সিজন চেঞ্জ (Season changes) মানেই তাপমাত্রার বদল। হয় ঠান্ডা থেকে গরম, না হয় গরম থেকে ঠান্ডা। খুব গরমে বা খুব ঠান্ডায় যেহেতু তাপমাত্রার হেরফের হয় না সেহেতু শরীরে একধরনের তাপমাত্রাই সয়ে যায়। সেই তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট একটি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া পরিবেশে থাকে। যা শরীর সয়ে নেয়। তাই অল্প সর্দি-জ্বর হলেও তা সেরে যায়। কিন্তু যেই তাপমাত্রার হেরফের হয় সঙ্গে সঙ্গে নতুন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়। তখন তার সঙ্গে শরীরকে সইয়ে নিতে সময় লাগে।
শীত ঋতু আসার সময় থেকে আরও বেশি করে এই সব ভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পায় তার অন্যতম কারণ হল সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব। সূর্যরশ্মি যেহেতু এই সময় ভাইরাসগুলোকে ধ্বংস করতে পৃথিবীপৃষ্ঠে পর্যাপ্ত পরিমাণে আসতে পারে না ফলে ভাইরাস বাড়তে থাকে।
কাজেই ভাইরাল ইনফেকশন থেকেই সিজন চেঞ্জে ঠান্ডা লাগা, জ্বর বা সর্দি-কাশি ইত্যাদি হয়। আর যত ঠান্ডার ভাব বাড়তে থাকে ততই এই ভাইরাসগুলোর প্রকোপ বাড়তে থাকে। সবচেয়ে বেশি যে ভাইরাসটির প্রভাব পড়ে তা হল রাইনো ভাইরাস। বাচ্চা থেকে বুড়ো অর্ধেকের বেশির সর্দি-কাশি-জ্বরের জন্য দায়ী রাইনো ভাইরাস। এছাড়া প্যারাইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসও দায়ী। আর রয়েছে সিজনাল করোনা ভাইরাস। প্রসঙ্গত, সব করোনা ভাইরাস কিন্তু সার্স কোভ টু নয় বা কোভিড তৈরি করে না। সিজনাল করোনা ভাইরাস যা শুধু শীতকালেই সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং এর প্রভাবে সর্দি-কাশি বা জ্বর হয়। এই ভাইরাল ইনফেকশন যতটা সাধারণ হতে পারে ততটাই আবার বিপজ্জনক। এর থেকে নিউমোনিয়া পর্যন্ত গড়াতে পারে। কিছুক্ষেত্রে তখন সিভিয়র হলে মৃত্যুর সম্ভাবনা পর্যন্ত দেখা দিতে পারে।
ভাইরাল ইনফেকশনে শরীরে যে উপসর্গ দেখা যায় তা হল ফ্লু অর্থাৎ ঠান্ডা লাগা, জ্বর, গলায় কষ্ট, নাকে জ্বালা, বা কানে ব্যথা, পেট খারাপ, অ্যালার্জি, বমি, ত্বকে র্যাশ, চোখ লাল, চোখ থেকে জল পড়া ইত্যাদি। এতে বেশি আক্রান্ত হন শিশু এবং বয়স্করা। কারণ একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের চেয়ে তাঁদের রোগ প্রতিরোধ শক্তি দুর্বল থাকে।
ছোটদের সমস্যা
ছোটদের শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক সমস্যাও দেখা দেয়। কখনও কখনও বাচ্চারা নিজেদের শারীরিক সমস্যার কথা বাবা-মাকে বোঝাতে পারে না বলে খিটখিটে বা বদমেজাজি হয়ে পড়ে, খাবার খেতে চায় না, স্কুল যেতে চায় না, তখন পরীক্ষা করলে দেখা যায় আসলে তার শরীরে ভাইরাল ইনফেকশন অথবা কোনও অ্যালার্জি রয়েছে। তাই বাইরে ওইরকম প্রতিক্রিয়া সে করছে।
যদি কোনও শিশুর একই ধরনের সিজনাল (Season changes) সমস্যা বারবার হয় তাহলে তার ভাইরাল ইনফেকশন নাও হতে পারে। হয়তো তার শরীরে কোনও অ্যালার্জি রয়েছে, সিজন চেঞ্জে সেটা বেড়ে যাচ্ছে। তখন বিশেষ রক্তপরীক্ষা করাতে হবে। চিকিৎসক উপসর্গ বুঝে সেটা ঠিক করবেন।
ছোটদের ভাইরাল ইনফেকশন থেকে সুরক্ষিত রাখতে জরুরি হল ভ্যাকসিনেশন। বয়ঃসীমা অনুযায়ী ইমিউনাইজেশন চার্ট মেনেই ভ্যাকসিন দিলে রোগের তীব্রতা কম হয়। সুস্থও হয় তাড়াতাড়ি। ফ্লু এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন নেওয়া এক্ষেত্রে জরুরি।
