত ছিল তালিকায় ৫৫ নম্বরে। মাত্র ন’বছরে সেটাই পৌঁছেছে এখন ১১১ নম্বরে। অথচ জনসংখ্যার বিচারে চীন ভারতের কাছাকাছি থাকলেও সে দেশ ক্ষুধামুক্ত বলে স্বীকৃত।
এই ধরনের রিপোর্টকে অতীতেও কুযুক্তি দিয়ে অস্বীকার করার প্রাণান্তকর চেষ্টা হয়েছে। একইভাবে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে ভারতের পিছিয়ে পড়া, আদানি ইস্যু বা অন্য ক্ষেত্রে যখনই আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গিয়েছে তখনই ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট করার ষড়যন্ত্রের কথা শুনিয়েছেন অমিত শাহরা। এবারেও সেই এক বুলি। লজ্জাও নেই এদের!