“আমিষ খাবে আর!
সাহস এত কার?
লিট্টি-ধোসা হইবে এবার
জাতীয় খাবার।”
আমাদের তিনটে উঠোন পরেই গোপাল কাকার একফালি বারান্দা। ছোটবেলায় আমাকে রিকশা করে স্কুলে নিয়ে যেতেন ভদ্রলোক। বয়সের ভারে এখন আর কাজে বেরোতে পারেন না তেমন। কোভিডে ভোগার পর থেকে হাঁফিয়ে ওঠেন অল্পতেই। এসব নিয়েই বছরখানেক চলছিল বেশ। প্রধানমন্ত্রী খাদ্যসুরক্ষা যোজনার কল্যাণে কোনওক্রমে দুমুঠো জুটে যাচ্ছিল দুবেলা। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হঠাৎই বন্ধ হল প্রকল্প। কাকু-কাকিমার বেঁচে থাকার ভরসা বলতে এখন দিদির খাদ্যসাথীর চাল। কিন্তু তাতেও বা বুড়োবুড়ির শান্তি কোথায়! শুনলাম কাল রাতে গেরুয়া পতাকা (BJP Flag) কাঁধে কারা যেন হুমকি দিয়ে গেছে, চিকেন আর চারাপোনা চলবে না পাতে! পনির খেলে আপত্তি নেই কিন্তু পুঁটি খেলে ছাড়তে হবে পাড়া। চারশো টাকা কেজি পনির কেনার সামর্থ্য বুড়োবুড়ির নেই! ভরসা একটাই— ছেষট্টির এক সাদা শাড়ি, হাওয়াই চটি ভদ্রমহিলা বেঁচে আছেন এখনও; তিনিই সব সামলে নেবেন ঠিক।
করোনাকালীন পিএম কেয়ার ফান্ডের কোনও অডিট হয় না ভারতে অথচ করোনাকালে চালু হওয়া খাদ্যসুরক্ষা যোজনা অতি-সহজেই বন্ধ করা যায় অর্থাভাবের অজুহাতে। যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের খাদ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পুরোপুরি অক্ষম, যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের পাতে দুবেলা ভাত জোটানোর ন্যূনতম দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ, যে রাষ্ট্র করোনাপরবর্তী সংকটকালীন পরিস্থিতিতে সাধারণ ভারতবাসীর ক্ষুধাকে নিয়ে পরিহাস করে খাদ্যসুরক্ষা যোজনা বন্ধের মতো অমানবিক সিদ্ধান্তগ্রহণে দ্বিধাহীন; সেই রাষ্ট্রের কোনও অধিকার নেই নাগরিকের খাদ্যের নির্বাচনকে কোনও গেরুয়া ফিতের ফাঁসে বেঁধে ফেলার। উপার্জিত অর্থের উপর রাষ্ট্রকে কর দেওয়ার পর যে সঞ্চয় পকেটে পড়ে থাকে, তা দিয়ে ব্যক্তি পনির কিনবে নাকি পাঁঠার মাংস, তা একান্তই তাঁর জিহ্বার স্বাধীনতা। তাতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ নিদারুণ নির্লজ্জ অনধিকার চর্চা। শাসনের নামে শোষণ ও প্রেষণের এক যথার্থ নিদর্শন। জাতীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার দফতরের ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার ৬১%-ই আমিষভোজী। সমীক্ষার আওতাভুক্ত ১৮টি রাজ্যের মধ্যে ১৫টিতেই মাছ, মাংস কিংবা ডিম আশি শতাংশ মানুষের প্রথম পছন্দ। ১৬টি রাজ্যের ক্ষেত্রে চোখে পড়েছে এক অভিনব নজির যেখানে নিরামিষভোজীদের মধ্যে ইদানীং বেড়েছে আমিষ খাবারে রসনাতৃপ্তির প্রবণতা। ভারতবর্ষের যে ৩১% মানুষ বর্তমানে পুরোপুরি নিরামিষভোজী তাঁদের সিংহভাগই উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ অর্থাৎ কোথাও বিজেপির এই খাদ্যনীতি যেন ভারতবর্ষের সনাতনী সার্বভৌমত্বে আঘাত। দলিত, আদিবাসী, মুসলিম, খ্রিস্টানদের শ্বাসরোধ করে নতুন এক ব্রাহ্মণ-ভারত গড়ে তোলার স্বপ্নে মশগুল আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা সংগঠন যেখানে ভোট মানেই অবশ্যম্ভাবী গেরুয়া ঝড় আর পদ্মফুলের সুবাস। রোহিত ভেমুলার মৃত্যুতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল যে আশঙ্কার বীজ, আজ তা মহীরুহ হয়ে ওঠার পথে। তাই তো রাজস্থানে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরদিনই হাওয়ামহলের বিজেপি বিধায়ক বালমুকুন্দ এলাকার সমস্ত আমিষ খাবারের স্টল বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন প্রকাশ্যে। কড়া ভাষায় পুলিশকে কার্যত বাধ্য করেন ফতোয়া পালনে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি দিল্লির মসনদে বসার মাত্র দুমাসের মধ্যে গুজরাতের পালিতানায় আমিষ খাবার নিষিদ্ধ করেন অবলীলায় অথচ সংশ্লিষ্ট শহরে আমিষভোজীর