প্রচারের আড়ালে প্রশ্ন থাকছেই

Must read

নির্লজ্জ প্রচারের ঢক্কানিনাদ, মিথ্যা জয়ের তূর্যনিনাদ। ১০০ কোটির টিকা-ডোজ নিয়ে অহেতুক আদিখ্যেতা। এ-সব দিয়ে আসলে আড়াল করার চেষ্টা চলছে কিছু সত্যেকে। সে-সব প্রশ্ন আর সত্যকে তুলে ধরছেন আকসা আসিফ
‘‘সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর’’
— ভারতচন্দ্র রায়
কোভিড মোকাবিলায় ব্যর্থ যারা, প্রচারের ঢাক পেটাচ্ছে তারা। তাই, রায়গুনাকর কবির উদ্ধৃত পঙক্তির কথা মনে পড়ে গেল।
মোদি সরকারের গাফিলতি আর উদাসীনতার কারণেই আমরা লক্ষ লক্ষ সহনাগরিককে কোভিড অতিমারির পর্বে হারিয়েছি। আর এখন, প্রচারের ঢাক পিটিয়ে সেই মৃত্যুপর্বকে মুছে দিতে চাইছে ওই মোদি সরকার। টিকার ডােজের সংখ্যার কথা উঁচু-গলায় উচ্চারণ করে গোপন করতে চাইছে তাদের ব্যর্থতার পাটিগণিত।
কেন বলছি এ-কথা, আসুন একটু বুুঝিয়ে বলি।
প্রত্যেক ভারতীয় তাঁর চেনা পরিচিতদের মধ্যে কাউকে না কাউকে হারিয়েছেন কোভিড-১৯-এর প্রথম কিংবা দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায়। প্রত্যেক ভারতীয়র আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কেউ না কেউ হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছেন, ভারতের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর দুরবস্থা। হাসপাতালে বেড জােটেনি। ভেন্টিলেশনে রোগীকে রাখার ব্যবস্থা করা যায়নি। অক্সিজেন সিলিন্ডার পেতে নাজেহাল হতে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা ভারেতর বাদবাকি অংশের চেয়ে আলাদা হলেও এ-রাজ্যে বসেই আমরা টের পেয়েছি উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট প্রভৃতি রাজ্যে মরণের ছায়াপাত কী ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। আমরা শিউরে উঠেছি গঙ্গায় ভাসমান লাশের ছবি দেখে। এত সহজে, স্রেফ প্রচারের রূপটানকে আশ্রয় করে ঢেকে ফেলা যাবে অগণিত ভারতবাসীর মনের ক্ষত! এতই সহজ আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া!

আরও পড়ুন-ট্যুইটে কৈলাসের সঙ্গে সারমেয়র ছবি! তথাগতর পোস্টে বেআব্রু বিজেপির কোন্দল

কেন এমনটা হয়েছিল, সেটা একবার তলিয়ে দেখবেন না মোদিজি? একবারের জন্যও, অনুতাপের অশ্রু না ফেলুন, অন্তত আত্মসমীক্ষাটুকু করবেন না! নাকি সে-সব না-করে, স্রেফ প্রচারের ঢাক, শিঙা আর আলোকে আশ্রয় করে ইতিহাসটাই গুলিয়ে দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাবেন!
এই প্রধানমন্ত্রীই কােভিডের টিকা বিদেশে রফতানি করে কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে কেন্দ্রের সরকার জয়লাভ করেছে, এমন প্রচার চালিয়েছিলেন। এই প্রধানমন্ত্রীই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে কান না দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী সমাবেশ করেছেন একের পর এক, েকাভিড সংক্রমণ বাড়াতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছেন এভাবেই। সর্বোপরি, কােভিডের দ্বিতীয় ঢেউ যখন আছড়ে পড়েছে, তখন এই প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতি মেকাবিলায় তৎপর হননি। ফলে, আম-আদমি তো বটেই, গেরুয়া শিবিরের অনেক নেতা-কর্মী তাঁদের আত্মীয়-পরিজনদের বাঁচাতে অক্সিজেন সিলিন্ডার ভিক্ষা করেছেন হাসপাতালে হাসপাতালে। মোদি-সরকারের বধির কর্ণে সে-কান্না পৌঁছয়নি।

আরও পড়ুন-রাজ্যে ফের চালু কনটেনমেন্ট জোন, বিশেষ সতর্কতা মহানগরীতেও

সেই সংকটের ক্ষণে, যাঁরা রাস্তায় নেমে, সরাসরি মানুষকে স্বাস্থ্য-পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন, তাঁদেরই বরং কীভাবে হেনস্থা করা যায়, তার ছক কষতেই ব্যস্ত থেকেছেন প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দল পরিচালিত রাজ্য প্রশাসনগুলি। যাঁরা অক্সিজেন সিলিন্ডার নগদমূল্যে কিনে তা বিনামূল্যে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে উদ্যোগ নিয়েছেন, পুলিশ তাঁদের কীভাবে মামলায় ফাঁসাতে পারে, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে গৈরিক প্রশাসন। সোনু সুদের বাড়িতে কেন্দ্রীয় এজেন্সির হানা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এক বৃহৎ পরিকল্পনার নির্দিষ্ট অংশ বিশেষ। এ-সব করে কােভিড যখন প্রতিহত করা গেল না, তখন আবির্ভূত হল মোদি-প্রশাসন। কী করতে? রাজ্যগুলিকে কোভিড মোকাবিলায় ব্যর্থতার দায়ে দোষারোপ করতে। ব্যস! ওতেই তাদের যাবতীয় তৎপরতা ফুরিয়ে গেল।

