অরিজিৎ চক্রবর্তী: দেবীর মাহাত্ম্য, ভক্তের মাহাত্ম্য। একজনের জন্যই আরেকজন। ভক্তই তো পূজা করে, দেবীকে স্বীকৃতি দেয়। সেখানে প্রতিস্পর্ধিতা আছে, আছে ক্ষমতার খেলা। রামও ভক্ত, রাবণও ভক্ত। দেবীকে ধরে দুজনেই টানাটানি করছেন। কিন্তু অসুর! তার প্রতি আমরা কতটাই বা সহানুভূতিশীল? কতটুকুই বা অনুরক্ত?
আরও পড়ুন-রবীন্দ্রনাথহীন বিশ্বভারতী, ধিক্কার-সমালোচনা সব মহলে
কিন্তু এই ভারতেই আছে আদিবাসী শ্রেণীভুক্ত অসুর সম্প্রদায়। আর তারাই দুর্গাপুজোর সময় এই অসুরের পুজো করে শোকজ্ঞাপন করেন। আদিবাসী সমাজে মহিষাসুর হল তাঁদের রাজা হুদুড় দুর্গা। তাই হুদুড় দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধা ও শোকজ্ঞাপন করে আজও প্রথা মেনে হয় দাঁশাই নাচ। ‘হুদুড় দুর্গা’ র শোকে শালবনীর কেঁন্দাশোল গ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষেরা এই পুজো করে থাকেন।জঙ্গল মহলের আরো বেশ কয়েকটি জেলায় পুজোর কদিন স্মরণ করা হয় হুদুড় দুর্গা বা মহিষাসুরকে। সপ্তমীর সকাল থেকে দশমী পর্যন্ত হুদুড় দুর্গার সামনে চলে ‘দাঁসাই’, ‘ভুয়াং’ নাচ। সাঁওতালি লোকসাহিত্য অনুযায়ী, ‘হুদুর’ কথার অর্থ প্রচণ্ড জোরে বয়ে চলা বাতাস কিংবা ঝড়।
আরও পড়ুন-তেজ নিম্নচাপে ৬ জেলায় বৃষ্টি
লোককথা অনুযায়ী হুদুর দুর্গা ছিলেন অসুর সম্প্রদায়ের বহু বছরের পুরনো পূর্বপুরুষ, চাইচাম্পা গ্রামের রাজা। তিনি অত্যন্ত বলশালী ও ক্ষমতাধর রাজা ছিলেন।আর্যরা ভারতে আসার পর কোনমতেই তাকে পরাজিত করতে পারছিল না। তখন তারা বিভিন্নভাবে রাজাকে মারার উপায় খুঁজতে থাকে। অবশেষে তারা জানতে পারে রাজা অত্যন্ত নারীবৎসল এবং তাদের সমাজেও নারীদের স্থান উঁচুতে। তাই আর্যরা রাজাকে হত্যা করার জন্য গুপ্তচর হিসেবে এক গৌরবর্ণের রূপবতী নারীকে পাঠায়। আর্যগণ রাজার কাছে উক্ত নারীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় এবং রাজাও নারীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হন। বিয়ের পর নয়দিন রাজা উক্ত নারীর সঙ্গে রাত্রি যাপন করেন এবং নবম দিনে সেই নারী রাজাকে হত্যা করে। রাজার মৃত্যুর খবর শুনে আর্যরা রাজ্য দখলের উদ্দেশ্যে রাজ্যে আক্রমণ করে এবং রাজ্যের পুরুষরা তাদের ধর্মগুরুর পরামর্শ অনুসারে সরস্বতী নদীতে স্নান করে নারীর বেশ ধারণ করে দাসাই নৃত্য করতে করতে রাজ্য থেকে পালিয়ে যায়। এই ঘটনায় নারীকেই আর্যরা অর্থাৎ হিন্দুরা দেবী দুর্গা হিসেবে এবং রাজাকে মহিষাসুর হিসেবে অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করেছে বলেই আদিবাসীদের দাবি । এবং তাদের আরও দাবি যে , তাদের রাজা হুদুর দুর্গার নামই উক্ত নারীর নাম হিসেবে ভুলভাবে বর্ণিত হয়েছে। দুর্গাপূজার সময় তারা দুর্গাকে পূজা না করে মহিষাসুর পূজা করে থাকে এবং নারীদের বেশ ধরে পথে পথে দাসাই নাচ করে শোক পালন করে থাকে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
বোগাজকোই লিপি থেকে জানা যায় যে অনার্য অসুর জাতি ছিল খুবই উন্নত। ‘ঋগ্বেদ’-এর ১.১০৮.৮ শ্লোকে বলা হয়েছে আর্য-অনার্যদের যুদ্ধের কাহিনি, আর্যদের শোষণের ইতিহাস ও চাতুর্য। উৎসব ভিন্ন ভিন্ন জাতির কাছে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উদ্যাপিত হয়। যেমন হিন্দুদের দুর্গাপুজো আবার সাঁওতালদের হুদুড় দুর্গার দাঁসায় পরব। হিন্দুদের কাছে তা আনন্দের আর সাঁওতালদের কাছে তা শোকের পরব। এই ভিন্নতাই ভারতের সংস্কৃতিকে আরও স্বতন্ত্র ও ঐতিহ্যবাহী করে তোলে। তাই মহিষমর্দিনীকে যতটা সেকুলার বলে চালানোর চেষ্টা দেখি এবং দিনদিন সেই চেষ্টার যত বাড়বাড়ন্তই হোক না কেন, রণরঙ্গিনী আদৌ ততটা সেকুলার নন। পুজোটা একটা ফ্রেম মাত্র। আমাদের জীবন গাঁথার আনন্দ ও দুঃখের মুহূর্তকে শাশ্বতের মর্যাদা দেয় এই সিংহবাহিনী মা দুর্গা।