চারিদিকে সারি সারি বই, কিংবা ঘরে-ঘরে শুধইু ভরা বইয়ের র্যাকের মাঝে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ার অভ্যাস বা নেশা অনেকেরই রয়েছে। এই নেশা কাজে লাগিয়ে পেশার জগতে প্রবেশও কঠিন কাজ নয়। অত্যন্ত নিয়মমাফিক এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বই পড়ার ব্যবস্থার জন্য গড়ে উঠেছে নানা মাপের লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক, সংঘগত, সরকারি-আধাসরকারি আধুনিক প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে-সঙ্গে এই গ্রন্থাগারগুলিকে পাঠকবান্ধব, পেশাদারি মনোভাব নিয়ে চালু রাখা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য গ্রন্থাগারিকের পেশাতেও ঘটছে ব্যাপক বিবর্তন, বাড়ছে কাজের ক্ষেত্রও। মাইক্রোফিল্মিং, ডিজিটাল, অনলাইন রিডিং ইত্যাদির কথা ভাবাও এখন অপরিহার্য।
আরও পড়ুন-হার্দিককে খেলানোই ভুল: হগ
গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান কী
গ্রন্থাগারে কাজ করা মানে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা থাকাটা বাঞ্ছনীয়। একটি লাইব্রেরি পাঠকের জন্য জ্ঞান, তথ্যপ্রদান বা গবেষণার কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই, গ্রন্থাগারের নিয়ম-শৃঙ্খলা, সুস্থ পরিবেশ, হিসাব-নিকাশ, বইয়ের রক্ষণাবেক্ষণ, পাঠকের সুবিধা-অসুবিধা— এরকম হাজারো দিক সামলানোর জন্য উপযুক্ত গ্রন্থাগারিক প্রয়োজন। সেই চাহিদা থেকেই তৈরি হয়েছে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের মতো বিষয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের পাশাপাশি গ্রন্থাগারিকরা গুরুদায়িত্ব সামলে থাকেন। বইয়ের ধরন ও বিষয়গত শ্রেণিবিভাগ এবং প্রকাশনা নিয়ে এত পরিমাণ বৈচিত্র এসে গেছে, যার দরুণ নিদির্ষ্ট বিষয় বা পাঠক চাহিদার উপর নির্ভর করে নতুন নতুন লাইব্রেরি গড়ে উঠছে। ফলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গ্রন্থাগারিকের পেশার চাহিদাও। একাজে বই ছাড়াও বিভিন্ন ইনফরমেশন সোর্স সম্বন্ধে খবর রাখার প্রবণতা থাকা ভাল।
কী ধরনের কোর্স রয়েছে
লাইব্রেরি সায়েন্স বা গ্রন্থাগার বিজ্ঞান নিয়ে সার্টিফিকেট, ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা কোস রর্য়েছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে মূলত লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্স বিষয়ে ডিগ্রি কোস কর্রানো হয়। স্নাতক স্তরের পরে এই বিষয় নিয়ে পোস্ট গ্র্যাজেুয়শনও করা যেতে পারে শিক্ষকতার পথে যাওয়ার জন্য। লাইব্রেরি সায়েন্স বিষয়ের মধ্যে মূলত লাইব্রেরি শ্রেণিবিভাজন, ম্যানেজমেন্ট, লাইব্রেরি ইনফরমেশন অ্যান্ড সোসাইটি, ইনফরমেশন সোর্স অ্যান্ড সার্ভিসেস— এই সমস্ত বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করতে হয়।
আরও পড়ুন-রিকশাচালককে প্রায় সাড়ে ৩ কোটির নোটিস!
