রাজনীতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থা যখন এক হয়ে যায়, তখন সেটা যে কোনও রাষ্ট্রের জন্যই একটা চরম বিপজ্জনক বার্তা বয়ে আনে। নাৎসি জার্মানিতে যেমন এক সময় প্রায় প্রতিটি স্কুলে পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হত ইহুদিরা একটি রাষ্ট্রের জন্য কতটা ক্ষতিকর এবং তাদের উপস্থিতি রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কতটা অমঙ্গলকর। স্বৈরতন্ত্রের অন্যতম লক্ষণই হল, রাষ্ট্রশক্তি বা শাসক দল নিজের ইচ্ছেমতো পাঠ্যপুস্তকের বিষয় বা দেশের ইতিহাসকে বদলে দেওয়া।
আরও পড়ুন-বিলে সম্মতি দিচ্ছেন না রাজ্যপালরা, সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ পাঞ্জাব ও তামিলনাড়ু সরকার
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজকের ভারতবর্ষে এমন একটি শক্তি ক্ষমতায় আসীন, যাদের কার্যক্রমে প্রতিটি পদক্ষেপে তারা নাৎসি জার্মান দলকে অন্ধ অনুকরণ করে চলেছে। ভারতবর্ষের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি মিলে একটি জোট গঠন করেছে। যার নাম ‘ইন্ডিয়া’। এই ‘ইন্ডিয়া’ নামকরণে বর্তমান শাসক দল এতটাই ভীত যে, তারা বিভিন্নভাবে দেশের নাম থেকে ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটিকেই বাদ দিয়ে চলেছে। জি-২০ সম্মেলন বা প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের চিঠিতে ইতিমধ্যেই ‘ইন্ডিয়া’ নামটিকে মুছে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, কে জানত যে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকের পাঠক্রম থেকেই ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটিকে বাদ দিতে উদ্যত হবে বিজেপি সরকার।
আরও পড়ুন-মৃত্যুমিছিল, তবু গাজা নিয়ে হুঙ্কার জারি নেতানিয়াহুর, হামাসকে নাৎসি তোপ রাষ্ট্রসংঘে
সাম্প্রতিকতম খবর অনুযায়ী, এনসিআরটি (ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং বা রাষ্ট্রীয় শিক্ষা অনুসন্ধান এবং প্রশিক্ষণ পরিষদ) অনুমোদিত সমস্ত পাঠ্যপুস্তকেও এবার থেকে ‘ইন্ডিয়া’ নয়, শুধুই ভারত লেখার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে! এই এনসিআরটি’র যে কমিটি তার বেশির ভাগ সদস্যই আরএসএসের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের বিভিন্ন পদে রয়েছেন। বেশিরভাগই সংঘের শিক্ষক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। ফলত কার এবং কাদের নির্দেশে এনসিআরটি অনুমোদিত পাঠ্যপুস্তক থেকে ইন্ডিয়া নামটি বাদ যেতে চলেছে তা সহজেই অনুমেয়। স্রেফ একটা বিরোধী জোটের নামেই এত ভয় পেয়ে গেলেন নরেন্দ্র মোদিরা! যদিও, বিজেপি বা সংঘের বহুদিনের দাবি যে সংবিধান থেকেই ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি বাদ দিয়ে দেওয়া হোক। কারণ এই ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটির সঙ্গে নাকি দুশো বছরের পরাধীনতার ইতিহাস জড়িয়ে! কিন্তু এই অর্বাচীনদের কে বোঝাবে, যে ব্রিটিশরা এদেশে আসার বহু আগে থেকেই এই দেশটির নাম ছিল ‘ইন্ডিয়া’।
আরও পড়ুন-পাটাপুজো করে রাস উৎসবের ঢাকে কাঠি পূর্বস্থলীতে
গ্রিক ইতিহাসবিদ মেগাস্থিনিসের লেখাতেও রয়েছে ‘ইন্ডিয়া’ নামটি। যদিও, বিজেপি বা আরএসএস কোনওদিনই এত ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তাদের লক্ষ্য থেকেছে কেবলমাত্র নিজেদের স্বার্থে নিজেদের মতো ‘গৈরিক ইতিহাস’কে ছড়িয়ে দেওয়া। সংঘ সম্পর্কে অনেক ইতিহাসবিদদেরই একটা অভিযোগ, সংঘ অখণ্ড ভারতের গর্বের ইতিহাস বা বিভিন্ন হিন্দু রাজা এবং তাদের সাম্রাজ্য নিয়ে যতটা উৎসাহী ততটাই নিষ্প্রভ মাঝের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে। সংঘ চায় মোঘল সুলতানি শাসনকালকে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে৷ কিন্তু ইতিহাস থেকে মুছে দিলেও দীর্ঘ কয়েকশো বছর ধরে মোঘল বা সুলতান শাসকদের পাওয়া বিভিন্ন যে খাদ্যাভাস, বিভিন্ন ভাষা বা হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সংগীত কি মুছে ফেলা সম্ভব? সেগুলো তো মিশে গিয়েছে এদেশের ‘ডিএনএ’তে। ভারত তো এমনই। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সংস্কৃতি, ভাষা এসে মিশেছে ভারত আত্মায়। যে কারণে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ভারততীর্থ কবিতায় লিখেছিলেন, সেই অমোঘ বাণী