আরও কিছু নিয়ম মানা জরুরি শিশুকে সুরক্ষিত রাখতে। যেমন স্কুলে গিয়ে হাত ধুয়ে তবেই খাবার খাবে, হাত না ধুয়ে যেন মুখে-নাকে হাত দেবে না। কারণ এই সময় বিভিন্ন ধুলোকণা, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। হাত না ধুয়ে নাকে-মুখে হাত দিলে শরীরে প্রবেশ করে সেগুলি। আর তা থেকেই বারবার এক রোগ ফিরে আসে।
শিশুকে পুষ্টিগুণসম্মত খাবার দিতে হবে। যদি ভিটামিন বা মিনারেল কম থাকে শরীরে তা হলে সে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবে। শুধু ভিটামিন খেলে একদিনে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় না। খাবার খেতে হবে। যদি খাবার খেতে না চায়, তা হলে ভিটমিন সাপ্লিমেন্ট খাওয়াতে হবে। প্রোটিন, ফ্যাট, ফাইবার সব ধরনের খাবার এবং সঙ্গে পর্যাপ্ত জল খাওয়াতে হবে।
নার্সারির বাচ্চাদের একটানা ৯-১২ ঘণ্টা ঘুম দরকার। তারপরে ধীরে ধীরে বড় হলে ৮ ঘণ্টা একটানা ঘুমোতেই হবে। সঙ্গে শরীরচর্চা, সাইকেল চালানো, খেলাধুলো ভীষণ জরুরি।
আরও পড়ুন- ২ বছরের মধ্যেই বাংলায় নয়া হাসপাতাল! বড় ঘোষণা দেবী শেঠির
বড়দের সমস্যা
গলায় খুব ব্যথা হলে বা গলায় কষ্ট, অল্প কাশি থাকলে হালকা কুসুম গরম জল নুন দিয়ে দিনে তিনবার গার্গল করুন। সারাদিনে দু’বার ভেপার নিন। তারপর গলাটা সুতির কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখুন।
এই সময় মুখে মাস্ক পরলে ভাল, অন্তত তিনটে দিন আইসোলেশনে থাকুন। যাতে আপনার ভাইরাস অন্য কারও মধ্যে না ছড়ায়। গাঁটে গাঁটে ব্যথা হলে গরম সেঁক নিন। শরীরে আড়ষ্টভাব লাগলে হাঁটাচলার মধ্যে থাকুন। হালকা হলেও ব্যায়াম করুন রোজ।
যদি জ্বর আসে তাপমাত্রা দেখে নিন। একশো হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে দিনে তিনবার শরীরের অবস্থা বুঝে।
বয়স্কদের ক্ষেত্রে
সিজন চেঞ্জে (Season changes) বয়স্করাও সমস্যায় পড়েন কমবেশি। তাই তাঁদের ক্ষেত্রেও আগে থাকতে প্রতিরোধ গড়তে সবচেয়ে জরুরি হল ভ্যাকসিনেশন। বয়স্কদের ক্ষেত্রে ফ্লু ভ্যাকসিন প্রতি বছর নেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তির অবশ্যই নিতে হবে। এটি দু’বার নিতে হবে এক বছরের গ্যাপে। ভেপার নিন। শ্বাসনালি শুকিয়ে গেলে বেশি বেশি জল বেরিয়ে যায় শরীর থেকে। তাই আর্দ্রতা বজায় রাখতে পর্যাপ্ত জল খান।
যাঁদের সুগার, প্রেশার বা কিডনির সমস্যা রয়েছে, হার্টের রোগ রয়েছে, তাঁদের হালকা সর্দি-কাশি, জ্বর হলে অবশ্যই প্রথমেই তাঁর অক্সিজেন স্যাচুরেশনটা চেক করুন। যদি সবটা নিয়ন্ত্রণে থাকে তো ঠিক আছে। যদি না থাকে স্যাচুরেশন কমতে থাকলে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
অ্যাজমা বা সিওপিডি থাকলে ঋতু পরিবর্তনের মুহূর্তে শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমার এবং সিওপিডির পেশেন্টদের সমস্যা বাড়ে। এক্ষেত্রে ইনহেলার নিতে হবে। অনেকেরই শ্বাসকষ্ট খুব বেড়ে যায়। চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক চালু করলে রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবেন অথবা চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি করে দিন।