“আচ্ছে দিনে বাড়ছে গতি,
মরলে মরুক হাতি;
জঙ্গলে লাশ গুনছে রাজা
জ্বালিয়ে ‘বিকাশ’ বাতি।”
মহামানবের সাগরতীরের ভারতবর্ষে আজ নাকি “হিন্দু খতরো মে হ্যায়”— তাই ধর্ম বাঁচাতে বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির নির্মাণ করতে গিয়ে খরচের বহরে টাকা কাগজে পরিণত হলে হোক কারণ, “হিন্দু খতরো মে হ্যায়”। তাজমহলের নিচে কোনও মন্দির না থেকে থাকলেও কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করে প্রত্নতাত্ত্বিক মহাযজ্ঞ চালিয়ে কোনও এক হিন্দুত্বের ইতিহাস বের করতে গিয়ে একটু-আধটু মিথ্যের আশ্রয় নিতে হলে হোক কারণ, “হিন্দু খতরো মে হ্যায়”। রামনবমীতে ঈশ্বরের নামে স্লোগান দিয়ে দা, ভোজালির মতো ধারালো অস্ত্র হাতে মিছিল করতে গিয়ে বুককাঁপানো সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি হলে হোক কারণ, “হিন্দু খতরো মে হ্যায়”। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মতো হিন্দুত্বের নামে মানবপ্রেম বিতরণের রসিকতা কেউ করে নাকি ছাই আজকাল! সন্ত্রাসবাদের সার্থক প্রদর্শন ঘটাতে না পারলে আপনি কীসের ধার্মিক? তাই রামনবমীতে রামদার মতো প্রাণঘাতী অস্ত্র আছে; তাজমহলের নিচে মন্দির খোঁজার অযাচিত, চুলচেরা চিরুনি তল্লাশি আছে; বাবড়ি মসজিদ গুঁড়িয়ে রামমন্দির নির্মাণের ঢালাও অর্থও আছে কিন্তু সাক্ষাৎ রামায়ণেই যাদের পৃথিবীর রক্ষাকর্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, কট্টর হিন্দুত্ববাদী দলের শাসনকালে তারাই ভারতবর্ষে সর্বাধিক অবহেলিত। বীরুপাক্ষ (পূর্ব), মহাপদ্মসম (দক্ষিণ), সৌমনস (পশ্চিম), এবং ভাদ্র (উত্তর)— রামায়ণে বর্ণিত এই হস্তী-চতুষ্টয় যেখানে এই ধরিত্রীর রক্ষাকর্তা, সেখানে রামায়ণের দেশ ভারতবর্ষই আজ হাতিদের (Elephant Death) বধ্যভূমি। সৌজন্যে ভারতীয় রেল। হিন্দু সৃষ্টিচক্রে অষ্টদিগ্গজের নিখুঁত বর্ণনা পাওয়া যায়, যারা আটটি দিকের রক্ষক হিসেবে কাজ করে। অষ্টদিগ্গজগুলির পাশে স্বমহিমায় বিরাজমান আটটি মহিলা হাতি পরিচিত অষ্টদিক্কারিণী নামে। অথচ হিন্দু পুরাণের আপন দেশেই ট্রেনের ধাক্কায় মহিলা হাতির মৃত্যু যেন সাম্প্রতিককালের অতি স্বাভাবিক ঘটনা। শুধুমাত্র শিলিগুড়ি জংশন থেকে আলিপুরদুয়ার জংশন পর্যন্ত ডুয়ার্সের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ২০০৪ সালে নির্মিত ১৬২ কিমি ব্রডগেজে শেষ ১৯ বছরে কাটা পড়া হাতির সংখ্যা ৭৪। তাতে নবীনতম সংযোজন গত সোমবার সকালে তিনটি নিরীহ হাতির মৃত্যু। সংশ্লিষ্ট রেলপথটিতে অনধিক ৩০ কিমিতে ট্রেন চালানোর দাবি নিয়ে বন বিভাগের আধিকারিকরা বহুবার সোচ্চার হলেও রেলদফতর তাতে ডোন্ট কেয়ার! আসলে হাতি লাইনে দাঁড়িয়ে পদ্মফুলে ছাপ দেয় না যে… এদেশে গজাননের জন্য প্রকাণ্ড লাড্ডু বরাদ্দ হলেও গজের ললাটে লেখা কেবল রেললাইনের গিলোটিন!