কীরকম যোগ্যতা লাগে
তিন বছরের গ্র্যাজেুয়শন কোর্স করা থাকলে ১ বছরের বিলিব বা বিলিব অ্যান্ড আইএসসি কোসে ভর্তি হওয়া যায়। ৫০ শতাংশ নম্বর-সহ বিলিব কোর্স করে থাকলে এমলিব বা গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের মাস্টার ডিগ্রি করা যেতে পারে। কলেজে শিক্ষকতা করার জন্য এমফিল করারও সুযোগ রয়েছে। এর বাইরেও উচ্চমাধ্যমিক যোগ্যতায় সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমা কোসর্ও করা যেতে পারে একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে। শিক্ষাগত যোগ্যতার বাইরে বই, পুস্তিকা, ম্যাগাজিন, পত্রিকা-সহ সমস্ত প্রকাশনা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। একাধিক ভাষা সম্পকে ধারণা, নিজেকে প্রকাশনার বিষয়ে আপডেট রাখা এবং পাঠকের সঙ্গে উন্নতমানের কমিউনিকেশন স্কিল বজায় রাখার দক্ষতা থাকা দরকার। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ধারণা তো দরকারই, শুরুতে অতটা না হলেও কম্পিউটারের জ্ঞান থাকা চাই-ই।
কোথায় পড়া যেতে পারে
লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্স নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিলিব, এমলিব করা যায়। এছাড়াও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশুনা করা যেতে পারে। কলকাতার বেঙ্গল লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন থেকে একটি সার্টিফিকেট কোর্স করানো হয়। রাজ্যের বাইরেও মুম্বই ইউনিভার্সিটি, পুণে ইউনিভার্সিটি, পঞ্জাব ইউনিভার্সিটি, ম্যাঙ্গালোর ইউনিভার্সিটি থেকে লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্স নিয়ে পড়ানো হয়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই এই বিষয় নিয়ে ভতি হর্ওয়ার জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে হয়। এর বাইরে দূরশিক্ষায় ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকেও এক বছরের ব্যাচেলর ইন লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্সের কোস রর্য়েছে। এছাড়াও হালদার আকাদেমি, সোনারপুর, বেঙ্গল ইনস্টিটিউট, পাঁশকুড়ার মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পড়া যেতে পারে।
কীরকম কাজ করতে হয়
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে মিনি জু এখন জুলজিক্যাল পার্ক
পাঠক বা ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন তথ্য বা খবর দিয়ে সঠিকভাবে পরিচালনা করা এবং বই সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য বা বিবরণ প্রদানের কাজ করতে হয় গ্রন্থাগারিকদের। একটি গ্রন্থাগারের জন্য একজন মুখ্য গ্রন্থাগারিক এবং তাঁর অধীনে সহকারী গ্রন্থাগারিক নিয়োগ করা হয়। লাইব্রেরির ফিনান্সিয়াল অপারেশন, ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, বইয়ের সম্ভার সংরক্ষণ প্রতিটি বিষয়েরই দায়িত্ব থাকে গ্রন্থাগারিকদের উপর। বই কেনা বা সংগ্রহ, রেকর্ড বজায় রাখা, নতুন প্রকাশনা সম্পর্কে প্রতিনিয়ত আপডেট থাকা, সমস্ত দিকে খেয়াল রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ধৈর্য এবং মনোযোগ সহ পাঠকের জন্য বই, প্রকাশনা বা নানান তথ্য সম্পর্কে অবগত করার জন্য সচেষ্ট থাকতে হয়। সেক্ষেত্রে পাঠককে ভুল বা ত্রুটিপূর্ণ তথ্যপ্রদান থেকে যাতে বিরত থাকা যায়, সে-বিষয়ে যত্নশীল থাকতে হয়। কাজ এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লাইব্রেরি অ্যাটেন্ড্যান্ট, জুনিয়র লাইব্রেরিয়ান থেকে লাইব্রেরি অ্যাসিস্ট্যান্ট, চিফ লাইব্রেরিয়ান পদে উন্নীত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, ইনফরমেশন সেন্টারগুলিতে ডিরেক্টর অব ইনফরমেশন সেন্টার, ইনফরমেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট-এর মতো পদগুলিও রয়েছে। এর বাইরে লাইব্রেরি সায়েন্স নিয়ে শিক্ষকতার দিকটিও যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য। ইউজিসি আয়োজিত নেট পরীক্ষার মাধ্যমে কলেজগুলিতে লাইব্রেরি আ্যন্ড ইনফরমেশন সায়েন্স নিয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগ রয়েছে। এমনকী এই বিষয়ে গবেষণামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রবণতাও বাড়ছে।
পেশার চাহিদা কেমন
লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্স নিয়ে পড়াশুনা করার পর সরকারি বা বেসরকারি গ্রন্থাগার, বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার, নিউজ এজেন্সি বা প্রতিষ্ঠান, ইনফরমেশন সেন্টারগুলিতে কাজের বহু সুযোগ রয়েছে। সরকারি স্কুল, কলেজগুলিতে গ্রন্থাগার হিসাবে কাজের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পরীক্ষা নেওয়া হয়। এ ছাড়াও বহু বেসরকারি লাইব্রেরি, প্রকাশনা সংস্থা থেকে শুরু করে একাধিক ইনফরমেশন সেন্টার রয়েছে, যেখানে লাইব্রেরি সায়েন্সে স্নাতকদের নিয়োগ করা হয়। এর বাইরে মিউজিয়াম, গ্যালারি, ফটো বা ফিল্ম লাইব্রেরিগুলিতেও কাজের সন্ধান করা যেতে পারে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে, পাঠক বা পাঠ্য বিষয়ের উপর নির্ভর করে পাবলিক লাইব্রেরি, চিলড্রেন লাইব্রেরি, গবেষণামূলক লাইব্রেরি তৈরি হচ্ছে, যার কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়ছে যথেষ্ট পরিমাণে।