ষষ্ঠী থেকে জষ্ঠি
একটা সময় মুখ থুবড়ে পড়েছিল যাত্রা। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন বহু মানুষ। টান পড়েছিল তাঁদের পেটে। কমে গিয়েছিল শো, দলের সংখ্যা। অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছিলেন অনেকেই। ২০১১ সালের পর বদলে যায় ছবিটা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি যাত্রার সংকট উপলব্ধি করেন। তাঁর উদ্যোগে ও পরামর্শে রুগণপ্রায় এই শিল্পের নবজাগরণ ঘটান রাজ্যের মন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমির সভাপতি অরূপ বিশ্বাস। হাসি ফোটে অভিনেতা-অভিনেত্রী, পালাকার, নির্দেশক, দল মালিকদের মুখে। প্রায় হারিয়ে যেতে বসা একটা শিল্প গত বারো বছরে ফিরে পেয়েছে প্রাণ। ষষ্ঠী থেকে জষ্ঠি, বেড়েছে ব্যস্ততা। গ্রামবাংলার মাঠে মাঠে আবার মঞ্চস্থ হচ্ছে পালা। বছর বছর আয়োজিত হচ্ছে জমজমাট যাত্রা উৎসব (Yatra Utsav)।
সর্বস্তরে পৌঁছবে যাত্রা
এবার যাত্রা উৎসবের (Yatra Utsav) ২৮তম বছর। ২৪ নভেম্বর উদ্বোধন হয়েছে রবীন্দ্র সদন প্রাঙ্গণে, একতারা মুক্তমঞ্চে। উদ্বোধন করেন রাজ্যের মন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমির সভাপতি অরূপ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ২০১১ সালের আগে পর্যন্ত যাত্রা ধ্বংসস্তূপে পড়ে ছিল। যাত্রার মরাগাঙে বান এসেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে। তিনি শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দিচ্ছেন নানারকম সুযোগ-সুবিধা। চালু করেছেন পুরস্কার। আমরা যাত্রাকে সর্বস্তরে পৌঁছে দেব।
রাজ্যের মন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমির সহ-সভাপতি ইন্দ্রনীল সেন বলেন, বাংলার কালচারাল হাব রবীন্দ্র সদন প্রাঙ্গণ। সেখানে উদ্বোধন হল এই উৎসবের। এটা খুব সম্মানের ব্যাপার। আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাঁর সহযোগিতায় যাত্রার উত্তরণ ঘটেছে।
উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সচিব শান্তনু বসু, সংগীতশিল্পী শিবাজী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। অনুষ্ঠানে ‘শান্তিগোপাল-তপনকুমার’ পুরস্কার প্রদান করা হয় প্রশান্ত সরকার, তপতী ভট্টাচার্য, মিঠু মোনালিসা সাহা, প্রেমজিৎ মুখোপাধ্যায়, মৌমিতা চক্রবর্তী, শক্তিপদ প্রামাণিক, তারক সিনহা, অশোক দে, তুষার পাল, মুকুল পোদ্দারকে।
রবীন্দ্র সদন হাউসফুল
২৪-২৬ নভেম্বর, প্রথম তিনদিন রবীন্দ্র সদন মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়েছে তিনটি যাত্রাপালা। উপভোগ করেছেন মূলত এলিট ক্লাসের দর্শকরা। উদ্বোধনী দিনে মঞ্চস্থ হয়েছে কাকলি চৌধুরী-অনল চক্রবর্তী জুটির নতুন পালা ‘জোড়াদিঘির চৌধুরী বাড়ি’। অনল-কাকলিকে বলা হয় যাত্রার উত্তম-সুচিত্রা। তাঁদের অভিনয়ে করতালিতে মুখরিত হয়েছে প্রেক্ষাগৃহ। বাংলার সংস্কৃতির পীঠস্থানে নিজেকে প্রকাশ করতে পেরে উচ্ছ্বসিত অনল চক্রবর্তী। জানালেন, ভাল লেগেছে রবীন্দ্র সদন মঞ্চে অভিনয় করতে পেরে। তাও আবার যাত্রা উৎসবের মতো বড় আসরে। এটা সম্ভব হল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য। গান, কবিতা, থিয়েটার, চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন যে সম্মান পেয়ে থাকেন, তিনি যাত্রা শিল্পীদের সেই সম্মান দিলেন। এর পিছনে রাজ্যের দুই মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এবং ইন্দ্রনীল সেনেরও বড় অবদান রয়েছে। একজন যাত্রাশিল্পী হিসেবে আমার আবদার, এইভাবেই প্রতি বছর যেন রবীন্দ্র সদনে যাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। তাতে এই শিল্প সহজেই পৌঁছে যাবে রুচিশীল শহুরে দর্শকদের কাছে।
বর্তমান রাজ্য সরকারের প্রশংসা ঝরে পড়ল কাকলি চৌধুরীর কণ্ঠেও। তিনি বলেন, আগেও যাত্রা উৎসব হত। তবে আয়োজন এতটা রঙিন, এতটা জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাত্রাকে বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এবং মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেনেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তিন দশক পর রবীন্দ্র সদনে অভিনয় করলাম। একটা অন্যরকম অনুভূতি হল।
রবীন্দ্র সদনে দ্বিতীয় দিন মঞ্চস্থ হয়েছে মিতালি চক্রবর্তী ও শিলাজিৎ অভিনীত ‘রাধার চোখে জ্বলছে আগুন’। তৃতীয় দিন পিয়ালী বসু অভিনীত ‘ফুলেশ্বরীর ফুলশয্যা’। তিনদিনই ছিল হাউসফুল।
আরও পড়ুন- আদিবাসী সমাজকে কলুষিত করল বিজেপি, গদ্দারদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল বাংলা
সৃষ্টি হল নতুন ইতিহাস
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমি আয়োজিত এই উৎসবে ৩২ দিনে মঞ্চস্থ হচ্ছে ৩৪ পালা। এবারের আয়োজনে দারুণ খুশি যাত্রা জগতের খ্যাতনামা অভিনেত্রী ও নির্দেশক রুমা দাশগুপ্ত। তিনি বললেন, রবীন্দ্র সদনে এই প্রথম যাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হল। এটা খুবই আনন্দের। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাত্রা শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন। সারা জীবন জেনে এসেছি নন্দন-রবীন্দ্রসদন চত্বর মানেই সিনেমা, থিয়েটার, গান, কবিতা, আলোচনা, চিত্র, ভাস্কর্য। যাত্রা ছিল অপাঙক্তেয়। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে সৃষ্টি হল নতুন ইতিহাস। তাঁর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকেও। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমাদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। যাত্রা শিল্পকে পৌঁছে দিয়েছেন সম্মানজনক জায়গায়। সব মিলিয়ে এবারের যাত্রা উৎসব অনেকটাই অন্যরকম।
বারাসত কাছারি ময়দানে যাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে ২৫-২৬ নভেম্বর। চোখে পড়েছে ভিড়। ২৭ নভেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর, যাত্রা উৎসব (Yatra Utsav) অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাগবাজার ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রামঞ্চে। দর্শকদের উপস্থিতি উল্লেখ করার মতো। উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত হয়েছে আলোচনাসভা এবং ‘৫০০ বছর পেরিয়ে বাংলার জয়-যাত্রা’ শীর্ষক প্রদর্শনী। সবমিলিয়ে শীতের মরশুমে জমজমাট আয়োজন। সাজঘরে ব্যস্ততা। মঞ্চ প্রস্তুত। ভরপুর বিনোদন এবং অন্যরকম অভিনয়ের স্বাদ পেতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন।