অংশুমান চক্রবর্তী: রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক জীবন নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। বাতাসে ভেসে বেড়ায় যথেচ্ছ গালগল্প। তিনি কিন্তু সংসার পলাতক ছিলেন না। পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন আষ্টেপৃষ্ঠে। পিতা হিসেবে ছিলেন অতুলনীয়। বেশকিছু ঘটনা সেই সাক্ষ্যবহন করে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
রবীন্দ্রনাথের পাঁচ পুত্রকন্যা। সবচেয়ে কম আলোচিত তৃতীয় সন্তান রেণুকা। তাঁর ভালবাসার রানি। রানির জন্ম ১৮৯১-এর ২৩ জানুয়ারি। অকালমৃত্যু ১৯০৩-এর ১৯ সেপ্টেম্বর। এই বারো বছর সাত মাস আয়ুষ্কালে রানি আলোচিত শুধু তার জীবনের অন্তিম সময়টুকুর জন্য। ওই সময়ে ধরা পড়ে কবির পিতৃহৃদয়ের আকুলতা। কন্যাকে নিয়ে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াতে দেখা যায়। এমন একটা সময়, যখন কবির সদ্য স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে।
আরও পড়ুন-স্থিতিশীল মদন
কবি-কন্যার জীবনসায়াহ্নের করুণ ছবি ধরা পড়েছে পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভালোবাসার রানি’ উপন্যাসে। হাতে এসেছে বইটি। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, মনগড়া ঘটনার আশ্রয় নিয়ে গল্প ফাঁদার চেষ্টা করেননি লেখক। চিঠিপত্র ও কিছু প্রামাণ্য স্মৃতিচর্চা থেকে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেছেন। উপন্যাসটি চিনতে সাহায্য করে পিতা রবীন্দ্রনাথকে। শুরুটা এইরকম, ‘চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। বিন্দু বিন্দু ঘাম। রুমালে শুধু ঘাম নয়, ক্লান্তিও মুছে ফেললেন রবীন্দ্রনাথ।’ এই রবীন্দ্রনাথ আমাদের অচেনা। সৃষ্টি-সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে তাঁর যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে, তার সঙ্গে কোনও মিল নেই। এই রবীন্দ্রনাথ ভেঙে পড়া একজন মানুষ। অসহায়। কাগজ কলম ফেলে যক্ষ্মাক্রান্ত কন্যাকে নিয়ে চলেছেন। কোথায়? ‘রবীন্দ্রনাথ চলেছেন পাইন-ছাওয়া শীতের দেশে। অনেক পথ পেরিয়ে এসেছেন এই কাঠগুদাম স্টেশনে। বেরিলেপ থেকে কাঠগুদাম পৌঁছতে কম দুর্ভোগ হয়নি। তিনি নিজে একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছেন, অসুস্থ কন্যা রেণুকার কথা না বলাই ভালো।’
আরও পড়ুন-বিরাট দু.র্নীতি, মোদির জনধন যোজনায় নেই ১০ কোটি অ্যাকাউন্ট
কন্যাকে সুস্থ করে তোলার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছেন কবি। অমতে, কাঁচা বয়সে বিয়ে এবং মায়ের মৃত্যু যেন মৃত্যুর আগেই মেরে দিয়েছিল রেণুকাকে। বড় মেয়ে মাধুরীলতার বিয়ের দেড় মাসের মাথায় মাত্র দু-তিন দিনে কবির এই তড়িঘড়ি আয়োজন। অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সবাই। পাত্রটি কি যোগ্য ছিলেন? উপন্যাসের একটি অংশে আঁকা রয়েছে উত্তর, ‘ডাক্তার-জামাই শ্বশুরমশায়ের পয়সায় ডিগ্রি বাড়াতে পাড়ি দিলেন আমেরিকায়। সাগরপারের খেতাব, বিজয়মাল্য নিয়ে কি ফিরলেন? না, একেবারেই তেমন ঘটেনি, ফিরেছিলেন অকৃতকার্য হয়ে।’ স্বামীর ব্যর্থতা এবং নির্লজ্জ আচরণ কুরে কুরে খেয়েছিল রেণুকাকে। বিষিয়ে উঠেছিল মন। অসুস্থতা ছাড়িয়েছিল মাত্রা।
আরও পড়ুন-গান্ধীমূর্তির ধর.নামঞ্চে কুণাল, ছত্র.ভঙ্গ বিরো.ধীরা. কাল শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক কর্মপ্রার্থীদের
