রক্তবীজ

টানটান গল্প। রুদ্ধশ্বাস থ্রিলার। চেনা ছকের বাইরে নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। পুজোয় দর্শকদের উপহার দিলেন ‘রক্তবীজ’। মুখ্য চরিত্রে ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়। বহু বছর পর মূলধারার বাংলা ছবিতে তিনি। এ ছাড়াও আছেন আবির চট্টোপাধ্যায়, মিমি চক্রবর্তী, অনসূয়া মজুমদার। পুজোর আবহে মিলেমিশে একাকার শিউলি ও বারুদের গন্ধ। ছবিটি দেখে এসে লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

পুজোয় বিস্ফোরণ
প্রায় ৯ বছর আগের ঘটনা। ২০১৪-এর ২ অক্টোবর। দুর্গাপুজোর মহাষ্টমীর দিন পূর্ব বর্ধমানের খাগড়াগড়ে ঘটে যায় তীব্র বিস্ফোরণ। কেঁপে ওঠে এলাকা৷ জায়গাটা দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে। পুজো উপলক্ষে তখন তিনি বাড়িতেই ছিলেন। ঘটনায় প্রকাশ্যে এসেছিল জঙ্গিদের ঘাঁটি গেড়ে থাকা এবং বিস্ফোরক বানানোর বিষয়টি। স্বভাবতই পড়েছিল আলোড়ন। ঘটনাটি সামনে রেখে পরিচালক জুটি নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তৈরি করেছেন ‘রক্তবীজ’ (Raktabeej)।

জোর চর্চায়
ঘোষণা থেকেই ‘রক্তবীজ’ (Raktabeej) ছিল জোর চর্চায়। কারণ এর মাধ্যমেই বহু বছর পর মূলধারার বাংলা ছবিতে ফিরলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি একটা সময় শাসন করেছেন বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দারুণ রসায়ন ছিল পরিচালক দ্বয়ের। তাঁর অবর্তমানে ভিক্টর ছাড়া অন্য কারও উপর ভরসা করেননি এই জুটি। ভিক্টর অভিনয় করেছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রে। যদিও ছবিতে তাঁর নাম অনিমেষ চট্টোপাধ্যায়। সিনেমার স্বার্থে এই বদল। সামান্য বদলে খাগড়াগড় হয়েছে খয়রাগড়।

চেনা ছকের বাইরে
এই ছবিতে চেনা ছকের বাইরে বেরিয়েছেন নন্দিতা-শিবপ্রসাদ। নিয়েছেন চরম ঝুঁকি। থ্রিলার ঘরানার অ্যাকশন প্যাকড ছবি আগে করেননি তাঁরা। নির্বাচন করেছেন জবরদস্ত প্লট। জিনিয়া সেন এবং শর্বরী ঘোষালের চিত্রনাট্য, সংলাপ তৈরি করেছে ছবির কাঠামো। গল্পে সামান্য আলো ফেলা যাক। সাজাপ্রাপ্ত এক জঙ্গির মার্সিপিটিশন খারিজ করেন রাষ্ট্রপতি। সেই জঙ্গির ফাঁসি হয়। প্রতিশোধের ষড়যন্ত্র আঁকে একটি জঙ্গি সংগঠন। যার সঙ্গে যোগ রয়েছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী দলের। দুষ্কৃতীরা রাষ্ট্রপতিকে হত্যার ছক কষে। পুজোয়। যখন তিনি গ্রামের বাড়িতে আসবেন, সেই সময়। হত্যা-ষড়যন্ত্রের আঁচ পায় পুলিশ। রাজ্য পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় পুলিশ যৌথভাবে আসরে নামে। রাজ্যের পুলিশকে নেতৃত্ব দেন এসপি সংযুক্তা মিত্র। কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রতিনিধি হয়ে আসেন পঙ্কজ সিংহ। তাঁরা মোকাবিলা করেন জঙ্গিদের। টানটান গল্প। রয়েছে বহু স্তর। সময় যত গড়িয়েছে, বেড়েছে উত্তেজনা। রুদ্ধশ্বাস থ্রিলার। দারুণ সাসপেন্স। ক্লাইম্যাক্সটি চমকে দেওয়ার মতো। পুজোর আবহে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে শিউলি ও বারুদের গন্ধ।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আজ মেগা কার্নিভাল

মার্জিত ভিক্টর
বহুদিন পর বড়পর্দায় ফিরলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়। দেখে ভাল লাগল। তাঁর মার্জিত অভিনয় ছবির বড় সম্পদ। যদিও তাঁর মতো বহুমাত্রিক অভিনেতাকে আরেকটু অন্যভাবে ব্যবহার করা যেত। খামতি থেকে গেছে চিত্রনাট্যে। অ্যাকশনের পাশাপাশি আছে ইমোশন। দিদি এবং ভাইয়ের বন্ডিং আন্তরিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ভিক্টরের দিদির চরিত্রে অনসূয়া মজুমদার বড় বেশি স্নিগ্ধ। তাঁর চরিত্রের নাম গৌরীদেবী। তিনি ক্ষমার পক্ষে। সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গির মার্সিপিটিশন খারিজ করা নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে মতান্তরে জড়িয়ে পড়েন। যে যার মতো যুক্তি সাজান। রাষ্ট্রপতি বলেন, কখনও কখনও অস্ত্র ধরতে হয় দুষ্টের দমনে। অংশটি নিখুঁতভাবে বুনেছেন পরিচালকদ্বয়। সংলাপ কখনওই নাটকীয় লাগেনি। ছাড়িয়ে যায়নি মাত্রা। বয়ে গেছে ধীরে। নিচু স্বরে। দিদি এবং ভাই মাঝেমধ্যেই স্মৃতিমেদুর হয়েছেন। ফিরে গেছেন শৈশবে। চণ্ডীপাঠে নারীর অধিকার নেই, এই ধ্যানধারণাকে নস্যাৎ করা হয়েছে ছবিতে। দেবী দুর্গার সামনে ভাইয়ের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন দিদি। ছোট ছোট কিছু মুহূর্ত অদ্ভুত ভাললাগার জন্ম দেয়। দেয় নির্মল আনন্দ। আবেগ জাগায়। এই ছবি মাটির বড় কাছের। মর্মস্পর্শী। যদিও মাঝেমধ্যেই গতি বেশ মন্থর লেগেছে।

নতুন জুটির রসায়ন
সংযুক্তা চরিত্রে মিমি চক্রবর্তী নজর কেড়েছেন (Raktabeej)। পঙ্কজ সিংহ চরিত্রে আবির চট্টোপাধ্যায় দুর্দান্ত। তাঁরা এই প্রথম জুটি বাঁধলেন। নতুন লুকে স্মার্ট লেগেছে আবিরকে। অ্যাকশন করেছেন ফাটিয়ে। যোগ্য সঙ্গত মিমির। রোমান্টিক জুটি বলা যায় না তাঁদের। তবু মাঝেমধ্যে দেখা গেছে রোমান্সের ঝলক। অভিব্যক্তি এবং সংলাপে। চরিত্র দুটি নিয়ে তাঁরা ভেবেছেন। পরিশ্রম করেছেন। তাঁদের রসায়ন মন ছুঁয়ে গেছে। লোকাল থানার ওসি নিত্যানন্দর ভূমিকায় কাঞ্চন মল্লিক চলনসই। সাংবাদিকের চরিত্রে অম্বরীশ ভট্টাচার্য ঠিকঠাক। সত্য ভট্টাচার্য, দেবলীনা কুমার যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন, কাজে লাগিয়েছেন। একটি বিশেষ চরিত্রে দেখা গেছে অঙ্কুশ হাজরাকে। খলনায়ক মুনিরের চরিত্রে দেবাশিস মণ্ডল মনে রাখার মতো। তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া। বাকিরাও ভাল। সংগীত পরিচালনায় অনিন্দ্যম চট্টোপাধ্যায়, সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায় নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। ব্যবহার করা হয়েছে ‘দোহার’-এর গানও। প্রতিটি গান চিত্রনাট্যের দাবি মেনে এসেছে। ভিক্টরের মুখে শোনা গেছে রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতার অংশবিশেষ। যা উপরি পাওনা। প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর প্রশংসার দাবি রাখে।

ঝুঁকি নিয়ে সাফল্য
ছবি জুড়ে দুর্গাপুজোর আবহ। মুক্তি পেয়েছে পুজোয়। আরও কয়েকটি বাংলা ছবির সঙ্গে। চলছে জোর টক্কর। তবে মহানবমীর নাইট শোয়ে দর্শক সমাগম দেখে মনে হল, জিতে গেছেন নন্দিতা-শিবপ্রসাদ। অন্যান্য দিনেও বহু হলের বাইরেই ঝুলেছে হাউস ফুল বোর্ড। পারিবারিক বিনোদন বা সামাজিক বার্তা তাঁদের চেনা ছক। প্রথমবার তার বাইরে বেরিয়েছেন পরিচালকদ্বয়। কপাল ঠুকে। চরম ঝুঁকি নিয়ে। ঝুঁকি নিলে যে বড় রকমের সাফল্য পাওয়া যায়, উৎসবের মরশুমে তাঁরা দেখিয়ে দিলেন (Raktabeej)।

Latest article