রসগোল্লাকে যদি হারাত বাঙালি, তাহলেও কি তার মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেত? বোধ হয় না। কারণ, বাংলার মিষ্টির (sweets) ইতিহাসের ভাঁড়ার অগাধ। আজ সেই নিয়েই বরং দু’চার কথা বলা যাক।
খাস কলকাতা হোক কি জেলা শহর বর্ধমান কি অনামী মুড়াগাছা— বাংলার মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে কন্ট্রিবিউশনে কেউ পিছিয়ে নেই। লেডি ক্যানিংকে সম্মান জানাতে গিয়ে যে খোদ ভীম নাগ লেডিকেনি (যার আর এক নাম পান্তুয়া) বানিয়েছিলেন সেকথা আজ সর্বজনবিদিত। কিন্তু অনেকেই হয়ত ভুলে গেছেন যে দরবেশ মিষ্টিটিরও জন্মস্থান কলকাতা— দরবেশদের আলখাল্লা যেহেতু নানা রঙের কাপড়ের টুকরো সেলাই করে তৈরি হত তাই দু-তিন রঙের বোঁদের তৈরি নরম নাড়ুকে আমরা দরবেশ বলে ডাকতে শুরু করলাম। বর্ধমানের সীতাভোগ বা মিহিদানার (sweets) কথাও সবাই জানেন— সুকুমার সেন অবশ্য বলে গেছেন বানানটি হওয়া উচিত সিতাভোগ, সিতা অর্থে সাদা। আবার সিতা-র মানে মিছরিও হয়, তাই সাদা রঙের মিছরির মতো যে মিষ্টি বর্ধমান রাজবাড়ির হালুইকররা বানালেন তার নাম হয়ে গেল সিতাভোগ। মুড়াগাছা আবার বিখ্যাত ছিল ছানার জিলিপির জন্য, কোনও অজ্ঞাত কারণে মুড়াগাছার ছানার জিলিপি কৃষ্ণনগরের সরভাজা, সরপুরিয়া বা নাটোরের কাঁচাগোল্লা কি জনাইয়ের মনোহরা কি শক্তিগড়ের ল্যাংচার মতো বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারেনি— যদিও ছানার জিলিপি এই ২০২৩-এও বাঙালির অন্যতম প্রিয় মিষ্টি।
মিষ্টির (sweets) নামকরণের ব্যাপারটি রীতিমতো ইন্টারেস্টিং। ধরুন লুচিতে ক্ষীরের পুর দিয়ে সেটাকে পানের মতন মুড়ে তারপর লবঙ্গ বিঁধিয়ে যদি দেওয়া হয় আপনাকে, কী নামে ডাকবেন? লবঙ্গলতিকা বলাই স্বাভাবিক। কিন্তু শুরুর দিকে এর নাম ছিল এমপ্রেস গজা। রাজাগজাদের সন্তুষ্টির জন্য অবশ্য বানানো হয়েছে আরও মিষ্টি— বাঙালির আপন রাজভোগই বলুন কি উত্তর ভারতীয় দিল্লি দরবার সবই পড়বে এ-লিস্টে। অবশ্য অনেক সময়েই মিষ্টির ইউটিলিটি বা স্রেফ আকার-আকৃতি দিয়েও আমরা নাম রেখে গেছি। গৃহদেবতার মিষ্টির থালা সাজাতে গিয়ে দেখলেন থালা একটু ফাঁকা রয়ে গেছে, তো সেই শূন্যস্থান পূরণে আপনি কাকে বাছবেন? অফ কোর্স, গুঁজিয়া। যদিও নামটা এখন গুজিয়া হয়ে গেছে কিন্তু ওই গুঁজে দেওয়ার নিমিত্তেই ওর জন্ম। গুজিয়ার কথা এলে নিখুতির কথাও অনেকেরই মনে পড়ে যাবে। এখানেও কিন্তু একটা চন্দ্রবিন্দু বাদ পড়েছে। আসল শব্দটা নিখুঁতি, অর্থাৎ যে মিষ্টির আকারে কোনও খুঁত নেই— যত কটাই ভাজুন না কেন, সব এক শেপ ও সাইজে বেরোবে। তারপর ধরুন রথযাত্রা কি দোলের সময় যে মঠ খান, সেটাই বা এল কোথা থেকে? এই মিষ্টিটি অবশ্য নিয়ে এসেছে পর্তুগিজরা, ক্রিসমাসের সময় গির্জার আকারে বানানো হত এই চিনির ড্যালা । আমরা গির্জার আকার দেখে ওর নাম দিয়ে দিয়েছি মঠ।