উপন্যাসটি ঝরঝরে ভাষায় লেখা। কোথাও ঘটেনি ছন্দপতন। চলন নদীর মতো। এগোতে হয় স্রোত-বরাবর। দুই তীরে প্রধান দুই চরিত্র। চরিত্র নির্মাণে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন লেখক। নিভৃত প্রাণের দেবতা নন, এই রবীন্দ্রনাথ রক্ত-মাংসের মানুষ। আটপৌরে। চেয়েছিলেন, যেভাবেই হোক কন্যাকে মৃত্যু-মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে। পারেননি। যেখানে যত ঘুম ছিল, সব নেমে এসেছিল রেণুকার চোখে, রানির চোখে। নিথর করে দিয়েছিল পিতার হৃদয়। কবির নয়, উপন্যাসে ফুটে উঠেছে একজন পিতার অন্তরের হাহাকার। অনুতপ্ত তিনি। মনে মনে নিয়েছেন কন্যাকে অপাত্রে দানের দায়। অতীত ঘটনা ফিরে ফিরে এসেছে। রেণুকার যন্ত্রণার ছবি ফুটে উঠেছে তীব্রভাবে। সেই যন্ত্রণার ঢেউ আছড়ে পড়ে পাঠকের বুকেও। মন হয়ে ওঠে কাতর, ভারাক্রান্ত। লেখক একজন গবেষক। তাঁর কাছে এই ধরনের আরও কিছু লেখা আশা করি। দে’জ পাবলিশিং প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদশিল্পী রঞ্জন দত্ত। দাম ১৬০ টাকা।
আরও পড়ুন-আজ পরিষেবা প্রদান
হরিবংশরায় বচ্চনের এ এক অসামান্য সৃষ্টি ‘মধুশালা’। ১৯৩৫ সালে প্রথম প্রকাশ পায়। তাঁকে এনে দেয় হিন্দি ভাষার অগ্রগণ্য কবি হিসেবে খ্যাতি। এই বইটির বৈশিষ্ট্য সমস্ত রুবাইয়া শেষ হয় ‘মধুশালা’ শব্দে। কবি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ওমর খৈয়াম দ্বারা। কবিতাগুলো বিভিন্ন সময় গীত হয়েছে। উচ্চারিত হয়েছে। যতদিন গেছে, ‘মধুশালা’ ততই বেড়েছে জনপ্রিয়তা।
সম্প্রতি ‘মধুশালা’ অনূদিত হয়েছে বাংলায়। আত্তীকরণ ও অনুবাদ করেছেন প্রবাসী লেখক অরুণকুমার রায়। তাঁর প্রশংসা ঝরে পড়েছে উত্তরপ্রদেশের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভারতীয় ভাষা বিভাগের বাংলা শাখা প্রধান ড. আমিনা খাতুনের ভূমিকায়। তিনি লিখেছেন, ‘‘তাঁর এই অনুবাদের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ওমর খৈয়ামকে অনুবাদের কাজ বহু করা হলেও হরিবংশরায় বচ্চনের ‘মধুশালা’র কোনও সম্পূর্ণ অনুবাদ আজ পর্যন্ত হয়নি বা কেউ করার কথা ভাবেনওনি।” আরও লিখেছেন, ‘‘ভাষার দূরত্বের যন্ত্রণা বহুদিন বাংলার বাইরে থাকার কারণে খুব ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন বলেই এমন কঠিন কাজে তাঁর আত্মনিয়োগ।”
আরও পড়ুন-সেলফি মাহাত্ম্য ও অমৃতকাল
কীভাবে জারিত হয়েছিলেন ‘মধুশালা’র মাদক-রসে, কী কারণে হাত দিয়েছিলেন অনুবাদে, ‘মধুশালা চিন্তাস্রোত’ গদ্যে জানিয়েছেন অনুবাদক অরুণকুমার রায়। হয়েছেন স্মৃতিমেদুর। ফিরে গেছেন ১৯৮৪-র ডিসেম্বরে। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র। সেই সময় অসামান্য কাব্যগ্রন্থটির সঙ্গে তাঁর প্রাথমিক পরিচয়। ধীরে ধীরে ভেসে যান অক্ষর-সাগরে। তরঙ্গে তরঙ্গে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। নেশা এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, আপন ভাষাভাষীদের কাছে মহৎ কাব্যগ্রন্থটি পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করেন অরুণ। দীর্ঘ অনুশীলনের পর মধুশালা’র মাদকরসে নেশাতুর হয়ে তিনি হাত অনুবাদকর্মে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর অনুবাদে লেগে রয়েছে এক অদ্ভুত সারল্য। রয়েছে চুম্বক-ক্ষমতা। বাধ্য করে একটি থেকে আরেকটিতে কবিতায় যেতে। চোখ রাখা যাক একটি কবিতায়, ‘‘থাকুক দ্রাক্ষা বৃক্ষ লতা/ সেথা হতে পাই হালা,/ থাকুক সেই মাটি যার থেকে/ তৈরি মধু পানের পেয়ালা,/ থাকুক সে মদির পিপাসা/ তৃপ্ত সে হয় না কখনও,/থাকুক সব তৃষিতরা,/ থাকুক এই মধুশালা।”
সত্যিই নেশা জাগায়। যে সমস্ত পাঠক বাংলায় ‘মধুশালা’র রস আস্বাদন করতে চান, তাঁদের কাছে এই সংকলন আদরণীয় হবে বলে আমার বিশ্বাস। দে পাবলিকেশনস প্রকাশিত বইটির দাম ২৫০ টাকা। প্রচ্ছদশিল্পী প্রশান্ত সরকার।