স্বর্ণালী দত্ত: বঙ্গোপসাগর উপকূলের ছোট ছোট দ্বীপগুলো এক-একটি জনজাতির বসতি। এদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি শহরের থেকে অনেকই আলাদা। ভাষা এদের আঞ্চলিক। আলোর রোশনাইয়ে ঢাকা কলকাতার থেকে পুজোর সময় এই দ্বীপগুলো অনেকটাই আলাদা। সাগরপাড়ের অঞ্চলগুলোর মধ্যে নামখানা একটি জনবহুল দ্বীপ। এই অঞ্চলের একটি প্রাচীন পুজো শিবমন্দিরের পুজো (Namkhana- Puja)। পুজোটি শুরু হয়েছিল ১৩৫৮ বঙ্গাব্দে। স্থানীয় দ্বারিকনগরের হাসপাতালের তৎকালীন ডাক্তারবাবু বি. মজুমদার কর্তৃক এই পুজো আরম্ভ হয়। তিনি নিজ উদ্যোগে গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়ে পুজোর আয়োজন করেন। সেইসময় তিনি নিজে সমস্ত ব্যয়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
মন্দিরে দুর্গাপুজোর (Namkhana- Puja) প্রস্তুতি শুরু হয় দু’মাস আগে থেকে। গ্রামবাসীদের একত্রিত করে একটি সাধারণ সভার মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হয়। তারপর দিনক্ষণ দেখে ‘খুঁটিপুজো’-র মতো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পুজোর শুভ সূচনা হয়। এখানে প্রতিমা কেনার কোনও নিয়ম নেই। শিল্পী এসে মন্দির প্রাঙ্গণে মূর্তি নির্মাণ করেন। এখানে শিল্পীদের মধ্যে রয়েছে প্রকৃতির মিশেল। খুব সাধারণ একটি একচালার প্রতিমাও শিল্পীর ছোঁয়ায় অসাধারণ মায়াময় হয়ে ওঠে। গ্রামের মেয়েরা মণ্ডপের চারপাশে গ্রামীণ আলপনা দিয়ে সাজিয়ে তোলে। নিত্য পুজোর মন্দিরও যেন নতুন সাজে সেজে ওঠে।
এই এলাকা একসময় জল-জঙ্গলে ভর্তি ছিল। মনুষ্যবাসের অযোগ্য ছিল। গ্রামের লোকেরা দীর্ঘদিনের চেষ্টায় জঙ্গল পরিষ্কার করে একটু একটু করে বসতি তৈরি করেছে। এখন আর আগের মতো জঙ্গল নেই। তবে গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ এই অঞ্চল। যেখানে রাস্তাঘাট অনুন্নত, যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও দুর্গম, সেইখানে একযোগে একটি দুর্গাপুজোর আয়োজন করা সত্যিই খুব কঠিন ব্যাপার। তাও মন্দিরের নিত্য পুরোহিতের সহযোগিতায় নিয়ম-নিষ্ঠাভরে পুজোর সমস্ত বিধি-নিয়ম পালন করা হয়।
সেই আদিকাল থেকে নবমীর তিথিতে মায়ের ভোগ প্রসাদ হিসেবে খিচুড়ি, আলুর দম ইত্যাদি অগণিত ভক্তের উদ্দেশ্যে বিতরণ করা হয়। এছাড়াও প্রতিদিনই সন্ধ্যা আরতির পর থাকে মায়ের নিত্য প্রসাদ বিলি। স্বত্ত্ব, তম এবং রজঃ এই ধারাকে বজায় রেখে সাত্ত্বিকভাবে এই পুজো করা হয়। শহরের পুজোর জৌলুস, অর্থনৈতিক বাহুল্য, আড়ম্বর এই পুজোয় নেই ঠিকই, কিন্তু এই পুজোয় রয়েছে মানুষের সারল্য ও আন্তরিকতা। দুর্গা প্রতিমার রূপ এখানে থিম পেরিয়ে সাক্ষাৎ মায়ের মতো। পুজোর ক’দিন এলাকার সবাই একজোট হয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। এরই সঙ্গে ঘটে প্রত্যেক গৃহে আত্মীয় সমাগম।
আরও পড়ুন-আজও নররক্তে সন্ধিপুজো হয় কোচবিহারের বড়দেবীর
কুমারী পুজোর প্রচলন আগে থাকলেও এখন আর হয় না। সন্ধিপুজোর সঙ্গে হয় নবমীর যজ্ঞ। কোনওরকমের প্রাণী বলি মন্দির প্রাঙ্গণে নিষিদ্ধ। প্রাণীর প্রতিরূপ হিসেবেও কোনও বলি হয় না এখানে। বিজয়ার দিন কমিটি সদস্য, সমস্ত গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে পুরোহিত ঠাকুর বিসর্জনের পুজো সম্পন্ন করেন। গ্রামের মহিলারা নিয়মমতো পান-সুপারি দিয়ে বরণ করে মিষ্টিমুখ করান মাকে। এবার মায়ের কৈলাসে ফেরার পালা।
এই অঞ্চলে পুজোর সময় অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষের জন্য বস্ত্রদান করা হয়। এছাড়াও মুমূর্ষু রোগীদের সাহায্যার্থে হয় রক্তদান শিবির এবং উল্লেখযোগ্য কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ কোনও বিশেষ ব্যক্তিবর্গকে সম্মান দেওয়া হয়। এলাকার কৃতী ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ বাড়ানোর জন্য তাদের পুরস্কৃত করা হয়। এইসব আয়োজন মূলত গ্রামের যাঁরা একটু অবস্থাপন্ন পরিবার তাঁরাই করে থাকেন। একে অপরের পাশে থাকার অভ্যাস এদের চিরকালীন।
প্রথমদিকে এই পুজো অনুষ্ঠিত হত চাঁদা তুলে এবং কিছুটা জমিদারের সহযোগিতায়। সেইসময় বিদ্যুৎ থাকত না বলে জমিদারবাড়ি থেকে আনা হ্যাজাকের আলোয় পুজো হত। প্রধান পুরোহিত ঠাকুরের কথায়, ‘‘আজকের দিনে সেই অর্থনৈতিক দুর্দশা নেই ঠিকই, কিন্তু আগেকার সেই সরলতা, একাত্মতা অনেকটাই বিলুপ্ত। তবুও এখনও গ্রামবাসীরা এবং পুজো কমিটি তার স্বকীয়তা বজায় রেখে সুস্থ সংস্কৃতিকে অক্ষুণ্ণ রেখে পুজো আয়োজন করি। গ্রামবাসীদের জন্য প্রত্যেকদিন একটি সান্ধ্য অনুষ্ঠান হয় এবং রাতে থাকে যাত্রাপালা।’’ এইভাবেই নামখানা অঞ্চলের গ্রামগুলি প্রকৃতির সংসর্গে মা দুর্গার আরাধনা করে আসছে, এই বছরও তার অন্যথা হচ্ছে না।