সংখ্যা প্রায় ৪০% যার বেশিরভাগটাই মুসলিম এবং নিম্নবর্ণের হিন্দু। ভোটব্যাঙ্কের নেশায় মত্ত বিজেপি বৃন্দাবন এবং বারসনাতেও একইভাবে ২০১৭ সালে আমিষকে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করে— যেখানেও আমিষভোজীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। এয়ার ইন্ডিয়ার মতো সরকারি সংস্থাও আজকাল মাংসকে আমিষ হিসেবে বিবেচনা করে; বিভাজনের এতটা ঘৃণ্য রাজনীতির জঘন্যতম রুচি বোধ হয় ব্রিটিশ সরকারও দেখায়নি। সস্তায় পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা মেটাতে ডিমের জুড়িমেলা ভার। কিন্তু ভারতবর্ষের প্রায় চোদ্দোটি রাজ্যে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের মিড ডে মিলের পাতে কালো তালিকাভুক্ত ডিম। এখানেও কারণ আমিষের ওপর গেরুয়া নিদান। একটা দেশ বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে ১৩১-এ। দুফোঁটা দুধের অভাবে মারা যাচ্ছে শিশু আর সরকার মেতে আছে আমিষ বনাম নিরামিষের খেলায়। সত্য সেলুকাস! বড় বিচিত্র এ দেশ! যে দেশে যৌথ পরিবারে একটা ডিমকে দুবেলা ভাগ করে খাওয়া হয়, সে দেশে পনির, মাশরুম, রাজমার মতো দামি প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারগুলিকে নিয়মিত চেখে দেখা দিবাস্বপ্ন বইকি। যে দেশে চারাপোনা কিনতেই কাগজবিক্রেতা বাবার পকেট এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যায়, সে দেশে চিজ কেনা বিলাসিতামাত্র।
আরও পড়ুন-ধর্ষণে অভিযুক্ত বিজেপি নেতা
হিন্দুধর্মকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন যে স্বামীজি তিনিও শারীরিক শক্তি অর্জনের জন্য অন্যতম উপায় হিসেবে যুব সম্প্রদায়কে আমিষভক্ষণের কথা বলেছিলেন। স্বামীজির মাংসপ্রীতির কথা হয়তো অনেকেই জানেন না। মাংসের নানা পদ ছিল তাঁর ভীষণ প্রিয়। মুরগির মাংস খেতে তিনি পছন্দ করতেন বিশেষভাবে। সে-সময় মুরগির মাংস গৃহস্থ ঘরে ঢোকা ঘোর অনাচার বলে মানা হত। কিন্তু স্বামীজি এ-সব নিয়ম মানতেন না। স্বামীজির মুরগির মাংসের প্রতি এ-হেন প্রেম সম্বন্ধে স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণও অবগত ছিলেন। স্বামীজি নানা হোটেল গিয়ে যথেচ্ছ পরিমাণে মাংস ভক্ষণ করতেন। একদা এক শিষ্য শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে স্বামীজির নামে অভিযোগ জানায়। ঠাকুর হেসে বলেছিলেন, ‘খেয়েছে তো কী হয়েছে। তুই যদি রোজ হবিষ্যিও খাস, আর নরেন যদি রোজ হোটেলে মাংস খায়, তা হলেও তুই নরেনের সমান হতে পারবি না।’
আজও তামিলনাডুর বুনিয়াদি স্বামী শিব মন্দিরে ঈশ্বরকে চিকেন ও মাটন বিরিয়ানি অর্পণ করা হয় ভোগ হিসেবে। পুরীর জগন্নাথ মন্দির চত্বরে অবস্থিত বিমলা মন্দিরে রামচন্দ্রের আরাধ্যা দেবী দুর্গার অবতার বিমলাকে মাছ ও ছাগল ভোগ দেওয়া হয়। উত্তরপ্রদেশের তারকুলহা দেবীমন্দির কিংবা কেরলের কাদাভু মন্দিরেও আমিষভোগের প্রথা আছে। এই বাংলার কালীঘাট, তারাপীঠ, দক্ষিণেশ্বরের কিংবা কঙ্কালীতলার কালীমাকেও আমিষ প্রদান করা হয়। শাক্তধর্মে আমিষকে ব্রাত্য করে রাখার বিধান কোথাও দেওয়া হয়নি। বৈষ্ণব সংস্কৃতির পীঠস্থান ধামেশ্বর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মভূমি নবদ্বীপেও মুসলিম কিংবা শাক্ত আদর্শ পালনে বাধা দেয় না কেউ। চমকের ঘোর বাড়ে, রাজনীতির নেশায় যখন চোখে পড়ে— রাজস্থান, গুজরাত, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশে আমিষ নিয়ে যে বিজেপির এত ফতোয়া,তারাই কিন্তু মিজোরাম কিংবা মেঘালয়ের মতো উত্তর-পূর্বের রাজ্যে গোমাংস ভক্ষণ নিয়ে স্পিকটি নট। রাজ্যবিশেষে দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তন যে কেবল ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি, সে-কথা বলাই বাহুল্য— ‘বিফ ইজ মামি ফর দ্য বিজেপি ইন ইউপি বাট ইয়ামি ইন গোয়া অ্যান্ড দ্য নর্থ ইস্ট।’