কথিত আছে, রাবণ বধের রাজসূয় যজ্ঞে আশীর্বাদ ভিক্ষা করে আশ্বিন মাসে দেবী দুর্গার পুজো করেন শ্রীরামচন্দ্র। তা থেকেই ধরাধামে শারদীয়া দুর্গোৎসবের প্রবর্তন। মা দুর্গা প্রতি আশ্বিনে কৈলাস থেকে মর্ত্যলোকে আসেন নৌকো, গজ, ঘোড়া কিংবা দোলায় চড়ে। শাস্ত্রমতে, রামের আরাধ্যা দেবী দুর্গা গজের পিঠে চড়ে এই ধরাধামে অবতীর্ণ হলে শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে বসুন্ধরা। বিরাজ করে ভশান্তি ও সমৃদ্ধি। এ-দেশে রামকে শিখণ্ডী করে ভোট বৈতরণী পারের মহামন্ত্র হিট হলেও রামের উপাস্য দেবী উমার সৌভাগ্যবাহী বাহন হাতির কপালে জোটে কেবল অবহেলা আর রেললাইনে মৃত্যু। আসলে ভোটব্যাঙ্ক আর ধর্ম যখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, ভক্তি তখন নিজেকে আত্মাহুতি দেয় অচেনা কোনও রেললাইনে। মানবিক বোধবুদ্ধি গড়াগড়ি যায় মেরুকরণের জঞ্জালে।
আরও পড়ুন- আজ সর্বদল বৈঠক, থাকবে তৃণমূলও
যে হিন্দু দেবতা রামকে বিক্রি করে নির্মিত হয় বিজেপি ভোটকৌশল, যে রামের নামে গ্রামকে গ্রাম দখলের স্বপ্ন দেখে বিজেপি, যে রামের নামে সস্তার ধর্মআফিম তারা বিলিয়ে চলে এই ভারতবর্ষের অলিতে-গলিতে; সেই শ্রীরামচন্দ্র হলেন বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। আবার ভাগবত পুরাণ মতে, শ্রীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলরাম বিষ্ণুর নবম অবতার। সেই বলরামের বাহন হিসেবেও হাতির উল্লেখ রয়েছে বহু জায়গায়। অথচ হিন্দু পুরাণের রাজধানী ভারতবর্ষেই ছদ্মহিন্দুত্বের ধ্বজাধারী বিজেপির শাসনকালে বিষ্ণুর নবম অবতার বলরামের বাহন হস্তী (Elephant Death) কাটা পড়ে সরকারি অপদার্থতায়।
হিন্দু শাস্ত্রমতে শান্তি, সমৃদ্ধি ও শিল্পের দেবতা হলেন গণেশ যার মস্তক স্থলাভিষিক্ত হয়েছে একটি গজ অর্থাৎ হাতির মস্তক দ্বারা। তাই গণেশের আরেক নাম গজানন (Elephant Death)। গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে প্রতি সেপ্টেম্বরে অতি জাঁকজমক সহযোগে গণেশ চতুর্থী উদযাপিত হয়। উন্মাদনা বাঁধ ভাঙে মুম্বইয়ে। সেখানে ভারতের প্রাক্তন রেল, কয়লা, অর্থ ও কর্পোরেট, জ্বালানি এবং খনিমন্ত্রী এককথায় সর্ববিদ্যায় বিশেষজ্ঞ তথা ভারতীয় রাজনীতির সর্বঘটের কাঁঠালী কলা পীযূষ গোয়েলের বাসভবনে সাংবাদিক ডেকে গণেশ চতুর্থীর আরতি করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং। কিন্তু বনাঞ্চলে রেলের গাফিলতিজনিত দুর্ঘটনায় হাতি মারা গেলে উনি নির্বিকার। আসলে নরেন্দ্র মোদি কিংবা প্রাক্তন রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলদের কাছে গজাননের আরাধনা কেবল হিন্দু ভোট ব্যাঙ্ক অধিগ্রহণের কলঙ্কময় একটি কূটনৈতিক কৌশল, অভয়ারণ্যের গজকে নিয়ে ভাবার সময় কোথায় তাদের! তাই তো কাশীতে তিনি তিলক কেটে বিশ্বনাথের উপাসক, বাংলায় এলে হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রপ্রেমী আবার মহারাষ্ট্রে ঢুকতেই উপচে পড়ে গণেশপ্রীতি। ভেকবদলের এই ভেলকিতে ভিমরি খায় গিরগিটিও।
হিন্দু ধর্ম মানুষকে সহিষ্ণুতার পাঠ দেয়। বলে যায় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের গল্প। নৃসিংহদেব থেকে শুরু গণেশ-সহ বহু দেবদেবীর পৌরাণিক মূর্তি আদতে মানুষ ও চতুষ্পদের সম্মিলিত রূপ। বজরংবলীর চেহারার সঙ্গে আমাদের রোজনামচার হনুমানের খুব একটা তফাত চোখে পড়ে না। বিষ্ণুর তৃতীয় অবতারের রূপও আবার বরাহের অনুকরণে। ত্রেতাযুগে বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রামচন্দ্রের ছায়াসঙ্গী লক্ষ্মণ আদতে একটি সাপ শেষনাগের অবতার, যার দেখা মেলে নারায়ণের অনন্তশয্যায়। সবমিলিয়ে বিবিধ পৌরাণিক ব্যাখ্যায় বন্যপ্রাণ আর হিন্দুধর্ম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলেও রাজনৈতিক পাল্লাধারী ধর্মব্যবসায়ীদের কাছে শাস্ত্রের মর্মার্থ বোঝার নমনীয়তা কোথায়! তাই ১৬২ কিমি রেলপথের মাত্র ৩৭ কিমি জুড়ে থাকে ‘ইন্ট্রুশন ডিটেকশন সিস্টেম’ (আইডিএস); বাকিটা জুড়ে কেবল মৃত্যুফাঁদ। ভারত জুড়ে বন্দে ভারতের বিলাসিতা আছে কিন্তু আইডিএসের জরুরি নিরাপত্তা নেই। মা হাতি ন্যূনতম খাবারের সন্ধানে ঘুরতে থাকে জঙ্গলে, অপেক্ষায় থাকে শাবক। মা আর ফেরে না কোনও দিন। রেললাইনে মাকে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় ঔদাসীন্য। খিদেয় কাঁদতে থাকে শাবক। সেই কান্না পৌঁছয় না দিল্লির দরবারে। সেখানে তখন প্রধানমন্ত্রী ঢোলের বোলে স্লোগান তোলেন— “গণপতি বাপ্পা মরিয়া”… আসলে গেরুয়াকরণের রাজনীতির মূলমন্ত্রই হল—
“যায় যদি যাক গজের প্রাণ,
গজাননই ভগবান।”