‘ভোঁসলে’ ছবির জন্য সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পেলেন মনোজ বাজপেয়ী। খুব সহজে আসেনি তাঁর এই সাফল্য। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী
প্রায় তিন বছর আগে, ২০১৮-র কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ঝলমলে আসরে সামনে এসেছিল ‘ভোঁসলে’ ছবির ফার্স্ট লুক। দেবাশিস মাখিজা পরিচালিত সেই ছবিতে গণপথ ভোঁসলের চরিত্রে দেখা গিয়েছিল মনোজ বাজপেয়ীকে। তখনই ছবিটি ঘিরে তৈরি হয়েছিল প্রত্যাশা। রিলিজের পর লেখা হয়ে যায় নতুন ইতিহাস। না, বক্স অফিসে ঝড় ওঠেনি। আসলে ছবির সাফল্যে এটাই একমাত্র বিবেচ্য নয়। ‘ভোঁসলে’ ছবিটি জয় করে নিয়েছিল সমালোচক এবং বোদ্ধা দর্শকদের মন। শুধু কি তাই? এই ছবির জন্য সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পেলেন মনোজ বাজপেয়ী।
একদিকে চলচ্চিত্র, অন্যদিকে ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’-এর মতো জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ— এই মুহূর্তে সাফল্যের শিখরে মনোজ। এখন তাঁর হাতে প্রচুর কাজ। তবে সবকিছু খুব সহজে হয়নি। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাননি এই জনপ্রিয় অভিনেতা। বহুবার দেখেছেন ব্যর্থতার মুখ।
তাঁর জন্ম হয়েছে বিহারের পশ্চিম চম্পারণ জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের এক কৃষক পরিবারে। মনোজ ছিলেন পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে সবুজখেতে ঘাম ঝরাতেন বাবা। মনোজ পড়াশোনা শুরু করেন গ্রামের স্কুলে। পড়াশোনার ফাঁকে তিনি চলে যেতেন জমিতে। চাষের কাজে সাহায্য করতেন বাবাকে। সেই বয়স থেকেই তিনি অভিনেতা হবার স্বপ্ন দেখতেন।
১৭ বছর বয়সে মনোজ চলে আসেন দিল্লি। ভর্তি হন কলেজে। গ্রামের ছেলে হঠাৎ দেশের রাজধানীতে পা রেখে নানা সমস্যায় পড়েন। তবে কোনও সমস্যাকেই জাঁকিয়ে বসতে দেননি। এই সময় তিনি শোনেন ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার কথা। চাক্ষুষ করেন ওমপুরি, নাসিরুদ্দিন শা’র কাজ। অভিনেতা হবার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য তিনি উঠেপড়ে লাগেন। ভর্তির জন্য আবেদন করেন ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায়। ব্যর্থ হন। একবার নয়, ব্যর্থ হন তিনবার। তখন তিনি আত্মহত্যার কথা ভাবেন। তাঁর মনে হয়, এই প্রতিষ্ঠানে যদি এন্ট্রি না পাই তা হলে তো বৃথা এই জীবন।
সেই সময় তিনি ব্যারি জন এবং রঘুবীর যাদবের সংস্পর্শে আসেন। তাঁদের পরামর্শে কিছুদিন পর মনোজ আবার আবেদন করেন ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায়। এইবার তিনি নির্বাচিত হন। তাঁর সামনে খুলে যায় অভিনয় জগতের দরজা।
একদিন তিনি বড় অভিনেতা হবার স্বপ্ন দেখতেন। অধ্যবসায় এবং পরিশ্রম দিয়ে তিনি সফল করেছেন তাঁর স্বপ্ন। এইমুহূর্তে তাঁকে দেশের অন্যতম সেরা অভিনেতা হিসেবে মনে করা হয়। তাঁকে বলা হয় মেথড অ্যাক্টর। কৈশোরের বন্ধু শাহরুখ খান বা সলমন খানের মতো সুপারস্টার তিনি নন। তাঁকে সেইভাবে দেখা যায় না রেড কার্পেটে। তিনি কাঁপাতে পারেন না বক্স অফিস। তবে স্বাভাবিক অভিনয় দিয়ে তিনি পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছেন দর্শকদের মনে। কিছু তথাকথিত মশালা ছবিতে অভিনয় করলেও, তাঁকে দেখা গেছে মূলত অন্য ধারার সিনেমায়।
দুই বন্ধু, শাহরুখ খান এবং মনোজ বাজপেয়ী একসঙ্গে একটি মাত্র ছবিতেই অভিনয় করেছেন। সেটা যশ চোপড়ার ‘বীরজারা’। বন্ধু নয়, ছবিতে তাঁরা ছিলেন একে অপরের শত্রু। শাহরুখ ছিলেন নায়িকা প্রীতি জিন্টার প্রেমিক, মনোজ স্বামী।
আরও পড়ুন-কংগ্রেসের এ কী হাল
কিছুদিন আগে একটি সাক্ষাৎকারে বন্ধু শাহরুখ প্রসঙ্গে মনোজ বলেছেন, সিনেমার জগতে আসার বহু আগে থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। দুজনের অভিনয়ের হাতেখড়ি একসঙ্গে, একটি অ্যাকটিং স্কুলে। তখন পকেটে পয়সা কোথায়? তাই আমরা দুজন খাবার ভাগাভাগি করে খেতাম। শাহরুখ বরাবরই মহিলামহলে জনপ্রিয়। এখন তো বটেই! সেই সময়েও। ওর সাফল্য আমাকে খুব আনন্দ দেয়।
‘সত্যা’, ‘শূল’, ‘রাজনীতি’, ‘বেওয়াফা’, ‘ফিজা’সহ অসংখ্য হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন মনোজ। পাশাপাশি তাঁকে দেখা গেছে তেলুগু ও তামিল ছবিতেও।
‘ভোঁসলে’ ছবির জন্য সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন, আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পরই তোপ দেখেছিলেন মনোজ। জুরি মেম্বারদের সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এর আগে তিন-চারটি পারফরম্যান্সের জন্য আমি জাতীয় পুরস্কার পেতে পারতাম। বোর্ডের জুরি মেম্বারদের নজর এড়িয়ে গেছে আমার কাজগুলো। অথচ সেই কাজগুলো দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছে। যা-ই হোক, এবারের স্বীকৃতি আমি মাথা পেতে নিলাম।
আরও পড়ুন-বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জিততেই হবে গেইলদের
সেরা সহ-অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার, স্পেশ্যাল জুরি জাতীয় পুরস্কার, ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কারের পাশাপাশি ২০১৯ সালে পেয়েছেন পদ্মশ্রী সম্মান।
সোমবার দিল্লির বিজ্ঞানভবনে ৬৭তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে মনোজ বাজপেয়ীর হাতে উঠল সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার। জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি, সন্দেহ নেই। তবু হয়তো কিছুটা হলেও বিমর্ষ তিনি। কারণ এই মাসের শুরুতেই প্রয়াত হয়েছেন তাঁর বাবা রাধাকান্ত বাজপেয়ী। তিনি সাক্ষী থাকতে পারলেন না ছেলের সাফল্যের।
চলমান জীবন। কোনওকিছুই থেমে থাকে না। এগিয়েছেন, এগোচ্ছেন, আরও এগোবেন পর্দা এবং বাস্তব জীবনের ‘ফ্যামিলি ম্যান’ মনোজ বাজপেয়ী। নতুন নতুন ছবি, নতুন নতুন ওয়েব সিরিজ। আরও অনেক সাফল্য অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য।