বহু সময়েই অবশ্য নামের বাহারে আমরা ভুলে যাই যে বাহারি মিষ্টিটি অন্য আরেকটি মিষ্টির দামি এবং পরিমার্জিত সংস্করণ বই আর কিছু নয়। হাতের কাছে উদাহরণ রয়েছে চন্দ্রপুলির। চন্দ্রপুলির আদত ভার্সনটির নাম রসকরা, বহু যুগ ধরে গ্রামবাংলার মানুষ ব্রেকফাস্টে মুড়ি-মুড়কির সঙ্গে রসকরা খেয়ে এসেছেন; সময় সময় অন্য মিষ্টির (যেমন পেরাকি) পুর হিসাবেও ব্যবহার করা হয়েছে এই রসকরাকে। চিত্রকূটের কথাও ধরতে পারেন, গোল লেডিকেনি থেকে লম্বা ল্যাংচা হয়ে চৌকোতে পৌঁছনোর পর খেয়াল পড়েছে এবার একটু ভাল নাম দেওয়া দরকার— সত্যি কথা বলতে কি আই ডোন্ট মাইন্ড, মনে রাখা দরকার ল্যাংচা শব্দটি এসেছে ‘লিঙ্গ’ শব্দটির প্রাকৃত রূপ থেকেই। গুলাবজামুনের বাংলা ভার্সন গোলাপ জামের (গোলাপ জামের সঙ্গে পরিচিতি খুব বেশি না থাকলে কালো জামের কথা ভাবতে পারেন) কথাও এসে পড়ে এ-প্রসঙ্গে— এও সেই পান্তুয়ারই রকমফের, খোয়া আর এসেন্সের দৌলতে বনেদি হাবভাব এসেছে মাত্র। রসগোল্লা হাতছাড়া হলেও স্পঞ্জ রসগোল্লা কিন্তু বাংলারই অবদান, তফাতটা কী বলুন তো? আদি রসগোল্লাতে সুজি বা সমগোত্রীয় অন্য পদার্থ ব্যবহার করা হত জমাট করে তোলার জন্য, স্পঞ্জ রসগোল্লাতে ওসবের ব্যবহার নৈব নৈব চ। এ-ছাড়া স্পঞ্জ রসগোল্লার জন্য ছানা এবং দুধ যত টাটকা হয় ততই ভাল। রসগোল্লারই আরেক বনেদি অবতার পুরনো ক্ষীরমোহন— এখন অবশ্য ক্ষীরমোহন (sweets) খুব একটা দেখা যায় না, দেখা যায় ওরই টোনড ডাউন ভার্সন ক্ষীরকদম্ব। ক্ষীরমোহনেও খোয়া মাস্ট, তার সঙ্গে পড়বে বাদাম, পেস্তা এবং কিশমিশ। ক্ষীরমোহনের মতনই আরেক দুষ্প্রাপ্য মিষ্টি হল নবাবভোগ, আকারে রাজভোগের থেকেও বড় এবং ভেতরে থাকত চার ধরনের পুর, প্রতিটি পুরের আবার সুবাস আলাদা। এই ক্যাটেগরির আরেকটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ লালমোহন— এসেন্সিয়ালি ছানাবড়া, খালি ছানাবড়া আপনি আগে ভেজে তারপর রসে চোবাচ্ছেন আর লালমোহনের বেলায় ফুটন্ত রসে ফেলে দিতে হচ্ছে। তবে ছানাবড়ার থেকে লালমোহন বানানোয় বেশি কেরামতি দরকার, কারণ ভাজা হয় না বলে ছেতরে যাওয়ার বেশি চান্স, তো না-ছেতরে যিনি গরম গরম লালমোহন তুলে আনতে পারবেন তিনিই ধন্য।
এ-সব মিষ্টি থাকতে রসগোল্লার গর্ব যদি বাঙালি হারাত তাহলেও তার ভিয়েনে টান পড়ত না।
বাঙালির মিষ্টিমুখ
আজ কার্নিভাল। দুর্গোৎসবের সমাপ্তি। এই আনন্দ অবকাশে বাঙালির মিষ্টি নিয়ে দু-চার কথা। লিখছেন তপনকুমার নাগ