ওপেনহাইমার সিনেমা দেখার পর নারায়ণ সান্যালের ১৯৭৪ সালের লেখা ‘বিশ্বাসঘাতক’ উপন্যাস পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হল এমন এক বিশ্বাসঘাতক পৃথিবীতে জন্মেছিল যার জন্য মানব সভ্যতা ধ্বংসের মুখে পৌঁছে গিয়েছিল। এমন বিশ্বাসঘাতকের উদাহরণ বাংলাতে মিরজাফরের মাধ্যমে দেখা গেছে। যার ফল সিরাজদৌল্লার পতন ও ব্রিটিশদের শাসন প্রতিষ্ঠা তথা বাংলার পরাধীনতা। বর্তমান বাংলাতেও এমন এক বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিতে নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণে ব্যস্ত রয়েছে!
আরও পড়ুন-ইন্ডিয়া শরিকদের উপেক্ষার নীতিই ডোবাল কংগ্রেসকে, দক্ষিণেই হাতের শক্তি সীমিত
নন্দীগ্রামে সিপিএমের নেতৃত্বে সরকারের নির্বিচারে গণহত্যার পর যে অকৃতদারকে জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বাস করে অন্যতম নেতৃত্বের স্থান দিয়েছিলেন, একমাত্র নন, সেই বালু-মাটির ছেলে এমন এক গণভাবনা বা কল্পমূর্তি তৈরির চেষ্টা করছে যাতে মনে হয় সে বাংলার একমাত্র জননেতা তথা নন্দীগ্রাম আন্দোলনের একমাত্র মুখ। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটিকে সে আজ সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছে। কিন্তু ২০০৬ সালে প্রথমবারের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া তৃণমূলের টিকিটে বিধানসভা ভোটে জিতে একই সময়ে পৌরসভার চেয়ারম্যান হওয়ার মর্যাদা তৃণমূলের মাধ্যমেই সে পেয়েছিল। আবার তাকে সাংসদও করা হয়েছিল। সেই মেজোখোকা যখন দলত্যাগ করে তখন সে দুটো দপ্তরের মন্ত্রী এবং হুগলি রিভারব্রিজ কমিশনের চেয়ারম্যান। দল তাকে এতটাই বিশ্বাস করেছিল যে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মালদা, মুর্শিদাবাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলার অবজারভার পদও দিয়েছিল। তাহলে সমস্যা কী? ক্ষমতার তো কোনও খামতি ছিল না! আসলে এক সর্বগ্রাসী মানসিকতা ও বেইমানি চরিত্র। যে দল তাকে রাজনীতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল তাকেই পিছন থেকে চুরিকাঘাত করা। কিন্তু যে পরিবহণ দপ্তরে তাকে মন্ত্রী করা হয়েছিল দেখা যাচ্ছে সেই পরিবহণ দপ্তরে তার সময়ে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে।
আরও পড়ুন-ট্রেনের টিকিট বাতিলে গুনতে হবে দ্বিগুণ টাকা একাধিক নিয়ম বদল
১৪ মার্চ, ২০০৭, শুধু নন্দীগ্রাম গণহত্যার জন্য চর্চিত নয়, ঠিক নয় বছর পর ২০১৬ সালের ১৪ মার্চও খুব চর্চিত। কারণ ওই দিন রাজ্য বিজেপির অফিস থেকে নারদার ভিডিও দেখিয়ে শুভেন্দু অধিকারীকে চোর বলা হয়। সেই শুভেন্দুকেই সারদার সুদীপ্ত সেন বেআইনি সুবিধাভোগী ও ঘুরিয়ে তোলাবাজ বলে অভিযুক্ত করেছে। এমনকী বিরোধীরা তার চরিত্র নিয়েও কটূক্তি করতে ছাড়েনি। দিঘার হোটেল ব্যবসা, ট্রলার রাজনীতি এমনকী দিঘা-মন্দারমণি-শঙ্করপুর প্রভৃতি পর্যটনের জায়গা থেকে টাকা তোলার অভিযোগেও বিরোধীরা তাকে অভিযুক্ত করেছে। সেই অভিযুক্ত সিবিআই-এর এফআইআরে যার নাম রয়েছে সে বিজেপিতে গিয়েই সাধু! তার সাতখুন মাফ? তাহলে কোনটা সত্যি? তৃণমূল কংগ্রেসে থাকাকালীন চোর-খুনি-ষড়যন্ত্রকারী নাকি বিজেপি যাওয়ার পর বলিষ্ঠ সাধু নেতৃত্ব?