‘‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড়, চীন—
শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।”
আরও পড়ুন-পুরনো বাড়ি ভাঙতে গিয়ে মিলল প্রাচীন রৌপ্যমুদ্রা
এটাই তো ভারত আত্মা। যদিও যারা রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন থেকে রবিঠাকুরকে ব্রাত্য করে প্রধানমন্ত্রীর নামে ফলক বসায় তাদের থেকে এমন প্রত্যাশা করাটাও হয়তো বোকামি! এই যে স্রেফ রাজনৈতিক কারণে ‘ইন্ডিয়া’ নামকে মুছে ফেলা হচ্ছে সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এটাও তেমনিই মূর্খামিরই পরিচয়! শুধু বিরোধী জোটের নাম ‘ইন্ডিয়া’ বলে সংবিধান স্বীকৃত একটি নামকে মুছে ফেলার চেষ্টা শুধু অন্যায় নয়, একটি গুরুতর অপরাধও বটে৷ কিন্তু, এই প্রশ্ন যতবার উঠেছে, বিজেপি পাল্টা যুক্তি দিয়েছে, ব্রিটিশ উপনিবেশের কোনও চিহ্ন তারা রাখবে না। প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বে এক ‘নয়া ভারত’ গড়তে বদ্ধপরিকর তাঁরা৷ এই যে, ২০০ বছরের পরাধীনতার ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা, তার মধ্যেও রয়েছে নিজেদের ব্যর্থতা এবং অপদার্থতার ইতিহাসকে ঢেকে রাখার এক প্রচেষ্টা।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে গড়া পুরুলিয়া মেডিক্যালে বাড়ল পরিষেবা
দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনকে যদি ভুলিয়ে দেওয়া হয়, স্বাভাবিকভাবেই হারিয়ে যাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও। হারিয়ে যাবে ১৭৫৭ এর পলাশির যুদ্ধে সিরাজউদ্দোলা থেকে মহীশুরে টিপু সুলতানের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ইতিহাস। ভাবীকাল জানতেই পারবে না, এদেশে ব্রিটিশের অত্যাচার আর তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক বিপ্লবীর লড়াইয়ের কাহিনি। ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে যাবে মাস্টারদা সূর্য সেন, ভগৎ সিং, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার সহ হাজার হাজার বিপ্লবীর বীর গাথা৷ সংঘের প্রায় একশো বছরের ইতিহাসে এমন একজনও নেই, যিনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়াই করেছিলেন। এমন একজনও নেই যাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। উল্টে যে সময় একদিকে নেতাজি, অন্যদিকে গান্ধীজি-পণ্ডিত নেহরুরা পূর্ণ স্বরাজের জন্য লড়াই করছেন, জেল খাটছেন, তখন সংঘ নানাভাবে ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্য করেছে।
আরও পড়ুন-দখল রুখতে কড়া হবে জেলা পরিষদ
কোনওদিন প্রত্যক্ষ স্বাধীনতার লড়াইয়ে নামেনি সংঘের সদস্যরা৷ আজ এত বছর বাদে, নিজেদের ‘সাচ্চা দেশপ্রেমিক’ হিসেবে প্রচার করা সংঘ পরিবার নিজেদের অন্ধকার ইতিহাস ঢাকতে ইচ্ছাকৃতভাবেই বাদ দিতে চাইছে ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসকে। তাতে অন্তত নিজেদের লজ্জার ইতিহাসকে খানিক লুকিয়ে রাখা যাবে আগামী প্রজন্মের কাছে৷ তাই, একদিকে যেমন তৃণমূল কংগ্রেস-সহ ২৬টি বিরোধী দলের জোট ‘ইন্ডিয়া’কে ভয়, আরেকদিকে নিজেদের লজ্জার ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিয়ে একটি নব্য গৈরিক ইতিহাস লিখতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন নরেন্দ্র মোদিরা।