আরও পড়ুন-দেড় বছরে পেট্রোলের দাম বেড়েছে ৩৬ টাকা

এই প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারটিকে প্রথম দিকে কােভিড-১৯ অতিমারির মোকাবিলায় জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা সংক্রান্ত আইন প্রয়োগ করতে দেননি। শেষ পর্যন্ত যখন সুপ্রিম কোর্ট এ নিয়ে তৎপর হয়েছে, তখন ব্যবস্থা গ্রহণে কার্যত বাধ্য হয়েছে মোদি সরকার, অনেকটা দেরি করে, শেষমেশ শীর্ষ আদালতের কারণেই কোভিডে জীবনহানির জন্য মৃত্যুপিছু পঞ্চাশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষিত হয়। তরতাজা জীবন চলে গেল সরকারের উদাসীনতায় আর ব্যর্থতায়, অথচ তার জন্য ক্ষতিপূরণ মাত্র ৫০ হাজার টাকা! এবং সেটাও একটা বড় ভাঁওতা। সেটুকুও মৃতের আত্মীয় পরিজনদের হাতে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ এই বেহায়া সরকার। প্রচারের ঢাক পিটিয়ে, আলোর রোশনাই দিয়ে সে-সব ভুলিয়ে গুলিয়ে দেওয়া যাবে।
অতিমারি-পর্বে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ভয়ানক রূপ এবং তা মোকাবিলায় মোদি-শাহ-নির্মলাদের ব্যর্থতার কথা যত কম বলা যায়, ততই ভাল। সমীক্ষায় প্রকাশ, এম এস এমই অর্থাৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থা এবং স্টার্ট-আপগুলোর ৫৯ শতাংশ হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে কিংবা তারা সঙ্কোচনে বাধ্য হয়েছে কোভিড অতিমারির সৌজন্যে। সারা দেশে বিভিন্ন সংস্থায় কর্মী ছাঁটাই হয়েছে, বেতনে ছাঁটাই হয়েছে, ঘরে ঘরে স্বাস্থ্য বাবদ খরচ বেড়েছে মারাত্মক হারে, বাজার আগুন হওয়ায় জমানাে অর্থে হাত পড়েছে বিশ্রীভাবে। মনে রাখতে হবে, সারা দেশে স্বাস্থ্যসাথীর মতো প্রকল্প নেই। এর পরেও, মোদি সরকারের সৌজন্যে পেট্রোপণ্যের দাম বেড়েছে বেলাগাম গতিতে, প্রায় প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে। সব মিলিয়ে, মনে হয়েছে এবং হচ্ছে, জনগণকে নিষ্পেষিত ও নির্যাতিত করাটাই এই সরকারের একমেবাদ্বিতীয়ম কর্মসূচি। প্রচারের মিথ্যা জৌলুসে তা আড়াল করা যাবে!

আরও পড়ুন-ত্রিপুরায় বিজেপির বর্বরতা চলছেই প্ররোচনা উপেক্ষা করে পথে তৃণমূল

এই প্রচারের ঢাকপিটিয়ে গোপন করা যাবে কি কিছু মারাত্মক তথ্য? ১. দেশের মাত্র ২১ শতাংশ নাগরিক টিকার দুটো ডোজ পেয়েছেন। সম্পূর্ণ টিকাকরণের তালিকায় ভারতের স্থান ১-এ নয়, ১৯-এ। ২. এখন যা অবস্থা তাতে দেশবাসীকে পুরোপুরি টিকাকরণের আওতায় ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আনতে হলে রোজ ১৫১ লক্ষ টিকার ডোজ দিতে হবে। বর্তমানে গড়ে রোজ ৩৫ লক্ষ ডোজ দেওয়া চলছে। আগামী ৭০ দিনের মধ্যে ৯৩ কোটি প্রাপ্তবয়স্কের সম্পূর্ণ টিকাকরণ মোটেই সহজ বিষয় নয়, অথচ এ-নিয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা মোদি-সরকার এখনও জানায়নি। ৩. ৪ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে দেশে প্রায় ৩০ কোটি নাবালক-নাবালিকা আছে। তাদের টিকাকরণ কবে থেকে এবং কীভাবে হবে, তা এখনও অজানা। ৪. সিনিয়র সিটিজেন, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ এবং সমাজকর্মী, এঁদের বুস্টার ডোজ দেওয়ার কী ব্যবস্থা হল বা হচ্ছে, সেটাও এখনও অজ্ঞাত।
সব মিলিয়ে ‘টিকা জুমলা’য় রবিঠাকুরের দুটো পঙ্িক্ত সামান্য পরিবর্তন করে বলতে ইচ্ছে করছে—
মিথ্যে ভেলকি, ভূতের হাঁচি, মিথ্যে কাচের পাল্লা—
তাহার অধিক মিথ্যে তোমার প্রচার ঢাকের বাজনা।

Latest article