আরও পড়ুন-ট্রেনের টিকিট বাতিলে গুনতে হবে দ্বিগুণ টাকা একাধিক নিয়ম বদল
বিশ্বাসঘাতক অকৃতজ্ঞ শুভেন্দু বিজেপিতে যোগদানের মঞ্চে অমিত শাহের উপস্থিতিতে বলেন, তিনি ২০১৪ সাল থেকেই শাহের সঙ্গে যোগাযোগে রয়েছেন। আসলে ষড়যন্ত্র বোধহয় তখন থেকেই শুরু। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ভয়ে পালিয়ে গিয়ে নিজের শিরদাঁড়া বিক্রি করে যাদেরকে সবথেকে বেশি গালাগাল করেছে তাদের দলেই যোগ দিল, অদ্ভুতভাবে বিজেপির ইউটিউব চ্যানেল থেকে ভিডিও গায়েব হয়ে গেল, মামলার তদন্ত বস্তাচাপা পড়ল, সে নিজেকে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে তুলে ধরতে বহু সংস্কৃতিবাদের পীঠস্থান বাংলায় ৭০:৩০ ভাগ করতে লাগল, সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি দিয়ে বাঙালি মুসলিমদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করার চক্রান্তে লিপ্ত হল, বনগাঁয় প্রচারে গিয়ে গরুপাচার কাজে অভিযুক্তদের (তার কথায় লাল চুল কানের দুল) পাশে নিয়ে মতুয়াদের নাগরিকতা প্রদানের ভ্রান্ত প্রচার করে এল, আবার বাংলার উত্তরের জেলাগুলিতে আলাদা রাজ্যভাগের উসকানি দিল। চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারী শুভেন্দু তৃণমূলে থাকাকালীন যেসব জেলার দায়িত্বে ছিল সেখানে ব্ল্যাকমেল শুরু করল। সেখানকার নেতাদের তৃণমূল ত্যাগ করতে বাধ্য করা, টেট কেলেঙ্কারির বিশ্বজিৎ-এর উদাহরণ দিয়ে তাদের লোভ দেখানো নয়তো কেন্দ্রীয় এজেন্সির দ্বারা হয়রানি করানোর ভয় দেখাতে শুরু করল। যার প্রমাণ ২০২২-এর ডিসেম্বর মাসের ‘তারিখ পে চর্চা’ ও তৃণমূল নেতাদের গ্রেফতারি করানোর ক্রনোলজি ঘোষণা। তৃণমূল নেতাদের সম্পর্কে নানান তথ্যের সম্ভার (!) তুলে ধরলেও আদালতে কোনও তথ্য-প্রমাণ দাখিল করতে পারল না, আসলে মিথ্যা প্রচার, বিদ্বেষ ছড়ানো, কুৎসা রটনা করা এবং শক্তিহীন বিজেপিকে রাজনৈতিকভাবে কিছু অক্সিজেন যুগিয়ে নিজেকে তদন্ত থেকে বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
অনিষ্টকর শুভেন্দু যে সর্বগ্রাসী মানসিকতার অধিকারী তার কাছে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বাঁচতে বিজেপির বিভাজনের রাস্তাই একমাত্র বিকল্প হয়ে দাঁড়াল। কারণ ২০১৯-এর ভোটেও ধড়িবাজ আধিকারী মা-মাটি-মানুষ সরকারের দ্বারা বা রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে মেদিনীপুর কী কী ভাবে উপকৃত তার তালিকা তুলে ধরল; আবার ২০২১ সালের ভোটে জননেত্রীকে মেদিনীপুরে বহিরাগত বলে নানান অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করল। ফন্দিবাজ অধিকারী লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে ভোটে জিতেছে বটে, কিন্তু ধূর্তের জয় এখনও বিচারাধীন। তথাপি বলা বাহুল্য, মিথ্যাবাদী শুভেন্দু যদি এতই বড় মাপের নেতা হয় তাহলে বর্তমানের সাম্প্রদায়িক বিজেপিতে যোগ না দিয়ে জননেত্রী যেমন তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করে প্রকৃত বামফ্রন্ট-বিরোধীদের মর্যাদা দিয়েছিলেন তেমনই সে নিজের একটি দল গঠন করতে পারত! দেখতাম কত ধানে কত চাল?
আরও পড়ুন-আজ থেকে ফের বসছে বিধানসভা
আজ যখন তার বিরুদ্ধে নিজের দেহরক্ষীর হত্যায় জড়িত থাকা বা নারদা-সারদা কিংবা কাঁথি পৌরসভার দুর্নীতি এমনকী পরিবহণ ও সেচ দপ্তরের দুর্নীতি কিংবা তার সভায় পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা প্রভৃতির প্রেক্ষিতে পুলিশ যখন তদন্ত করতে চায় তখন সে আদালতের আশ্রয় খোঁজে। যে কোনও বিষয়ে আদালতই তার রাস্তা। মানুষের মাঝে নেতৃত্ব দেওয়ার ধক নেই। আদালত ও এজেন্সি-নির্ভর রাজনীতি। মানুষের বদলে কোর্টের উপর নির্ভরশীল রাজনীতির জন্য তাকে কোটাধিকারী কিংবা মিথ্যা প্রচারের জন্য মিথ্যাধিকারী ডাকাই শ্রেয়। তবে একথা সত্যি, সে খুবই পারিবারিক! তাই পুরো পরিবারকেই রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে রেখেছে এমনকী বাবার অ্যাকাউন্ট হঠাৎ ভর্তি করেছে। আবার সেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ করে? ধাপ্পাবাজ, প্রতারক এক রাজনীতিবিদ যে শুধুই নিজের জন্য মানুষকে বোকা বানিয়ে গেল ও মিথ্যার ফানুস উড়াল।
আরও পড়ুন-কমিশনের নির্দেশকে ‘ডোন্ট কেয়ার’, বিজেপি রাজ্যে নেতা–নেত্রীদের পকেটে নেশার দ্রব্য
কিন্তু এ-যুগের মিরজাফর দ্বারা বাংলার ইজ্জত বিজেপি নামক ইংরেজি জমিদারদের কাছে বিক্রি হবে না। কারণ এইসব মোসাহেবদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কোটি কোটি মানুষের নয়নের মণি অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর যোগ্য সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অজস্র তৃণমূল সৈনিক। তাই পারমাণবিক বোমার ক্ষেত্রে ক্লজ ফুক্সের বিশ্বাসঘাতকতায় পৃথিবী যে ধ্বংস দেখেছিল সেই পৃথিবী বাংলাতে মাদার টেরেসার মানবকল্যাণও দেখেছে। তেমনই টালির চালের হাওয়াই চটি পরা মহিলা বাংলার মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য যেভাবে লড়াই করে চলেছেন সেখানে গদ্দারদের পতন অবশ্যম্ভাবী।